অস্থিরতা যেন কিছুতেই পিছু ছাড়ছে না পাকিস্তান ক্রিকেটের। একের পর এক ইস্যুতে খবরের শিরোনাম হচ্ছে তারা। কোচ, অধিনায়ক ও বোর্ড প্রধানের চেয়ারে এসেছে ব্যাপক রদবদল। এসব ঘটনায় রীতিমতো উত্তাল দেশটির ক্রিকেট। এশিয়ার পরাশক্তি ক্রিকেট দলের এমন অভ্যন্তরীণ কোন্দলের প্রভাব পড়তে পারে আসন্ন টি-২০ বিশ্বকাপেও।
পাকিস্তান ক্রিকেটের অস্থিরতার শুরুটা ভারত বিশ্বকাপের পর থেকে। আসরটিতে মোটাদাগে ব্যর্থ হয়েছে মেন ইন গ্রিনরা। স্বাভাবিকভাবেই ব্যাপক সমালোচিত হন পাকিস্তানের অধিনায়ক ও কোচিং স্টাফ। ওয়ানডে বিশ্বকাপের পরপরেই পাকিস্তানের তিন ফরম্যাটের নেতৃত্ব ছাড়েন বাবর আজম। যদিও পাকিস্তানের গণমাধ্যমের দাবি ছিল, ইচ্ছাকৃত নয় বরং তাকে নেতৃত্ব থেকে সরে যেতে বাধ্য করা হয়েছিল।
বাবর অধিনায়কত্ব ছাড়ার পর পাকিস্তানের টেস্ট দলের নেতৃত্ব পান শান মাসুদ এবং টি-২০ সংস্করণে নেতৃত্ব তুলে দেওয়া হয় শাহিন শাহ আফ্রিদির কাঁধে। সেসময় অবশ্য ওয়ানডে অধিনায়কের নাম ঘোষণা করেনি পাকিস্তান ক্রিকেট বোর্ড (পিসিবি)। এছাড়া দলের বাজে সময় পাকিস্তানের টিম ডিরেক্টরের দায়িত্ব পান মোহাম্মদ হাফিজ। একই সঙ্গে দলটির অন্তর্বর্তীকালীন প্রধান কোচের দায়িত্বও পান সাবেক এই অলরাউন্ডার।
অপরদিকে বিশ্বকাপের পর পাকিস্তানের বোলিং কোচের দায়িত্ব ছাড়েন দক্ষিণ আফ্রিকার সাবেক তারকা পেসার মরনে মরকেল। তার শূন্যস্থান পূরণ করেছিলেন পাকিস্তানেরই সাবেক তারকা পেসার উমর গুল। এছাড়া স্পিন বোলিং কোচের দায়িত্ব পান সাঈদ আজমল।
বিশ্বকাপের ব্যর্থ হওয়ার পর এভাবেই দলকে ঢেলে সাজিয়েছিল পিসিবি। নতুন করে নিয়োগ পাওয়া কোচ ও অধিনায়কের নেতৃত্বে অস্ট্রেলিয়ায় তিন ম্যাচের টেস্ট সিরিজ এবং নিউজিল্যান্ডের মাটিতে তাদেরই বিপক্ষে পাঁচ ম্যাচের টি-২০ সিরিজ খেলে পাকিস্তান। তবে দুই সিরিজেই মুখ থুবড়ে পড়ে দলটির। অজিদের বিপক্ষে টেস্টে হোয়াইটওয়াশ ও কিউইদের সঙ্গে ৪-১ ব্যবধানে সিরিজ হারে আফ্রিদি-বাবররা।
এরপরেই পাকিস্তান সুপার লিগে (পিএসএল) মনোযোগ দেন পাকিস্তানের ক্রিকেটাররা। মাঝে অবশ্য আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের ব্যস্ততা না থাকায় এই লিগেই সময় কাটিয়ে দেন তারা। আর ২০ ওভারের এই ফ্র্যাঞ্চাইজি টুর্নামেন্ট চলাকালীন অনেকের ভাগ্য নির্ধারণ হয়ে যায়। বলতে গেলে, আসন্ন টি-২০ বিশ্বকাপকে ঘিরে দল গোছানোর কাজ এগিয়ে নেয় দেশটির ক্রিকেট বোর্ড।
এর আগে অবশ্য বিশ্বকাপে দল ব্যর্থ হওয়ায় পিসিবির চেয়ারম্যানের পদ ছাড়তে হয় জাকা আশরাফকে। তার জায়গায় দায়িত্ব পান মহসিন নাকভি। আর দায়িত্ব পেয়েই একের পর এক নতুন সিদ্ধান্ত নেয়া শুরু করেন এই কর্তা।
তারই অংশ হিসেবে, অবসর ভেঙে পাকিস্তান দলে ফেরেন গতি তারকা মোহাম্মদ আমির এবং ইমাদ ওয়াসিম। তারা দুজনেই পিএসএলে দ্যুতি ছড়িয়েছেন। পিএসএল শেষেই তাদের দুজনকে নিয়ে গঠিত ২৯ জনের একটি দলকে কাকুলে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর অধীনে ফিটনেস ট্রেনিংয়ে পাঠানো হয়। সবকিছু ঠিক থাকলে হয়তো আসন্ন টি-২০ বিশ্বকাপেও দেখা যাবে অভিজ্ঞ এ দুই ক্রিকেটারকে।
মহসিন নাকভি দায়িত্ব নেয়ার পরপরেই কোচ ও অধিনায়কের বিষয়ে জোর দেন। তারই ধারাবাহিকতায় গত কয়েকমাসে পাকিস্তানের ক্রিকেটাঙ্গনে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল কোচ নিয়োগের বিষয়টি। মাঝে গুঞ্জন ওঠে, পাকিস্তানের দায়িত্ব নিতে যাচ্ছেন অস্ট্রেলিয়ার সাবেক তারকা ক্রিকেটার শেন ওয়াটসন। তাকে নিয়ে আলোচনা নাকি অনেকদূর এগিয়েও ছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত আর দায়িত্ব নেননি এই অজি অলরাউন্ডার।
কোচ নিয়োগের আগেই নতুন গুঞ্জন ওঠে, পাকিস্তানের টি-২০ দলের নেতৃত্ব হারাচ্ছেন শাহিন শাহ আফ্রিদি। তার জায়গায় আবারো বাবর আজমকে নেতৃত্ব দেওয়া হচ্ছে। বিষয়টি নিয়ে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনা শুরু হয়।
নানান নাটকীয়তার পর প্রায় পাঁচ মাসের মাথায় পাকিস্তানের সাদা বলের (টি-২০ এবং ওয়ানডে) ক্রিকেটে অধিনায়কত্ব দেওয়া হয়। পিসিবির এমন সিদ্ধান্তে সমালোচনা করেন দেশটির সাবেক অধিনায়ক শহিদ আফ্রিদি। যদিও পরে পিসিবির সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়েছেন তিনি। বলা ভালো, শহীদ আফ্রিদি সম্পর্কে শাহিন আফ্রিদির শ্বশুড়।
তবে শ্বশুড় মানলে কি হবে, ধৈর্য্যের বাধ দমাতে পারেননি শাহিন আফ্রিদি। বাবর আজমকে নেতৃত্ব দেওয়ার পর পিসিবি আফ্রিদির একটি ভুয়া বিবৃতি শেয়ার করেছিল। বিষয়টি নিয়ে রীতিমতো ক্ষোভ উগড়ে দেন তিনি।
সম্প্রতি সামাজিক মাধ্যমে তো রীতিমতো হুঁশিয়ারিই দিয়েছেন এক সিরিজেই অধিনায়কত্ব হারানো এই পেসার, ‘আমার ধৈর্য পরীক্ষা করবেন না। কারণ আমি আপনার দেখা সবচেয়ে দয়ালু এবং মধুরতম ব্যক্তি হতে পারি। কিন্তু একবার আমি আমার সীমায় ছাড়িয়ে গেলে, আপনি আমাকে এমন কিছু করতে দেখতে পাবেন, যা কেউ ভাবতে পারেনি। সেটিই আমি করে দেখাতে পারি।’
কারো নাম মুখে না আনলেও আফ্রিদি যে বাবর ও পিসিবির ওপর ক্ষোভ ঝেরেছেন সেটি বুঝতে কারো বাকি নেই। তবে বিশ্বকাপের মতো বড় আসরের আগমুহূর্তে দলের এই অভ্যন্তরীণ কোন্দলে প্রভাব পড়তে পারে পাকিস্তান ক্রিকেটে। যার ফলে টি-২০ বিশ্বকাপেও ভরাডুবি হতে পারে দলটির। এমন শঙ্কায় করছেন দেশের সাবেক ক্রিকেটাররা।
শাহিন শাহ আফ্রিদি টি-২০তে নেতৃত্ব হারালেও টেস্ট দলপতির জায়গায় বহাল রয়েছেন শান মাসুদ। এক সিরিজেই বোর্ড হয়তো তার উপর আস্থা হারাতে চায়নি। তবে প্রশ্ন উঠছে, আফ্রিদির অধিনায়কত্ব হারানো নিয়ে। কারণ, এই পেসারের নেতৃত্বেও মাত্র একটি সিরিজ খেলেছে পাকিস্তান। তবে দেশটির গণমাধ্যমের দাবি, পিএসএলে শাহিনের দলের ভরাডুবির কারণেই তার ওপর আস্থা হারিয়েছে বোর্ড।
এদিকে দলের স্থায়ী কোচও নাকি ঠিক করে রেখেছে পিসিবি। দেশটির প্রথম সারির গণমাধ্যম জিও টিভির এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সাদা বলের ফরম্যাটে (ওয়ানডে ও টি-২০) দক্ষিণ আফ্রিকার সাবেক ওপেনার গ্যারি কারস্টেন এবং লাল বলের (টেস্ট) ক্রিকেটে অস্ট্রেলিয়ার সাবেক পেসার জেসন গিলেস্পিকে নিয়োগের সিদ্ধান্ত নিয়েছে পিসিবি। খুব শিগগিরই পিসিবি এ বিষয়ে আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দিবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
এর আগে বোর্ডের বিরুদ্ধে বেতন বকেয়া রাখার অভিযোগ এনেছেন মোহাম্মদ হাফিজ। ক্রিকেট বিষয়ক সংবাদমাধ্যম ক্রিকেট পাকিস্তান জানিয়েছে, পিসিবির টিম ডিরেক্টরের পদ হারিয়েছেন এক মাস পেরিয়েছে, কিন্তু এখনো চুক্তির পুরো অর্থ বুঝে পাননি হাফিজ। এর মধ্যে অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ড সফরের দৈনিক ভাতাও অন্তর্ভুক্ত।
তাদের প্রতিবেদনে আরো বলা হয়েছে, চুক্তিবদ্ধ পাওনা টাকা ফিরে পেতে চেষ্টা চালিয়েছেন হাফিজ। কিন্তু মহসিন নাকভির ব্যবস্থার কারণে এখনো বিষয়টি সমাধান হয়নি। মূলত ব্যস্ত সূচির কারণে সাবেক ক্রিকেটারের সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে বসতে পারেননি পিসিবি সভাপতি।
ওয়ানডে বিশ্বকাপের পর থেকে শুরু হওয়া পাকিস্তান ক্রিকেট বোর্ডে অস্থিরতা এখনো লেগেই আছে। এই সমস্যার সমাধান হতে পারে একটি শিরোপা। হয়তো সে কারণেই আবারো বাবর আজমের ওপর ভরসা রেখেছে দেশটির বোর্ড। লম্বা সময় ধরে শিরোপা বঞ্চিত দলটি সব সমালোচনাকে এক পাশে রেখে যুক্তরাষ্ট্র-উইন্ডিজে ভাগ্যের চাকা ঘোরাতে পারে কি না, এখন সেটিই দেখার বিষয়।