সাবেক সেনাপ্রধান জেনারেল আজিজ আহমেদ এবং সাবেক পুলিশপ্রধান বেনজীর আহমেদের বিরুদ্ধে উত্থাপিত সাম্প্রতিক আলোচিত ঘটনা ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের ঘরে-বাইরে প্রভাব ফেলতে শুরু করেছে। ইতোমধ্যে দুর্নীতির অভিযোগে বেনজীর আহমেদের ব্যাংক হিসাব জব্দসহ সপরিবারে দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) তলব করার খবরে সমাজের অনেকে নড়েচড়ে বসেছেন। এর মধ্যে জেনারেল আজিজের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা-পরবর্তী সরকারের নীতিগত অবস্থানও বেশ কঠোর। দুদক চাইলে সাবেক এই সেনাপ্রধানকেও ডাকতে পারে বলে সরকারের দায়িত্বশীল পর্যায় থেকে খোলামেলা অভিমত দেওয়া হয়েছে। বিষয়টি দুর্নীতিবাজ প্রভাবশালীদের জন্য বড় সতর্কবার্তা বলে মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা।
গণমাধ্যমকে দেওয়া প্রতিক্রিয়ায় কয়েকজন বিশ্লেষক বলেন, এমন পরিস্থিতিতে মানসিক চাপে হলেও আওয়ামী লীগের ঘরে-বাইরের সবাই এখন নিজে থেকে আরও সতর্ক হবেন। বিশেষ করে যাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতি ও ক্ষমতা অপব্যবহারে পাবলিক পারসেপশন রয়েছে, তারা বিষয়টিকে খুবই সিরিয়াসলি নেবেন। এটাই স্বাভাবিক। যদিও এর আগে যুবলীগ নেতা ইসমাইল হোসেন চৌধুরী সম্রাটসহ ক্যাসিনো-কাণ্ডে জড়িতদের বিরুদ্ধে গ্রেফতার-পরবর্তী সামগ্রিক ঘটনাপ্রবাহ নিয়ে জনমনে নানা প্রশ্ন ও সন্দেহ সৃষ্টি হয়েছে। তাই এ বিষয়টি নিয়েও কেউ কেউ মনে করেন, কিছুদিন পর সবকিছু থেমে যেতে পারে।
এদিকে এ ঘটনায় বিব্রত সরকারপন্থি সাবেক ও বর্তমানে কর্মরত বিভিন্ন পেশাজীবী। সূত্রগুলো জানিয়েছে, প্রকাশ্যে কিছু না বললেও অনেকে ভেতরে ভেতরে বেশ অস্বস্তিতে আছেন। কেননা তাদের অনেকের মধ্যে এমন ধারণা বদ্ধমূল ছিল যে, যতদিন আওয়ামী লীগ সরকারে আছে, ততদিন তাদের টিকিটি পর্যন্ত কেউ স্পর্শ করতে পারবে না। কিন্তু হঠাৎ পাশা উলটে গিয়ে এখন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগই শক্তভাবে দুর্নীতিবাজদের টুঁটি চেপে ধরার নীতি নিয়েছে। মূলত এজন্য এ শ্রেণির প্রভাবশালী দুর্নীতিবাজদের কপালে নতুন করে চিন্তার ভাঁজ পড়তে শুরু করেছে।
আর রাজনীতি বিশ্লেষকরা বলছেন, ‘দায়মুক্তির সংস্কৃতি’ গড়ে ওঠায় এসব ব্যক্তি ভেবেছিল তাদের কিছু হয়তো হবে না। কিন্তু এ দুটি ঘটনা অন্যদের সামনে বড় উদাহরণ হয়ে থাকবে। সাধারণ মানুষও সরকারের এ অবস্থানকে ভালোভাবে নিয়েছে।
জানতে চাইলে সাবেক নির্বাচন কমিশনার ও ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেন বলেন, ‘এ পর্যায়ে যাওয়ার পরও তাদের কেউ রক্ষা করতে পারল না। কিন্তু এটা তো একদিনে হয়নি। ওনারা যখন সার্ভিসে ছিলেন, তখনই এসব অপকর্ম করেছেন। এর মানে এগুলোকে পলিটিক্যালি প্রশ্রয় দেওয়া হয়েছিল। তারা প্রিভিলেজ পেয়েছিলেন। পুলিশ বা র্যাবপ্রধান থাকাকালে বেনজীর আহমেদ তো দলীয় কথাই বলেছেন প্রকাশ্যে। তখন তো তাকে কেউ থামায়নি। দুজনই সুযোগ নিয়েছেন। একজন একরকম, আরেকজন অন্যরকম। তবে যারা এখন চাকরিতে আছেন, তাদের জন্য এটা বড় উদাহরণ হয়ে থাকবে।’
এম সাখাওয়াত হোসেন আরও বলেন, এ ঘটনা থেকে সরকারি চাকুরেদের শিক্ষা নেওয়া উচিত। কারণ, যখন তারা চেয়ারে ছিলেন, তখন সরকার তার স্বার্থে তাদের নানাভাবে পেট্রোনাইজড করেছে; কিন্তু এখন আর সেভাবে পাশে থাকছে না। অতএব অন্ধভাবে কোনো সরকারকে সাপোর্ট করলে শেষ পর্যন্ত কী হয়-এটাই তার অন্যতম উদাহরণ।
একই বিষয়ে সুশাসনের জন্য নাগরিক-সুজন সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার বলেন, ‘তারা তো বেপরোয়া ছিলেন-এই ভেবে যে তাদের কিছু হবে না। কারণ, এ ধরনের একটা দায়মুক্তির সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে। এটা তো গণতান্ত্রিক চেতনার পরিপন্থি। আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পরিপন্থি। যদি আমরা এর পরিবর্তন ঘটাতে না পারি, তাহলে তো এটা একটা ভয়ানক বিষয় হবে এবং আমাদের একটা ভয়ানক পরিস্থিতির দিকে নিয়ে যাবে।’
এ দুটি ঘটনা অন্যদের জন্য সতর্কবার্তা কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘শেষ রক্ষা হয় না’, ‘পাপ বাপকেও ছাড়ে না’-এসব কথা সত্য। কিন্তু সব সময় আবার সত্য না। ক্ষমতাসীনদের রোষানলে না পড়লে সাধারণত এ ধরনের ঘটনা হয় না বলেও মনে করেন বদিউল আলম মজুমদার।
সূত্র বলছে, আজিজ আহমেদ বা বেনজীর আহমেদের মতো যাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে, সরকার এসব ইস্যুতে কারও পক্ষ নেবে না। কারণ, যে অভিযোগগুলো তোলা হয়েছে এবং যেসব অভিযোগ পুরোপুরি মিথ্যা, সেটা এখনই বলা যাচ্ছে না। ফলে সরকার এ দায়দায়িত্ব নিয়ে বিতর্কিত হতে চায় না। বরং বিভিন্ন সংস্থার পাশাপাশি নিজেরাও নানাভাবে তদন্ত করবে ঘটনাগুলো। কারণ, টানা চতুর্থবার ক্ষমতায় আসার পর আওয়ামী লীগ জাতীয় ও আন্তর্জাতিক মহলে নিজেদের ভাবমূর্তি ইতিবাচক রাখার বিষয়ে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে। ফলে শুধু আজিজ-বেনজীর নন, যারা ক্ষমতার অপব্যবহার করেছেন বা করছেন, দেশে-বিদেশে সম্পদ গড়েছেন, তাদের কোনো অপকর্মের দায়ই নেওয়া হবে না। এ ধারা ভবিষ্যতেও অব্যাহত থাকবে।
মঙ্গলবার আওয়ামী লীগ সভাপতির ধানমন্ডির রাজনৈতিক কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলনে বিষয়টি নিয়ে কথা বলেন আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহণ ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। তিনি বলেন, সরকারের বিচার করার সৎ সাহস আছে। সরকার তাদের অপরাধ অস্বীকার করে পার পেয়ে যাওয়ার সুযোগ দেয়নি। দুর্নীতির ব্যাপারে সরকারপ্রধান আপসহীন। তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সারা বিশ্বে একজন সৎ প্রধানমন্ত্রী হিসাবে পরিচিত। বাংলাদেশে জনপ্রিয়তার মূলে রয়েছে তার সততা ও পরিশ্রম।
আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য এবং পাট ও বস্ত্রমন্ত্রী জাহাঙ্গীর কবির নানক এক্ষেত্রে সরকারের দায় দেখেন না। তিনি বুধবার যমুনা টিভিকে জানান, কেউ কোনো অনিয়ম করলে তা গোপনেই করবে। সরকার কাউকে পাহারা দিতে পারবে না। তবে এসব কাজের জন্য অনিয়মকারীকেই জবাবদিহি করতে হবে। দুর্নীতি প্রতিরোধে সরকার বসে নেই উল্লেখ করে তিনি বলেন, আইন অনুযায়ী ইতোমধ্যেই ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। এসব নিয়ে সংশয়ের কোনো সুযোগ নেই।
এর আগে এ বিষয়ে রোববার মন্ত্রণালয়ের নিজ কার্যালয়ে সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের জবাবে অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলীও সরকারের কঠোর অবস্থানের কথা জানান।