কফির সৌরভ ছাড়া একটা দিনও যাদের ভালো কাটে না, কফিবিহীন বিশ্ব তাদের কাছে কেমন হতে পারে? ভাবা যায় না। যদিও বাংলাদেশে কফির চেয়ে চায়ের কদর বেশি, তারপরও দিন দিনই বাড়ছে কফির জনপ্রিয়তা। এমনকি শহুরে করপোরেট কালচারে, নাগরিকদের আড্ডায় নিজের অবস্থান দিন দিনই পোক্ত হচ্ছে কফির। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে কফির চাষ বাড়ছে। তবে বিজ্ঞানীদের গবেষণা বলছে, গ্লোবাল ওয়ার্মিং বা বৈশ্বিক উষ্ণায়নের ফলে, দুনিয়াজুড়ে হুমকির মুখে পড়েছে কফির সরবরাহ।
দ্য ইকোনমিস্টের হিসাব মতে, বিশ্বে প্রতিদিন ২০০ কোটিরও বেশি কাপ কফি পান করা হয়। ১২ কোটি ৫০ লাখ মানুষের জীবন এই কফির সঙ্গে সরাসরি জড়িয়ে আছে। পরোক্ষভাবে জড়িয়ে আছেন আরো অনেকে, এমনকি এই প্রতিবেদন পড়তে পড়তে যিনি কাপে চুমুক দিচ্ছেন, তিনিও এই হিসাবে আছেন। ৭০ টিরও বেশি দেশে এই কফি জন্মায়। এটি মূলত ক্যাফিন নামের একটা ড্রাগ বা ওষুধ, সবার হাতে হাতে পৌছায় কফির মোড়কে।
ফুটবল খেলার জন্যে তারকাচিহ্নিত দেশ ব্রাজিলে সবচেয়ে বেশী কফি উৎপাদিত হয়। দেশটি বছরে গড়ে ২৬ কোটি ৮০ লাখ মেট্রিক টন কফি উৎপাদন করে। গত দেড়শ বছর ধরে কফি উৎপাদনে প্রথম স্থান থেকে ব্রাজিলকে কেউ সরাতে পারেনি। ব্রাজিলের অবস্থান দক্ষিণ আমেরিকায়। গবেষকরা বলছেন, দক্ষিণ আমেরিকা, মধ্য আফ্রিকা ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়াজুড়ে বৃষ্টিপাতের ধরণ বদলে যাচেছ। সেখানে তাপমাত্রা বাড়ছে। আশঙ্কার বিষয় হলো, এসব জায়গাতেই সবচেয়ে বেশী কফি জন্মে।
ব্রাজিলের ফেডারেল ইউনিভার্সিটি অব ইটাজুবার কৃষি প্রকৌশলী ক্যাসিয়া গ্যাব্রিয়েল ডায়াসের সাম্প্রতিক গবেষণাপত্র অনুসারে, এই শতাব্দীর শেষ নাগাদ বিশ্বের বৃহত্তম উৎপাদক ব্রাজিলের কফি উৎপাদনকারী জমির ৩৫ শতাংশ থেকে ৭৫ শতাংশ চাষের অনুপযোগী হয়ে যেতে পারে।
কফি চাষ নিয়ে আশঙ্কা প্রকাশ করা এটাই একমাত্র গবেষণাপত্র নয়। ২০১৫ সালে প্রকাশিত আরেকটি গবেষণাপত্রে বলা হয়, ২০৫০ সালের মধ্যে বিশ্বের কফি উৎপাদনকারী জমির ৪৩ শতাংশ থেকে ৫৮ শতাংশ পর্যন্ত ফলনের অনুপযোগী হয়ে উঠবে। গ্রীন হাউজ গ্যাস কতোটা নিঃসরণ হয়, তার ওপর এই পূর্বাভাস মিলে যাওয়া নির্ভর করছে। যদি গ্রীন হাউজ গ্যাস কম তৈরী হয়, তাহলে জমির উৎপাদন ক্ষমতা ভালো থাকবে। যদি বেশি তৈরি হয়, তাহলে জমি বেশি উৎপাদন ক্ষমতা হারাবে।
এখন প্রশ্ন হলো, গরমের সঙ্গে কফির উৎপাদনের কী সম্পর্ক? কফি এমন একটি গাছ থেকে পাওয়া যায়, যার ভালো ফলনের জন্যে নির্দিষ্ট একটি তাপমাত্রা লাগে। যেমন কফিয়া অ্যারাবিকা জাতটি থেকে ভালো ফলন পেতে হলে, সারা বছর চাষের জায়গাতে তাপমাত্রা ১৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস থেকে ২৩ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে থাকতে হয়। তা না হলে ছত্রাকের সংক্রমণ ঘটে। বিশেষ করে কফিয়া অ্যারাবিকা ও কফিয়া রোবাস্টার উৎপাদনের জন্যে তাপমাত্রা একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।
দুনিয়াজুড়ে কফির ব্যবসা এই দুই জাতের গাছের কফি বিনের ওপর নির্ভর করে। যদিও বিশ্বে ১২০ টিরও বেশি জাতের কফি গাছের চাষ হয়, সেগুলো থেকে কফিও তৈরি হয়, কিন্তু স্বাদের কারণে, ব্যবসা হয় দুটো জাতের। কোয়ালিটি বড় বিষয়, মানতেই হবে।
তবে কৃষকরা ও বিজ্ঞানীরা অবশ্য বসে নেই। তারা নানাভাবে চেষ্টা করছেন, এই ঝুঁকি এড়িয়ে যাওয়ার। এরমধ্যে একটি হলো, কফি গাছের ওপরে ছায়া দেয় এমন গাছ রোপণ করা। অনেকটা সাথি ফসল চাষ করার মতো। বড় গাছের নিচে ছোট গাছ চাষ করা। তাতে বড় গাছের ছায়ায়, কফি গাছ বেশি তাপে পুড়ে না যায়। আরেকটি বাগান সরিয়ে নেয়া। এটি করা হয়, যেন গাছগুলো কাঙ্ক্ষিত তাপমাত্রার মধ্যে থাকে।
তবে যদি তাপমাত্রা বাড়তেই থাকে তাহলে কী কফি বিশ্ব থেকে হারিয়ে যাবে, এমনটাই প্রশ্ন কফিপ্রেমীদের।