ফিলিস্তিনের অবরুদ্ধ গাজা উপত্যকার মধ্যাঞ্চলের একটি হাসপাতালে সারি করে রাখা ১২টি মরদেহ। নিথর সবাই শিশু। কবে এই শিশুরা নিহত হয় তা জানা না গেলেও গতকাল আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে এই ছবি। সম্প্রতি গাজার আল আহলি আরব হাসপাতালে ভয়াবহ হামলার জের ধরে বিশ্ব ক্ষোভে ফেটে পড়ায় এমন হামলা কমে আসবে ভাবা হলেও তা হয়নি।
নতুন করে আবারও ইসরায়েলি হামলার লক্ষ্যবস্তু হচ্ছে এই ভূখণ্ডের হাসপাতাল। এতে নিহতের সংখ্যা ক্রমেই বেড়ে চলছে। লাশ দাফনের জন্য কাফনের কাপড়ের সংকট তৈরি হয়েছে। এমনকি ফের আরেকটি মসজিদে গতকাল হামলা চালিয়েছে ইসরায়েল। অধিকৃত পশ্চিম তীরের ওই মসজিদে হামলার ঘটনায় নিহত হয় দুই ফিলিস্তিনি। সেখানে হামাসের সদস্য ছিল বলে ইসরায়েল দাবি করেছে।
এদিকে সিরিয়ার দুই বিমানবন্দরে হামাসের মিত্ররা আস্তানা গেড়েছে সন্দেহে সেখানেও হামলা চালিয়েছে ইসরায়েল।
এ ছাড়া এই যুদ্ধ শুরুর দিন থেকেই প্রতিদিনই লেবাননের হিজবুল্লাহর সঙ্গে ইসরায়েলের গুলিবিনিময় হয়েছে।
তা ছাড়া, গতকাল গাজার সীমান্তবর্তী মিসরের কেরেম শালোম এলাকায় ইসরায়েলের একটি রকেট আঘাত হেনেছে। এই হামলার পরপরই ইসরায়েলের সেনাবাহিনী এ ঘটনায় দুঃখপ্রকাশ করে বলেছে, ভুলবশত সেখানে হামলা হয়েছে।
চলমান যুদ্ধে ইসরায়েলকে থাড ব্যাটারি ও অতিরিক্ত প্যাট্রিয়ট ব্যাটালিয়ন পাঠানোর কথা জানিয়েছে তাদের মিত্রদেশ যুক্তরাষ্ট্র। উদ্ভূত প্রেক্ষাপটে যুদ্ধ আরও বিস্তৃত হওয়ার শঙ্কা তৈরি হয়েছে। এতে গোটা অঞ্চল নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাওয়ার বিষয়ে সতর্ক করেছে ইরান।
গত শনিবার ইসরায়েলি সেনাবাহিনী জানিয়েছিল, তারা বোমা হামলা জোরদার করবে। করেছেও তাই। এদিন রাতভর গাজায় বোমাবর্ষণ চলে। এরপর গতকাল বিমান হামলা আরও জোরদার করা হয়। এতে ২৪ ঘণ্টায় আরও ২৬৬ ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছে। এর মধ্যে ১১৭টিই শিশু। হামাস পরিচালিত গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় গতকাল এ তথ্য নিশ্চিত করে।
গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় আরো জানায়, ১৬ দিন ধরে চলা যুদ্ধে ফিলিস্তিনি নিহতের সংখ্যা বেড়ে গতকাল হয়েছে ৪ হাজার ৬৫১।
আর ইসরায়েলের সেনাবাহিনী জানায়, শনিবার রাতভর গাজায় চালানো হামলায় হামাসের জ্যেষ্ঠ এক কমান্ডারসহ ‘বেশ কয়েকজন জঙ্গি’ নিহত হয়েছেন। বিমান হামলা আরও জোরদার করা হবে জানিয়ে উপত্যকাটির উত্তরাঞ্চল থেকে বাসিন্দাদের দক্ষিণাঞ্চলে চলে যাওয়ার জন্য আবারও সতর্ক করেছে দেশটির সেনাবাহিনী। এতে চলমান যুদ্ধের পরবর্তী ধাপ স্থল অভিযান হওয়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে। তবে হামাসের হাতে জিম্মি থাকা বিদেশিসহ ইসরায়েলিরা মুক্ত না হওয়া পর্যন্ত দেশটিকে স্থল অভিযানে যাওয়ার সময় পেছাতে চাপ দিচ্ছে মিত্রদেশগুলো।
৭ অক্টোবর ফিলিস্তিনের মুক্তিকামী সশস্ত্র সংগঠন হামাস ইসরায়েলে আকস্মিক হামলা চালায়। এতে এ পর্যন্ত ১ হাজার ৪০০ জনের বেশি ইসরায়েলি নিহত হয়েছে।
এদিকে গতকাল ত্রাণবাহী ১৭টি ট্রাকের দ্বিতীয় বহর মিসরের রাফাহ সীমান্ত দিয়ে গাজায় প্রবেশ করে। আগের দিন খাদ্য, পানি ও চিকিৎসা সরঞ্জাম নিয়ে গাজায় যায় ২০টি ট্রাকের প্রথম বহর। গতকাল মিসর সীমান্ত দিয়ে জ্বালানিবাহী ট্রাকও গাজায় প্রবেশ করেছে। জ্বালানি না এলে হাসপাতালগুলোতে জ্বালানি সংকট চরম আকার ধারণ করত।
লাশের জন্য পর্যাপ্ত কাফন নেই
ইসরায়েলি বোমা হামলায় হতাহতদের সামলাতে হিমশিম খাচ্ছিলেন গাজার মধ্যাঞ্চলের দেইর আল বালাহে অবস্থিত আল আকসা মারটায়াস হাসপাতালের চিকিৎসক ও নার্সরা। সেখানে লাশের সারি ক্রমেই দীর্ঘ হচ্ছিল। হাসপাতালটির এক কর্মীকে উদ্ধৃত করে বিবিসি আরবির আদনান এল-বারশ বলেন, হাসপাতালটির প্রাঙ্গণ লাশে ঠাসা। ভেতরও লাশে ঠাসা। লাশের সংখ্যা এতটাই বেশি যে পর্যাপ্তসংখ্যক কাফনের কাপড় নেই সেখানে। লাশগুলো আসছে টুকরো টুকরোভাবে। টুকরোগুলো মিলিয়ে লাশের পরিচয় শনাক্ত করার মতো উপায়ও নেই।
কিন্তু গাজার উত্তরাঞ্চল ছেড়ে বাসিন্দাদের দক্ষিণাঞ্চলে যাওয়ার নির্দেশ সত্ত্বেও লাখ লাখ ফিলিস্তিনি এখনো সেখানে রয়ে গেছে বলে জানা গেছে।
গাজার উত্তরাঞ্চলে ইসরায়েল স্থল অভিযানে গেলে লেবানন ও সিরিয়ায় থাকা হামাসের মিত্ররা যুদ্ধে জড়িয়ে পড়বে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
উদ্ভূত প্রেক্ষাপটে লেবানন সীমান্তবর্তী ১৪টি ইসরায়েলি সম্প্রদায়কে স্থানান্তরিত হওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এর আগে লেবানন সীমান্তবর্তী ২৮টি গ্রাম ও শহরের বাসিন্দাদের স্থানান্তর করেছিল ইসরায়েল।
অন্যদিকে লেবাননের হিজবুল্লাহ এই যুদ্ধে জড়ালে এটি তাদের বড় ভুল হবে বলে সতর্ক করেছেন ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু।
সূত্র: আল-জাজিরা