শাহানুজ্জামান টিটু
সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার দীর্ঘ অসুস্থতা শুধু দেশে নয়, আঞ্চলিকও আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও নতুন এক আলোচনার দ্বার খুলে দিয়েছে। বিশেষ করে দীর্ঘদিন নীরব থাকা পাশ্ববর্তী দেশ ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সুস্থতা কামনা এটি নিছক মানবিক বার্তা নয় বরং বাংলাদেশের পরিবর্তিত রাজনৈতিক বাস্তবতাকে লক্ষ্য করেই পাঠানো এক গুরুত্বপূর্ণ সংকেত। একই সঙ্গে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরীফ এবং চীনের পক্ষ থেকেও সহযোগিতার হাত বাড়ানো সব মিলিয়ে দক্ষিণ এশিয়ার ভূরাজনীতিতে নতুন এক অধ্যায় রচিত হচ্ছে।
বর্তমান প্রেক্ষাপটে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায় উঠে এসেছেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। এখন বল তার কোর্টে। কিভাবে খেলবেন এটা তার বিষয়। সামনে তার তিনটি বড় চ্যালেঞ্জ: খালেদা জিয়ার অসুস্থতায় উদ্ভূত পরিস্থিতি সামাল দেওয়া। তাঁকে (খালেদা জিয়া) ঘিরে দেশের রাজনৈতিক আবেগ ও জাতীয় ঐক্যের যে পরিবেশ তৈরি হয়েছে, সেটিকে সঠিক পথে পরিচালিত করা এখন তারেক রহমানের কৌশলগত দায়িত্ব। এটি ভুলভাবে পরিচালিত হলে বিপর্যয়ও তৈরি হতে পারে।
দ্বিতীয়ত, আগামী জাতীয় নির্বাচন ও আন্তর্জাতিক শক্তির আস্থা বজায় রাখা। নির্বাচন ঘিরে দেশি-বিদেশি শক্তিগুলো বিএনপির দিকে তাকিয়ে আছে। তারেক রহমানকে নির্বাচন সুষ্ঠু করার জন্য চাপ বজায় রাখার পাশাপাশি আন্তর্জাতিক সমর্থন ধরে রাখা এবং দলের ভেতর নেতৃত্বের ভারসাম্য ঠিক রাখা। আপাতত এই তিনটি কাজ একসঙ্গে করতে হবে তাকে।
এক দশকের বেশি সময় ধরে ভারতের সঙ্গে বিএনপি সম্পর্কে শীতলতা ছিল প্রকট। দিল্লির নীতিনির্ধারকেরা বরাবরই আওয়ামী লীগ সরকারের দিকেই ঝুঁকে ছিলেন। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক শক্তিক্ষয়, নীতিগত ভুল, অভ্যন্তরীণ সংকট এবং আঞ্চলিক নিরাপত্তা ইস্যুতে শৈথিল্যের কারণে ভারত এখন বাস্তবতাকে নতুনভাবে মূল্যায়ন করছে।
দেশটির কূটনৈতিক মহলের আশঙ্কা বাংলাদেশে ধর্মভিত্তিক ও উগ্রপন্থী গোষ্ঠীগুলো আবার মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে পারে। আগামী নির্বাচনে রাজনৈতিক ক্ষমতার কেন্দ্র বদলে যেতে পারে। এজন্য আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে বিএনপির সঙ্গে নতুন করে সম্পর্ক গড়া জরুরি।
ঠিক এই কারণেই খালেদা জিয়ার অসুস্থতার সময়টিকে দিল্লি কৌশলগত সুযোগ হিসেবে দেখছে। মানবিক বার্তার আড়ালে রাজনৈতিক বার্তাটি আরও দৃশ্যমান। তারা ভবিষ্যতের বাংলাদেশে বিএনপিকে গুরুত্ব দিচ্ছে বলে মনে হয়েছে।
ভারতে ও পাকিস্তানের আগেই চীনের আগ্রহ আরও স্পষ্ট। আঞ্চলিক ভূরাজনৈতিক প্রক্ষাপটে চীন ইতোমধ্যেই বিএনপির সঙ্গে যোগাযোগ বাড়িয়েছে। এটি শুধু অর্থনৈতিক বা কৌশলগত কারণে নয় বরং ভবিষ্যৎ ক্ষমতার সমীকরণে নিজেদের উপস্থিতি দৃঢ় করার অংশ। বেল্ট অ্যান্ড রোড উদ্যোগ, নিরাপত্তা সহযোগিতা এবং আঞ্চলিক বাণিজ্য সব দিক থেকেই চীন বাংলাদেশে একটি ভারসাম্যপূর্ণ শক্তি চায়, যা তাদের মতে বিএনপি ক্ষমতায় এলে আরও সুগম হতে পারে।
দীর্ঘদিন ধরে আন্তর্জাতিক মহলে বিএনপির সঙ্গে যোগাযোগ কিছুটা কমে গিয়েছিল। কিন্তু সাম্প্রতিক পরিস্থিতি পাল্টে দিয়েছে চিত্রটি। আন্তর্জাতিক শক্তিগুলো এখন বিএনপিকে মধ্যপন্থী, রাষ্ট্রবাদ এবং উগ্রবাদ প্রতিরোধে কার্যকর শক্তি হিসেবে দেখছে।
খালেদা জিয়া নিজেও বারবার বলেছেন, “আমাদের কারো সঙ্গে শত্রুতা নেই; আমরা সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব চাই।” এ বক্তব্য বিএনপির আন্তর্জাতিক গ্রহণযোগ্যতাকে আরও দৃঢ় করেছে।
জিও পলিটিক্সে পরিবর্তন এবং এর সাথে মানিয়ে চলতে হলে তারেক রহমানের আর লন্ডনে বসে দূরনিয়ন্ত্রণে দল চালানোর সুযোগ সীমিত। রাজনৈতিক বাস্তবতা বলছে তার মাঠে উপস্থিতি, সরাসরি নেতৃত্ব এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণের দৃশ্যমানতা এসব এখন অপরিহার্য হয়ে উঠেছে।
তারেক রহমান যদি এ মুহূর্তে দেশে ফিরে নেতৃত্ব নেন, তবে এই টার্নিং পয়েন্টকে তিনি জাতীয় ঐক্যের শক্তিতে রূপ দিতে পারেন। আর যদি পিছিয়ে যান, তাহলে আন্তর্জাতিক আস্থা ও অভ্যন্তরীণ গতি দুটিই দুর্বল হয়ে পড়তে পারে। এখানে ভুলের সুযোগ নেই, কারণ এটি ‘রাজনৈতিক নিউ পয়েন্ট তার একটি ভুল সিদ্ধান্ত আন্তর্জাতিক সমীকরণ, নির্বাচনী প্রস্তুতি, দলীয় ঐক্য, নেতৃত্বের গ্রহণযোগ্যতা সবকিছুকে দুর্বল করতে পারে। এখনকার প্রতিটি সিদ্ধান্ত রাষ্ট্র–দল–জাতির ভবিষ্যৎকে প্রভাবিত করবে।
তারেক রহমানের নেতৃত্বের ভবিষ্যৎ সব মিলিয়ে বাংলাদেশ একটি ট্রান্সফরমেশন মোমেন্টের মধ্যে রয়েছে। আগামী কয়েক মাসে তারেক রহমান কী সিদ্ধান্ত নেবেন এটাই নির্ধারণ করবে বিএনপির ভবিষ্যৎ, বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ, এবং দক্ষিণ এশিয়ার রাজনৈতিক মানচিত্র।
লেখক: সিনিয়র সাংবাদিক ও কলামিস্ট