ডিসেম্বর ৭, ২০২৩ ৮:৪২ পূর্বাহ্ণ
প্রতিটি আসনে দলীয় স্বতন্ত্র প্রার্থী রেখে সংসদ নির্বাচনকে গ্রহণযোগ্য করার আওয়ামী লীগের ঘোষণা শুরুতেই সাড়া জাগিয়েছে। প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা ২৬ নভেম্বর গণভবনে দলীয় মনোনয়নপ্রত্যাশীদের সঙ্গে মতবিনিময় অনুষ্ঠানে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসাবে নির্বাচনে নেতাকর্মীদের প্রতিদ্বন্দ্বিতার সুযোগের ঘোষণা দেন।
এই ঘোষণার পর আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের মধ্যে ব্যাপক উৎসাহ-উদ্দীপনা তৈরি হয়। বিশেষ করে আওয়ামী লীগের মনোনয়নবঞ্চিতরা নতুন করে আশায় বুক বাঁধেন।
তাই বিএনপির অনুপস্থিতিতে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতার সুযোগের সর্বোচ্চ ব্যবহার করছেন আওয়ামী লীগের মনোনয়নবঞ্চিতরা। ফলে প্রায় প্রতিটি আসনেই আওয়ামী লীগ মনোনীতদের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী হিসাবে আবির্ভূত হয়েছেন দলটির স্বতন্ত্র প্রার্থীরা।
দুপক্ষ জড়িয়ে পড়ছে সংঘাত-সংঘর্ষেও। এ অবস্থায় আওয়ামী লীগ হাইকমান্ড সারা দেশে দলীয় নেতাকর্মীদের মধ্যে স্থায়ী বিরোধের আশঙ্কা করছে। আওয়ামী লীগের একাধিক শীর্ষ নেতার সঙ্গে কথা বলে এ তথ্য জানা গেছে।
শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত সারা দেশে ৩২৪ জন স্বতন্ত্র প্রার্থীর মনোনয়নপত্র বৈধ ঘোষণা করেছে নির্বাচন কমিশন। আরও বেশকিছু বাতিল ঘোষিত স্বতন্ত্র প্রার্থী আপিলে তাদের প্রার্থিতা ফিরে পাওয়ার আশা করছেন। সেক্ষেত্রে স্বতন্ত্র প্রার্থীর সংখ্যা বাড়তে পারে।
জানা গেছে, এই স্বতন্ত্র প্রার্থীদের মধ্যে অধিকাংশই আওয়ামী লীগ নেতাকর্মী। তারা দীর্ঘদিন ধরে নির্বাচনের জন্য প্রস্তুতি নিয়েছেন। কিন্তু দলীয় মনোনয়ন তাদের ভাগ্যে জোটেনি।
এ অবস্থায় কর্মী-সমর্থকদের ভালোবাসা ও আনুগত্যকে পুঁজি করে তীব্র নির্বাচনি লড়াইয়ে অবতীর্ণ হয়েছেন তারা। ফলে প্রায় প্রতিটি আসনেই আওয়ামী লীগের বিভক্তি তীব্র আকার ধারণ করেছে। চলছে শক্তি প্রদর্শনের মহড়া। তারা সংঘাত ও সংঘর্ষেও জড়িয়ে পড়ছেন।
আওয়ামী লীগ মনোনীত নৌকার প্রার্থীদের দলীয় স্বতন্ত্র প্রার্থীর কর্মী-সমর্থকদের ওপর আগ্রাসী ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে দেখা যাচ্ছে। আবার আওয়ামী লীগের মনোনয়ন না পেয়ে স্বতন্ত্র নির্বাচনের ঘোষণা দেওয়া বর্তমান এমপিদের অনেকেই দলীয় প্রতিপক্ষের ওপর চড়াও হচ্ছেন।
বুধবার রাজশাহীর মোহনপুরে এ ধরনের ঘটনায় তিন আওয়ামী লীগ কর্মী আহত হয়েছেন। আহতরা দাবি করেছেন, তারা রাজশাহী-৩ (পবা-মোহনপুর) আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী আসাদুজ্জামানের সমর্থক ও কর্মী। এই আসনের বর্তমান এমপি ও স্বতন্ত্র প্রার্থী আয়েন উদ্দিনের সমর্থকরা তাদের ওপর হামলা চালিয়েছে।
এ ঘটনাকে তারা নির্বাচনকেন্দ্রিক হামলা বলে দাবি করেছেন। সকালে মোহনপুর উপজেলার বাকশিমুইল ইউনিয়নের সিন্দুরী গ্রামে এ ঘটনায় মাহবুব আলম, মুরাদুল ইসলাম ও এরশাদ আলী আহত হন। তারা খেতে কাজ করার সময় প্রতিপক্ষ তাদের চারদিক থেকে ঘিরে ধরে ব্যাপক মারধর করে। আহত এই তিনজনকে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।
এদিকে সংসদ নির্বাচনের তফশিল ঘোষণার পর থেকে সন্দ্বীপের বিভিন্ন ইউনিয়নে বর্তমান এমপি মাহফুজুর রহমান মিতার সমর্থকদের হাতে দলীয় প্রতিপক্ষরা হামলা ও মারধরের শিকার হচ্ছেন। গত সপ্তাহে পৌরসভার ৮নং ওয়ার্ডের লোকমানের ছেলে জনিকে বেদম পিটিয়েছে ছাত্রলীগ ও যুবলীগ নামধারী সন্ত্রাসীরা।
এছাড়া পৌরসভার ৯ নম্বর ওয়ার্ডের আবুল কাশেমের ছেলে জাফরকে মারধর করে সন্দ্বীপ থেকে চলে যাওয়ার হুমকি দেওয়া হয়েছে। একই ওয়ার্ডের হুমায়ুনের বাড়িতে হামলা ও তার ছেলে জাহিদের ওপর হামলা চালিয়েছে যুবলীগ নামধারী স্থানীয় সন্ত্রাসীরা। তারা জাহিদকে হুমকি দিয়ে বলেছে, নৌকা মার্কার বাইরে গেলে সন্দ্বীপ থেকে চলে যেতে হবে।
শনিবার রহমতপুর ৫নং ওয়ার্ডের লালখারগো এলাকার কুদ্দুস মিয়ার ওপর হামলা চালিয়েছে সন্ত্রাসীরা। পৌরসভার ৯ নম্বর ওয়ার্ডের মাকসুদের ছেলে রাফিকে মারধর করেছে। বৃহস্পতিবার মুছাপুর ৩ নম্বর ওয়ার্ডের কালি মাঝির বাড়িতে হামলা ও ককটেল বিস্ফোরণ ঘটিয়ে আতঙ্ক সৃষ্টি করেছে একদল সন্ত্রাসী। এ সময় তারা নৌকা মার্কার স্লোগান দিয়ে উল্লাস প্রকাশ করে। এরা বর্তমান এমপি ও আওয়ামী লীগের প্রার্থী মিতার লোক বলে জানা গেছে।
সন্দ্বীপের সন্ত্রাসী ও কিশোর গ্যাং লিডার হিসাবে পরিচিত সোহাগ সিকদার এবং জিকোর নেতৃত্বে একদল সন্ত্রাসী স্থানীয় ফয়েজ উল্লার ছেলে পারভেজের ওপর হামলা চালিয়ে তাকে বেদম মারধর করেছে। তারা অস্ত্রের মুখে পারভেজকে ৩ দিনের মধ্যে সন্দ্বীপ ছেড়ে চট্টগ্রাম চলে যাওয়ার হুমকি দিয়েছে। অন্যথা হলে তার লাশ আজিমপুর এলাকার বঙ্গোপসাগরে ভাসবে বলে আলটিমেটাম দিয়েছে এই সন্ত্রাসীরা।
এছাড়া মাইট ভাঙ্গা ইউনিয়নের ২ নম্বর ওয়ার্ডের বীর মুক্তিযোদ্ধা হুমায়ুন কবিরের ছেলে ইউনিয়ন যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক মুন্নার ওপর হামলা হয়েছে। এ সময় ওই এলাকায় গুলি ও ককেটেল বিস্ফোরণ ঘটিয়ে উল্লাস প্রকাশ করে সন্ত্রাসীরা। স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরা বলেছেন, শিবেরহাট এলাকার যুবলীগ নামধারী সমিরের নেতৃত্বে এ ঘটনা ঘটেছে। এই সমীর বর্তমান সংসদ-সদস্য মাহফুজুর রহমান মিতার লোক।
শুধু রাজশাহী ও চট্টগ্রামই নয়, আওয়ামী লীগের তীব্র দ্বন্দ্ব-কোন্দলের এই চিত্র এখন সারা দেশেই বিরাজ করছে। ফরিদপুরে আওয়ামী লীগ সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও দল মনোনীত প্রার্থী কাজী জাফর উল্যাহ এবং বর্তমান এমপি যুবলীগ নেতা মজিবুর রহমান চৌধুরী নিক্সনের দ্বন্দ্ব পুরোনো। নিক্সন চৌধুরী এবারও স্বতন্ত্র নির্বাচন করছেন।
চট্টগ্রাম-১২ আসনের সংসদ-সদস্য সামশুল হক চৌধুরী দলীয় মনোনয়নবঞ্চিত হয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসাবে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। এ আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী দলের চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলার সভাপতি মোতাহেরুল ইসলাম চৌধুরী। হুইপ সামশুল হক চৌধুরী ইতোমধ্যে আচরণবিধি লঙ্ঘন করে আলোচনার জন্ম দিয়েছেন।
এখানে দুপক্ষ এখন মুখোমুখি অবস্থানে। বরিশাল সদরে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পাওয়া বর্তমান সংসদ-সদস্য, পানিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী জাহিদ ফারুক ও স্বতন্ত্র প্রার্থী সাবেক সিটি মেয়র সাদিক আবদুল্লাহর দ্বন্দ্ব জাতীয় সংসদ নির্বাচনের এ সময়ে আরও তীব্র আকার ধারণ করেছে। সেখানে বিরাজ করছে টানটান উত্তেজনা।
আওয়ামী লীগ নেতারা বলেছেন, দেশে-বিদেশে জাতীয় নির্বাচন গ্রহণযোগ্য করার জন্য দলীয় নেতাকর্মীদের এইভাবে মাঠে নামিয়ে দেওয়ার ফল ভালো হবে না। কারণ এতে দ্বন্দ্ব স্থায়ী আকারে রূপ নেবে।
কারণ বিএনপির অনুপস্থিতিতে নির্বাচনে জয়ের জন্য আওয়ামী লীগের দুপক্ষই মরিয়া হয়ে মাঠে রয়েছে। এখানে আওয়ামী লীগের প্রার্থী কিংবা নৌকার জয়ের বিষয়টি মুখ্য নয়, বড় হয়ে উঠেছে ব্যক্তি। তাই দল মনোনীত অনেকেই আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতাদের দ্বারে দ্বারে ঘুরে স্বতন্ত্র প্রার্থীদের সঙ্গে আপসরফার চেষ্টা করছেন। তারা চাচ্ছেন স্বতন্ত্র প্রার্থীরা নির্বাচনি লড়াই থেকে সরে দাঁড়াক। এর ফলে তাদের (আওয়ামী লীগের প্রার্থীদের) জয়ের পথ সুগম হবে।
জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য আবদুর রহমান বলেন, দলীয় নেতাকর্মীদের স্বতন্ত্র নির্বাচন করার এই ঘোষণা দিয়েছেন স্বয়ং সভাপতি শেখ হাসিনা। নির্বাচনকে গ্রহণযোগ্য ও উৎসবমুখর করতেই তিনি এ সুযোগ করে দিয়েছেন। কিছু সমস্যা হলেও এটা মানতে হবে।
জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি ও রাজশাহী-৬ আসনের স্বতন্ত্র প্রার্থী রাইহানুল হক বলেন, দলের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসাবে নির্বাচন করতে গিয়ে প্রতিনিয়ত প্রতিবন্ধকতার শিকার হচ্ছি। আমার সমর্থক, জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক, ইউপি চেয়ারম্যান মেরাজুল ইসলাম মেরাজকে হুমকি দেওয়া হচ্ছে। আমি জীবন নিয়ে শঙ্কিত। আমার কর্মীদেরও মারধর করা হচ্ছে।