সেপ্টেম্বর ২, ২০২৩ ১১:০৯ পূর্বাহ্ণ
উষ্ণায়নের খপ্পরে পড়ে রীতিমতো বাউন্ডুলে হয়ে উঠেছে বিশ্বপ্রকৃতি। দিশেহারার মতো তালগোল পাকিয়ে ফেলেছে যুগ যুগ ধরে বয়ে বেড়ানো নিজের বার্ষিক ‘ঋতুচক্র’র। গরমের সময়ে শীত, বর্ষাবেলায় দাবানল লাগাম ছেঁড়া বলদের মতো; কোনো ঠিকঠিকানা নেই। একই ভূখণ্ডের এক পাশে খরায় মাটি ফেটে চৌচির, আরেক পাশে ভয়াবহ বন্যা! ‘গিরগিটির’ মতো ক্ষণে ক্ষণে বদলাচ্ছে চেহারা। একেক দেশে একেক চালে। মৌসুমি জলবায়ুকে ভুলে গিয়ে আপন মর্জিতে চলছে নিজ গতিতে। চলতি বছর জলবায়ু পরিবর্তনের এমন হযবরল অবস্থারই সাক্ষী হচ্ছে পুরো পৃথিবী। প্রকৃতির এ খামখেয়ালি লীলাখেলায় দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে মানুষসহ অন্যান্য প্রাণিকুলও। শুক্রবার এক প্রতিবেদনে এশিয়াসহ বিশ্বের বিভিন্ন মহাদেশে চলমান বৈশ্বিক উষ্ণতার এ বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি তুলে ধরেছে এএফপি।
বিশ্বের সবচেয়ে জনবহুল দেশ ভারতে আগস্টকে ১২৩ বছরের মধ্যে উষ্ণ এবং শুষ্কতম মাস হিসাবে তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়। মৌসুমি বায়ুর হিসাবে জুন থেকে সেপ্টেম্বর ভারতে বর্ষাকাল। সাধারণত জুলাইয়ের পর (২৮ সেন্টিমিটার) সর্বাধিক বৃষ্টিপাত হয় আগস্টে (২৫.৪ সেন্টিমিটার)। অথচ ভারতে এবার বর্ষা নেই বললেই চলে। প্রায় এক শতাব্দীর মধ্যে সবচেয়ে কম বৃষ্টিপাত হয়েছে আগস্টে। আবার এর ঠিক আগের মাসেই, জুলাইয়ের মাঝামাঝিতে অতিবৃষ্টিতে পানি বেড়ে লাল কেল্লা ছুঁয়ে ফেলে যমুনা। মোগল আমলের পর ওই মাসেই প্রথম যমুনার অতীত ঐতিহ্য দেখল দিল্লি।
আবহাওয়াবিদরা বলছেন, পৃথিবীজুড়ে এল নিনোর শক্তিশালী আক্রমণ, আরব এবং বঙ্গোপসাগরের প্রতিকূলতার প্রভাব পড়েছে উত্তর-পূর্ব ভারত, হিমালয় ও তামিলনাড়ুর কিছু অংশে। তবে মাসের শুরুতে দেশের উত্তরাঞ্চলে মারাত্মক বন্যার কারণে প্রবল বর্ষণ সত্ত্বেও সামগ্রিকভাবে গড় বৃষ্টিপাত অনেক কম হয়েছে। ভারতের আবহাওয়া পর্যবেক্ষক সংস্থা ইন্ডিয়া মেটরোলজিক্যাল ডিপার্টমেন্ট (আইএমডি) বলছে, সেপ্টেম্বরে ‘স্বাভাবিক’ বৃষ্টিপাতের সম্ভাবনা থাকলেও আগের চেয়ে গরমও বেশি হবে।
একই অবস্থা এশিয়ার আরেক দেশ জাপানেও। ১৮৯৮ সালের পর থেকে সবচেয়ে উষ্ণতম গ্রীষ্ম অনুভব করেছে। জুন থেকে আগস্ট পর্যন্ত দেশটির উত্তর, পূর্ব এবং পশ্চিমজুড়ে গড় তাপমাত্রা ছিল মাত্রাতিরিক্ত। আবার কিছু অঞ্চলে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা নয় বরং সর্বনিম্ন তাপমাত্রাও পৌঁছেছে রেকর্ড উচ্চতায়। এমনটাই জানিয়েছে জাপান আবহাওয়া সংস্থা ‘জাপান মেটরোলজিক্যাল এজেন্সি’ (জেএমডি)। অন্যদিকে মাসজুড়ে দীর্ঘস্থায়ী দাবানলের সঙ্গে লড়াই করেছে গ্রিস ও কানাডা। অস্ট্রেলিয়ায় এই শীতকালেও সবচেয়ে উষ্ণ ছিল তাপমাত্রার রেকর্ড। জুন থেকে আগস্ট পর্যন্ত চলমান মৌসুমে দেশটির গড় তাপমাত্রা ছিল ১৬.৭৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস (৬২.১৫ ফারেনহাইট)।
১৯১০ সালের রেকর্ড ঠান্ডার পর এটি ছিল শীতকালের সর্বোচ্চ গড় তাপমাত্রা। বিজ্ঞানীরা দীর্ঘদিন ধরে সতর্ক করে এসেছেন যে জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে তাপপ্রবাহ পৃথিবীকে ভয়াবহতার দিকে নিয়ে যাবে। সেই ভয়ংকর গন্তব্যেই ছুটছে পৃথিবী। প্রতি বছর প্রতিরোধযোগ্য তাপ সম্পর্কিত কারণে কয়েক হাজার মানুষ মারা যায়। ধনী জাপানেও জুলাইয়ে হিটস্ট্রোকে কমপক্ষে ৫৩ জন মারা গেছে। প্রায় ৫০,০০০ জনের জরুরি চিকিৎসার প্রয়োজন হয়েছে। উষ্ণ এই আগস্টেই আবার ঝড়-বন্যায় ভেসে গেছে রাজধানী বেইজিংসহ চীনের বেশ কয়েকটি অঞ্চল। অথচ জুলাইয়ে আবার চীনের বেশিরভাগ অঞ্চলের তাপমাত্রা ছিল ৫২ ডিগ্রি সেলসিয়াস। ঘরের বাইরে পা ফেললেই ফোসকা পোড়া গরম!
জাতিসংঘের বিশ্ব আবহাওয়া সংস্থার (ডব্লিউএমও) একজন সিনিয়র উপদেষ্টা জন নায়ারণ গত মাসে বলেছিলেন, ‘জলবায়ুর এ পরিবর্তন অনেক বেশি বিপজ্জনক হয়ে উঠছে। বৈশ্বিক উষ্ণতার সবচেয়ে দ্রুত উদীয়মান পরিণতি আমরা দেখছি। কেউ এ লক্ষণগুলোকে গুরুত্ব দিচ্ছে না। এ প্রভাব আরও তীব্র এবং আরও ঘন হবে।’