আগস্ট ৩০, ২০২৪ ১০:৩০ পূর্বাহ্ণ
গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার প্রাণঘাতি গণআন্দোলনের মুখে দেশ ছেড়ে ভারতে পালিয়েছেন ক্ষমতাচ্যুত সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। আওয়ামী সরকার পতনের পর বাংলাদেশে বিশ্বস্ত এবং অনুগত মিত্র হারিয়েছে দিল্লি, এমনটাই মনে করেন বিশ্লেষকরা।
এছাড়া একনায়ক হয়ে উঠা শেখ হাসিনাকে আশ্রয় দেওয়ায় তীব্র ভারত বিরোধিতা তৈরি হচ্ছে বাংলাদেশে। শুধু তাই নয়, সাম্প্রতিক সময়ের বন্যার দায়ে ভারতের দিকে অভিযোগের তীর বাংলাদেশের রাজনৈতিক মহলের। এর মধ্যে হাসিনার ক্ষমতাচ্যুতির পর নিরাপত্তা উদ্বেগের দোহাই দিয়ে ভিসা সেন্টার বন্ধ রেখেছে ভারত। তাতে ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কে ভাঙন আরো স্পষ্ট হচ্ছে।
হাসিনাকে আশ্রয়, বন্যা এবং ভিসা সেন্টার বন্ধ রাখা; এই তিন ইস্যুতে বাংলাদেশ-ভারত দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কে কোনটি সবচেয়ে বড় বাধা?
২৯ আগস্ট ‘হাসিনা, ফ্লাডস, ভিসাস: হোয়াইটস ট্রাবলিং ইন্ডিয়া-বাংলাদেশ রিলেশনস?’ শিরোনামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে আল জাজিরা।
গত সেপ্টেম্বর ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি তার বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে বিশেষ অতিথি হিসেবে নয়াদিল্লিতে অনুষ্ঠিত জি-২০ শীর্ষ সম্মেলনের সময় স্বাগত জানিয়েছিলেন। এটি ভারতের পক্ষ থেকে খুবই ঘনিষ্ঠ একজন প্রতিবেশীর প্রতি উষ্ণ আতিথেয়তার একটি ইঙ্গিত ছিল।
কিন্তু এক বছর পর এই ঘনিষ্ঠতা ভারতের জন্য একটি সমস্যায় পরিণত হয়েছে। এই মাসের শুরুতে ছাত্র-জনতার আন্দোলনের কারণে ১৫ বছর ক্ষমতায় থাকার পর হাসিনা ক্ষমতাচ্যুত হন। হাসিনা পালিয়ে ভারতে চলে আসেন।
হাসিনার ক্ষমতাচ্যুতির কয়েক সপ্তাহ পরও বাংলাদেশে ভারতবিরোধী মনোভাব তীব্রভাবে রয়ে গেছে। হাসিনাকে ভারত আশ্রয় দিচ্ছে এবং ভারত ভিসা ও পানি ব্যবহার করে বাংলাদেশকে লক্ষ্যবস্তু বানিয়েছে– এমন অভিযোগের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের জনগণের মধ্যে ভারতের প্রতি ক্ষোভ বাড়ছে।
এখানে দুই দেশের মধ্যে সম্পর্কের সমস্যাগুলোর একটি বিশ্লেষণ দেওয়া হলো:
হাসিনাকে বাংলাদেশে ফেরত পাঠানোর দাবিতে বিরোধী দলের চাপ বাড়ছে। হাসিনা ৫ আগস্ট সামরিক হেলিকপ্টারে করে বাংলাদেশ থেকে পালিয়ে ভারতের নিকটবর্তী সামরিক ঘাঁটিতে অবতরণ করেন, যেখানে তাকে ভারতের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত ডোভাল স্বাগত জানান। ধারণা করা হচ্ছে, তিনি তখন থেকে দিল্লির আশেপাশেই অবস্থান করছেন।
হাসিনাকে বাংলাদেশে ফেরত পাঠানোর দাবি ক্রমেই জোরালো হচ্ছে
সোমবার বাংলাদেশের প্রধান বিরোধী দল বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ভারতীয় গণমাধ্যমকে জানান, হাসিনাকে বাংলাদেশে ফেরত পাঠানো এবং বিচার করা উচিত। একই দিনে জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জিএম কাদেরও একই দাবি করেন। কাদের ছিলেন ৬ আগস্ট ভেঙে দেওয়া বাংলাদেশ সংসদের বিরোধীদলীয় নেতা।
মির্জা ফখরুলের উদ্ধৃতি দিয়ে ভারতীয় গণমাধ্যম জানিয়েছে, ‘ভারতকে হাসিনার কাছ থেকে জবাবদিহিতা আদায় করতে সহায়তা করা উচিত কারণ তিনি বাংলাদেশের যথেষ্ট ক্ষতি করেছেন।’ হাসিনার বিরুদ্ধে খুনসহ বেশ কয়েকটি আইনি মামলা রয়েছে।
গত সপ্তাহে নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকার হাসিনার কূটনৈতিক ভিসা বাতিল করেছে। এর ফলে হাসিনা ভারতে কতদিন আইনগতভাবে থাকতে পারবেন, তা অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। ভারত সরকার এ বিষয়ে এখনও কোনো মন্তব্য করেনি।
ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক ও রাজনৈতিক বিজ্ঞানী আলী রিয়াজ বলেছেন, বাংলাদেশের মানুষ হাসিনার বিরুদ্ধে দায়িত্বশীলতার দাবি জানাচ্ছে কারণ তার ১৫ বছরের শাসনামলে জোরপূর্বক গুম এবং বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের অভিযোগ রয়েছে।
র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব) নামক প্যারামিলিটারী বাহিনীকে হত্যাকাণ্ড ও গুমের সাথে জড়িত থাকার কারণে জাতিসংঘের নিষেধাজ্ঞার সম্মুখীন হতে হয়েছে। হাসিনা ২০০৯ সালে ক্ষমতায় আসার পর থেকে মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচের তথ্যমতে, ‘৬০০-এরও বেশি গুমের ঘটনা’ ঘটিয়েছে বাংলাদেশের নিরাপত্তা বাহিনী।
বাংলাদেশের বন্যার পেছনে ভারতের দায় কতটুকু?
বাংলাদেশ ও ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের কিছু অংশ, যেমন ত্রিপুরা, আসাম ও মেঘালয় রাজ্য আগস্ট মাসে ভারী বৃষ্টিপাতের সম্মুখীন হয়। পরবর্তীতে ভারতের উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢল ও ভারী বৃষ্টিপাতের জন্য বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলায় বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে।
বাংলাদেশের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় ২৩ আগস্ট জানিয়েছে, প্রায় ১ লাখ ৯০ হাজার মানুষকে জরুরি ত্রাণ শিবিরে স্থানান্তরিত করা হয়েছে। বাংলাদেশে ৬৪টি জেলার মধ্যে ১১টি জেলায় বন্যার প্রভাব পড়েছে এবং ১০ লাখের বেশি মানুষ বন্যার কারণে দেশের অন্য অংশ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে।
তবে বাংলাদেশি সাইবারস্পেসে (সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও বিভিন্ন অনলাইন প্ল্যাটফর্ম) গুজব ছড়িয়েছে, ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের ডম্বুর বাঁধ ‘জোরপূর্বক’ খুলে দেওয়ার কারণে এই বন্যা হয়েছে। ডম্বুর বাঁধ গোমতী নদীর ওপর অবস্থিত, যা ভারত হয়ে বাংলাদেশে প্রবাহিত হয়। তবে এই দাবির পক্ষে কোনো প্রমাণ এখনো পাওয়া যায়নি।
ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ২২ আগস্ট এক বিবৃতিতে বলেছে, বন্যার কারণ অতিরিক্ত বৃষ্টিপাত এবং বাঁধের নিচের বড় জলাধার থেকে আসা পানি। বিবৃতিতে উল্লেখ করা হয়েছে, ‘আমরা দ্বিপাক্ষিক পরামর্শ ও প্রযুক্তিগত আলোচনার মাধ্যমে জলসম্পদ ও নদী ব্যবস্থাপনার বিষয়গুলো সমাধানে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।’ ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে ৫৪টি আন্তঃদেশীয় নদী রয়েছে।
এর আগে এই সপ্তাহে, বাংলাদেশে নিযুক্ত ভারতের হাইকমিশনার প্রণয় বর্মা অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনুসকে জানিয়েছিলেন, বাঁধের পানি ‘স্বয়ংক্রিয়ভাবে’ ছাড়া পেয়েছে কারণ পানির স্তর বেশি ছিল।
তবে বাংলাদেশের বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কতা কেন্দ্রের কর্মকর্তারা আল জাজিরাকে বলেছেন, অতীতের মতো ভারত তাদের প্রতিবেশীকে পানি ছাড়ার বিষয়ে সতর্কবার্তা দেয়নি। এই সতর্কবার্তা দেওয়া হলে মৃত্যু ও ক্ষয়ক্ষতি ঠেকানো সম্ভব হত।
বন্যার কারণ যাই হোক, অনেক বাংলাদেশি ভারতকে অভিযোগ দিচ্ছেন কারণ অতীতের অভিজ্ঞতা অনুযায়ী দুই দেশের মধ্যে পানি ভাগাভাগি নিয়ে সমস্যা রয়েছে।
বাংলাদেশ দীর্ঘদিন ধরে দুই দেশের মধ্য দিয়ে প্রবহমান নদীগুলো থেকে আরও পানি পাওয়ার দাবি করে আসছে— এ সংক্রান্ত একটি চুক্তি দশকেরও বেশি সময় ধরে আটকে রয়েছে, যা ঢাকার জন্য একটি বড় সমস্যা।
অধ্যাপক আলী রিয়াজ বলেন, ‘বর্ষাকালে বাংলাদেশে পানি জমে গেলেও শুষ্ক মৌসুমে বাংলাদেশ কখনোই প্রয়োজনীয় পানি পায়নি।’
বাংলাদেশে অবস্থিত ভারতীয় ভিসা সেন্টারগুলোতে কী ঘটছে?
বাংলাদেশের ঢাকা এবং দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের সাতক্ষীরা জেলায় ভারতীয় ভিসা আবেদন কেন্দ্রগুলো মঙ্গলবার বন্ধ ছিল। বাংলাদেশের শত শত মানুষ ভিসা প্রক্রিয়াকরণের দেরির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করার পরের দিনই ভিসা সেন্টারগুলো বন্ধ রাখার ঘটনা ঘটেছে।
হাসিনার ক্ষমতাচ্যুতির পর নিরাপত্তা উদ্বেগের কারণে ভারত ঢাকায় কূটনৈতিক উপস্থিতি কমিয়ে দিয়েছে। বিক্ষোভ চলাকালীন সংশ্লিষ্টরা তাদের পাসপোর্ট ফেরত দেওয়ার দাবি জানান।
২০২৩ সালে প্রায় ১.৬ মিলিয়ন বাংলাদেশি ভারতে সফর করেছেন– যা বাংলাদেশের নাগরিকদের জন্য অন্যতম শীর্ষ গন্তব্য। পর্যটন এবং চিকিৎসা সেবা নিতে অনেক বাংলাদেশি ভারত ভ্রমণ করেন।
বাংলাদেশ এবং ভারতের মধ্যকার সম্পর্কে কী কারণে সমস্যা দেখা দিচ্ছে?
নয়াদিল্লি এবং ঢাকা দীর্ঘদিন ধরে শক্তিশালী কূটনৈতিক ও বাণিজ্যিক সম্পর্ক ভাগাভাগি করে আসছে। ১৯৭১ সালে পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনে ভারতীয় সেনাবাহিনী গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল।
তবে সাম্প্রতিক দশকগুলোতে, ভারত শেখ হাসিনা এবং তার ‘সেক্যুলার’ আওয়ামী লীগ দলকে ভারতের স্বার্থের সাথে ভালোভাবে সামঞ্জস্যপূর্ণ হিসেবে দেখে আসছে। হাসিনার বিরোধীরা ভারতের বিরুদ্ধে তাকে ক্ষমতায় টিকিয়ে রাখতে সহায়তা করার অভিযোগ এনেছে, যদিও তার অধীনে গুম, সমালোচকদের গ্রেপ্তার এবং নির্বাচনে প্রভাব খাটানোর অভিযোগের মতো অগণতান্ত্রিক কাজের প্রমাণ রয়েছে।
অধ্যাপক রিয়াজ বলেন, বাংলাদেশে ভারতের বিরুদ্ধে ক্ষোভ ‘বছরের পর বছর ধরে বৈধ বিষয়গুলো নিয়ে চলে আসা বিবাদ থেকে তৈরি হওয়া চরম অসন্তোষের প্রতিফলন”।
তিনি বলেন, ‘ভারতের হাসিনার প্রতি তীব্র সমর্থন’, তিনটি প্রতারণামূলক নির্বাচন এবং মানবাধিকারের ভয়াবহ লঙ্ঘনে সহায়তা করেছে।
তিনি উল্লেখ করেন, ২০১৪ সালের নির্বাচনের আগে ভারতের সাবেক পররাষ্ট্র সচিব সুজাতা সিং বাংলাদেশ সফরের সময় জাতীয় পার্টিকে নির্বাচন বয়কট করা থেকে বিরত রাখতে চেষ্টা করেছিলেন। ‘এটি আওয়ামী লীগকে নতুন জীবন দিয়েছিল।’
বেশিরভাগ বিরোধী দল নির্বাচনে বয়কট করেছিল এবং প্রধান বিরোধী দল বিএনপির চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়াকে গ্রেপ্তার করার পাশাপাশি দলটির জ্যেষ্ঠ নেতাদের গ্রেপ্তার করা হয়েছিল।
হাসিনার ক্ষমতাচ্যুতির পর বাংলাদেশি হিন্দুদের ওপর হামলার ঘটনায় ভারতের মধ্যে ক্ষোভ ছড়িয়েছে। মোদী এই সমস্যা আন্তর্জাতিকভাবে আলোচনায় এনেছেন, যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের সাথে আলোচনা করেছেন।
৯ আগস্ট ঢাকা শহরে শত শত আন্দোলনকারী দেশের হিন্দুদের ওপর সহিংসতার বিরুদ্ধে বিক্ষোভ করেন। বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিষ্টান ঐক্য পরিষদ (বাংলাদেশের ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের প্রতিনিধিত্বকারী একটি সংগঠন) জানিয়েছে, হাসিনার পদত্যাগের পর অন্তত ৫২ জেলায় সাম্প্রদায়িক সহিংসতা ঘটেছে।
বাংলাদেশের প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূস ১৬ আগস্ট মোদীকে কল করে দেশের হিন্দুদের নিরাপত্তার নিশ্চয়তা দেন। তিনি ‘একটি গণতান্ত্রিক, স্থিতিশীল, শান্তিপূর্ণ এবং অগ্রগতিশীল বাংলাদেশের জন্য ভারতের সমর্থন পুনর্ব্যক্ত করেন,’ বলে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্স-এ একটি পোস্টে লিখেছেন।
অধ্যাপক রিয়াজ বলেন, দুই দেশের সম্পর্কের উন্নয়ন ‘যেকোনোভাবে ভারতের দায়িত্ব’ কারণ হাসিনার শাসন ভারতের সমর্থনের কারণে টেকসই হয়েছিল।
হাসিনার দীর্ঘ শাসনের অবসানের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশ একটি নতুন অধ্যায়ে প্রবেশ করেছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘ভারতীয়দের তাদের নীতিগুলি পুনর্বিন্যাস করা উচিত, তাদের সমস্যার জন্য কান্নাকাটি করা উচিত নয়। বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে– এই সত্যটি মেনে নিয়ে ভারতও সামনে এগিয়ে যাক।’