সেপ্টেম্বর ৬, ২০২৩ ৯:১০ পূর্বাহ্ণ
সরকার পতনের একদফা দাবিতে আন্দোলনের চতুর্মুখী প্রস্তুতি নিচ্ছে বিএনপি এবং সমমনা রাজনৈতিক দল ও জোট। তবে তফশিল ঘোষণার আগেই আন্দোলনের সফল পরিণতি দেখতে চান সবাই। এজন্য দাবি আদায়ে মধ্য সেপ্টেম্বর থেকে কঠোর কর্মসূচি চান নেতাকর্মীরা। এ আন্দোলনের গতি-প্রকৃতি এমন হতে হবে, যেন সরকার পদত্যাগে বাধ্য হয়। এজন্য যুগপৎ আন্দোলনে থাকা মূল দলের ছাত্র-শ্রমিক ও পেশাজীবী সংগঠনও পৃথক প্ল্যাটফরমে নামছে।
নেতারা জানান, সোমবার রাতে বিএনপির স্থায়ী কমিটির বৈঠকে চূড়ান্ত আন্দোলনের কর্মসূচি নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়। এতে নেতারা বলেন, চলমান শান্তিপূর্ণ কর্মসূচি দিয়ে সরকারকে পদত্যাগে বাধ্য করা যাবে না-এটি তারাও উপলব্ধি করছেন। তাই আরও কঠোর কর্মসূচি দিতে দলের প্রতি চাপ রয়েছে তৃণমূল নেতাদের। সেজন্য ভিন্ন কিন্তু গতানুগতিক নয়-এমন কঠোর কর্মসূচি কি হতে পারে তা নিয়ে আলোচনা হয়।
সেক্ষেত্রে আদালত প্রাঙ্গণে অবস্থান, গণভবন ও সচিবালয় ঘেরাওয়ের মতো কর্মসূচির প্রস্তাবনা আসে। পাশাপাশি হরতাল-অবরোধের মতো কর্মসূচি ভিন্ন নামে দেওয়া যায় কিনা তা নিয়েও আলোচনা করা হয়। ঢাকায় সমাবেশের মাধ্যমে চূড়ান্ত আন্দোলনের জন্য কর্মসূচি ঘোষণার সিদ্ধান্ত হয়। এর আগে গণতন্ত্রমঞ্চসহ সমমনা দল ও জোটের সঙ্গে দু-এক দিনের মধ্যে বৈঠক করবে বিএনপি। সবার পরামর্শ নিয়েই চূড়ান্ত আন্দোলনের কর্মসূচি ঠিক করতে চায় দলটি।
বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, ‘আওয়ামী লীগ আবারও আগের মতো ভোট করতে চায়। এ দেশের মানুষ এবার সিদ্ধান্ত নিয়েছে, সেটা আর সম্ভব হবে না। এবার মানুষ রুখে দাঁড়াবে। চূড়ান্ত কর্মসূচি আসছে। এই ভয়াবহ সরকারের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলে অবশ্যই বিজয় অর্জন করতে হবে। জিততে আমাদের হবেই। এছাড়া আর কোনো বিকল্প নেই।’ তিনি বলেন, ‘কথা একটাই সরকারকে পদত্যাগ করতে হবে। নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নতুন নির্বাচন কমিশন কর্তৃক নির্বাচনের ব্যবস্থা করতে হবে।’
লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টি-এলডিপির প্রেসিডেন্ট কর্নেল (অব.) অলি আহমদ বলেন, ‘মিছিল-মিটিং দিয়ে যে সরকার পতন হবে না, আমরা যারা বিরোধী দল করি সবাই তা বুঝি। তবে সরকার পতন আন্দোলনটা পর্যায়ক্রমেই এগিয়ে নিতে হয়। বিএনপি বিরোধী দল হিসাবে তা যথার্থভাবে করছে।’
তিনি বলেন, ‘অর্থনৈতিকভাবে বিগত এক বছর ধরে সরকার পঙ্গু অবস্থায় ছিল। বর্তমানে পঙ্গু অবস্থায় প্যারালাইসিস। এই সরকারের পক্ষে বর্তমান অর্থনৈতিক অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসা সম্ভব না। পদত্যাগ করে ক্ষমতা হস্তান্তর ছাড়া সরকারের সামনে কোনো বিকল্প নেই।’
গণতন্ত্র মঞ্চের সমন্বয়ক ও বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক বলেন, ‘শুধু গণমিছিল, গণসমাবেশ, পদযাত্রায় লাখ লাখ মানুষ নামলেও সরকারের গায়ে তো বড় ধরনের আঁচড় লাগছে না। কর্মীদের মনোভাব হচ্ছে এমন ধরনের কর্মসূচি দরকার, যেখানে সরকারকে পদত্যাগে বাধ্য করা যাবে।
সেটা নিয়ে আলাপ-আলোচনা হচ্ছে। এবার বড় ধরনের বিরতি না দিয়ে সরকারকে পদত্যাগে বাধ্য করার আগ পর্যন্ত কর্মসূচি ধারাবাহিকভাবে চলবে-এ রকমের চিন্তা আছে।’
তিনি বলেন, ‘আগামী দু-এক দিনের মধ্যে বিএনপির সঙ্গে বৈঠকের সম্ভাবনা আছে। ১৫ থেকে ২০ সেপ্টেম্বরের মধ্যে আরও কয়েকটি কর্মসূচি আসবে। এরপর ধারাবাহিক কর্মসূচি দিয়ে চূড়ান্ত পর্যায়ের আন্দোলনে যাওয়ার কথা ভাবা হচ্ছে। অবস্থান, বিক্ষোভ, ঘেরাও, অবরোধ, এমনকি হরতালও আমরা চিন্তা থেকে বাদ দিচ্ছি না। কারণ বিভিন্ন দল ও সাধারণ জনগণ থেকে এ ধরনের কর্মসূচির জন্য চাপ আসছে।’
১২ দলীয় জোটের অন্যতম শরিক বাংলাদেশ এলডিপির মহাসচিব শাহাদাত হোসেন সেলিম বলেন, ‘সেপ্টেম্বর ও মধ্য অক্টোবরকে ঘিরেই একটা আন্দোলনের চূড়ান্ত কর্মসূচি দরকার। তফশিলের আগেই চূড়ান্ত আন্দোলনের সফল পরিণতি আসবে বলে আশা করছি।’
জাতীয়তাবাদী সমমনা জোটের সমন্বয়ক ও এনপিপির চেয়ারম্যান ড. ফরিদুজ্জামান ফরহাদ বলেন, জনসম্পৃক্ত শান্তিপূর্ণ আন্দোলনের মধ্য দিয়ে আমরা এ সরকারকে বিদায় করে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবি আদায় করব।
ছাত্র-শ্রমিক ও পেশাজীবীদের পৃথক মোর্চা, আসছে সমাবেশ : একদফার আন্দোলনে ছাত্র-শ্রমিক ও পেশাজীবীদের পৃথক মোর্চা গড়ার চেষ্টা করছে বিএনপি। যেখানে সমমনা ও বিরোধী রাজনৈতিক দলের ছাত্র-শ্রমিক ও পেশাজীবী সংগঠনকে অন্তর্ভুক্ত করা হচ্ছে। চূড়ান্ত আন্দোলনে এই তিন শ্রেণি-পেশার প্রতিনিধিদের অংশগ্রহণ আরও দৃশ্যমান করাই এর লক্ষ্য। বিএনপি নেতারা মনে করছেন, সরকারবিরোধী সব ছাত্র-শ্রমিক সংগঠন এবং পেশাজীবীকে ঐক্যবদ্ধভাবে মাঠে নামানো না গেলে গণঅভ্যুত্থান পরিস্থিতি তৈরি করা যাবে না।
এ লক্ষ্যে বিএনপির শীর্ষ নেতৃত্ব থেকে জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলকে ‘ফ্যাসিবাদ বিরোধী ছাত্র ঐক্য’ নামে একটি আলাদা মোর্চা গঠনের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। এর অংশ হিসাবে ইতোমধ্যে ছাত্রদলসহ ১৯টি ছাত্রসংগঠন বৈঠকও করেছে। পাশাপাশি শ্রমিক সংগঠনগুলোকে সক্রিয় করা হচ্ছে। এজন্য শ্রমিকনেতা শামসুর রহমান শিমুল বিশ্বাসকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। বিএনপির চেয়ারপারসনের বিশেষ সহকারী ও বাংলাদেশ সড়ক পরিবহণ শ্রমিক ফেডারেশনের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক শিমুল বিশ্বাস জানান, ‘গণতন্ত্র ও ভোটাধিকার প্রতিষ্ঠায় শ্রমিক সংগঠনগুলোকে নিয়ে একটি মোর্চা করার চেষ্টায় আছি।’
পেশাজীবী সংগঠনগুলোকেও ঐক্যবদ্ধ করে মাঠে নামানোর চেষ্টা করছে বিএনপি। এ লক্ষ্যে বিএনপিপন্থি পেশাজীবীদের সংগঠন বাংলাদেশ সম্মিলিত পেশাজীবী পরিষদকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। এই সরকারের সঙ্গে নেই, এমন বিরোধী দলের পেশাজীবী সংগঠনগুলোর সঙ্গে তারা যোগাযোগ করছে। ইতোমধ্যে ‘ইউনাইটেড ল ইয়ার্স ফ্রন্ট’ নামে সরকারবিরোধী আইনজীবীদের একটি সংগঠন সুপ্রিমকোর্টে গঠন করা হয়েছে। সম্মিলিত পেশাজীবী পরিষদের সদস্য সচিব কাদের গণি চৌধুরী বলেন, ‘আমরা সারা দেশের পেশাজীবীদের এক জায়গায় আনার চেষ্টা করছি। চিকিৎসক, প্রকৌশলী, শিক্ষক, সাংবাদিক, কৃষিবিদসহ অন্যান্য পেশাজীবীকে নিয়ে ঢাকায় একটি মহাসমাবেশ করার পরিকল্পনা আছে।
তৃণমূলে জামায়াতেরও আন্দোলনের বার্তা : একাধিক সূত্র জানিয়েছে, ভোটাধিকার ফিরিয়ে আনতে নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে আন্দোলনের জন্যে মাঠে নামার জোরালো প্রস্তুতি নিচ্ছে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী। দলটির নেতারা মনে করছেন, বর্তমান সরকার ফের ক্ষমতায় আসতে পারলে জামায়াতের অস্তিত্ব আরও সংকটে ফেলতে নানা পদক্ষেপ নেওয়া হবে। এছাড়া তৃণমূল নেতাদের নামে থাকা সব রাজনৈতিক মামলায় বিচারকাজ শেষ করবে সরকার।
রাজনীতিতে শেষ কথা বলে কিছু না থাকলেও ইতোমধ্যে দলটির তৃণমূল স্পষ্ট যে, এ সরকারের অধীনে জামায়াত নির্বাচনে যাচ্ছে না। এজন্য আগামীতে নেতাকর্মীদের মাঠে থাকার স্পষ্ট বার্তা দিয়েছে দলটির কেন্দ্র। সম্প্রতি অনলাইনে এক কর্মসূচিতে অংশ নিয়ে জামায়াতের ভারপ্রাপ্ত আমির অধ্যাপক মুজিবুর রহমান তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠা ও এক দফার দাবিতে রাজপথে আন্দোলন-সংগ্রামে নেতাকর্মীদের সক্রিয় হওয়ার আহ্বান জানান। তিনি বলেন, দেশের জনগণ সরকারকে আর কোনো নির্বাচনি নাটক মঞ্চস্থ করতে দেবে না।
এর বাইরে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি) ও বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দলের (বাসদ) নেতৃত্বাধীন বাম গণতান্ত্রিক জোট, চরমোনাই পীরের দল ইসলামী আন্দোলনসহ ইসলামপন্থি কয়েকটি দলও মনে করে, দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু হওয়ার সম্ভাবনা নেই। এ সরকারের অধীনে তারাও নির্বাচনে যাবেন না। বিএনপির প্রত্যাশা, তারাও দাবি আদায়ে পৃথকভাবে মাঠে থাকবেন।