নভেম্বর ১৩, ২০২৪ ৬:৩৯ পূর্বাহ্ণ
ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম) নিয়ে বিপদে পড়েছে নির্বাচন কমিশন। পাঁচ মাস ধরে ঝুলে আছে ‘নির্বাচনব্যবস্থায় তথ্যপ্রযুক্তি প্রয়োগের লক্ষ্যে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম) ব্যবহার’ প্রকল্পের মেয়াদ বৃদ্ধির প্রস্তাব।
ইতোমধ্যে প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হলেও সেনাবাহিনীর কাছ থেকে এগুলো বুঝে নিচ্ছে না কমিশন। সেই সঙ্গে বর্তমানে কমিশন না থাকায় ইভিএম নিয়ে কোনো সিদ্ধান্তও নেওয়া যাচ্ছে না। এ পরিপ্রেক্ষিতে মেয়াদ বাড়বে কি না-সিদ্ধান্ত চেয়ে ২৯ অক্টোবর পরিকল্পনা কমিশনকে চিঠি দেয় নির্বাচন কমিশন সচিবালয়।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে পরিকল্পনা কমিশনের দায়িত্বশীল একাধিক কর্মকর্তা বলেন, এ বিষয়ে এখনো সিদ্ধান্ত হয়নি। কেননা প্রকল্পটি বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে (এডিপি) অন্তর্ভুক্ত নেই। তাই এটির বিষয়ে যে কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে ব্যাপক আলাপ-আলোচনা প্রয়োজন। সেই সঙ্গে পরিকল্পনা উপদেষ্টার মতামত নিতে হবে। তার ভিত্তিতে পরবর্তী কার্যক্রম গ্রহণ করা হবে।
সাবেক পরিকল্পনা সচিব মামুন-আল-রশীদ মঙ্গলবার বলেন, এ বিষয়ে চিঠি পাওয়ার পর অবশ্যই পরিকল্পনা কমিশনের উচিত ছিল নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে সভা করা। তাদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করেই একটা সিদ্ধান্ত দেওয়া প্রয়োজন ছিল। যেহেতু প্রকল্পটি চলতি অর্থবছরের এডিপিতে সমাপ্ত করার বাধ্যবাধকতা ছিল, সেহেতু নির্বাচন কমিশনের উচিত ছিল বাস্তবায়ন শেষ করা। একান্তই শেষ করতে না পারার কারণে পর্যাপ্ত সময় থাকতেই মেয়াদ বাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়া উচিত ছিল। এ ক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশনের দায়িত্তহীনতা স্পষ্টত দেখা যাচ্ছে।
পরিকল্পনা কমিশনকে দেওয়া চিঠিতে নির্বাচন কমিশন বলেছে, ব্যয় বৃদ্ধি ছাড়া এক বছর মেয়াদ বাড়ানোর জন্য ২৬ জুন পরিকল্পনা কমিশনকে একটি চিঠি দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু এখন পর্যন্ত কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়নি।
এদিকে ৩০ জুন প্রকল্পটির মেয়াদ শেষ হয়ে গেছে। চলতি অর্থবছরের এডিপিতে প্রকল্পটি সমাপ্ত প্রকল্পের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। এ প্রকল্পের আওতায় দেড় লাখ ইভিএম কেনা হয়েছে। এসব ইভিএম বাংলাদশ মেশিন টুলস ফ্যাক্টরি ও বিভিন্ন জেলায় ভাড়া করা বাড়িতে রাখা হয়েছে। ইভিএমগুলো বাংলাদেশ সেনাবাহিনী প্রকল্প দপ্তরকে বুঝিয়ে দেওয়ার কথা থাকলেও প্রকল্পের মেয়াদ না থাকায় এগুলো বুঝে নেওয়া যাচ্ছে না। এছাড়া প্রকল্পের আওতায় কিছু অডিট আপত্তি আছে, যা প্রকল্পের মেয়াদের মধ্যেই নিষ্পত্তি করা প্রয়োজন। পাশাপাশি কিছু ইভিএম নষ্ট অবস্থায় আছে। কিছু আছে মেরামতযোগ্য। অন্যদিকে, কিছু ইভিএম অচল ও অকেজো অবস্থায় রয়েছে। বর্তমানে কমিশন (নির্বাচন কমিশন) না থাকায় এসব ইভিএম-এর বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া যাচ্ছে না। ইভিএম-এর সোর্স কোড, ক্রিডেনশিয়াল সফটওয়্যারসহ বিভিন্ন মালামাল গ্রহণের জন্য নির্বাচন কমিশনের কর্মকর্তা বা কর্মচারীদের প্রশিক্ষণ দেওয়া প্রয়োজন। প্রকল্পের আওতায় অনিয়মিত শ্রমিকদের মজুরি বাবদ কিছু বিল পরিশোধ বাকি আছে, যা পরিশোধ করা প্রয়োজন। এসব কারণে ২০২৫ সালের জুন পর্যন্ত এক বছর মেয়াদ বাড়ানো দরকার উল্লেখ করে চিঠিতে আরও বলা হয়, প্রকল্প থেকে ১১৬ কোটি টাকা বেঁচে গেছে। বর্ধিত মেয়াদের মধ্যে এ অর্থ ব্যয় করে প্রকল্পটি শেষ করা সম্ভব হবে।
নির্বাচন কমিশন সূত্র জানায়, ইভিএম-এর মাধ্যমে ২৫ মার্চ পর্যন্ত ১ হাজার ৩৯৪টি নির্বাচন পরিচালনা করা হয়েছে। এর মধ্যে জাতীয় সংসদের ৩১ আসনে (উপনির্বাচনসহ), জেলা পরিষদ ও উপনির্বাচন করা হয়েছে ৬৬টি এবং ২৪টি সিটি করপোরেশেন নির্বাচন করা হয়েছে। আরও আছে ২৩৫টি পৌরসভা নির্বাচন, ৩৪টি উপজেলা নির্বাচন এবং ১ হাজার ৪টি ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহার করা হয়েছে। ইভিএম প্রকল্পের মোট ব্যয় ধরা হয়েছে ৩ হাজার ৮২৫ কোটি ৩৪ লাখ টাকা। ২৯ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত এ প্রকল্পের আওতায় খরচ হয়েছে ৩ হাজার ৬৭৩ কোটি ১৯ লাখ টাকা। ডিপিপি (উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাব) অনুসারে আর্থিক ৯৬ দশমিক ০২ এবং বাস্তব অগ্রগতি হয়েছে ৯৬ দশমিক ৪৮ শতাংশ। ইতোমধ্যে ১ লাখ ৫০ হাজার ইভিএম সেট ও আনুষঙ্গিক যন্ত্রপাতি, ৬টি সফটওয়্যার, ৫টি যানবাহন এবং ৯ হাজার ২০০টি রেক কেনা হয়েছে। এছাড়া ইভিএম রক্ষণাবেক্ষণের জন্য দুটি চুক্তির আওতায় ২০১৯ সালের অক্টোবর থেকে ২০২২ সালের জুন পর্যন্ত ৩৯ হাজার ৯৯৯ সেট মেরামত বা রক্ষণাবেক্ষণ করা হয়। পাশাপাশি বিএমটিএফ (বাংলাদেশ মেশিন টুলস ফ্যাক্টরি লিমিটেড) প্রয়োজন অনুযায়ী ইভিএম রক্ষণাবেক্ষণে সহায়তা দেয়। জেলা পর্যায়ে ভাড়া করা গুদাম এবং বিএমটিএফ-এর ওয়্যারহাউজে এসব রাখা হয়। প্রকল্পের আওতায় ৩ হাজার ২৪৫ জন কর্মকর্তা-কর্মচারীকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। প্রতিটি নির্বাচনের আগে সচেতনতা বাড়াতে বিভিন্ন মাধ্যমে প্রচার-প্রচারণা চালানো হয়।
সূত্র জানায়, সম্প্রতি অনুষ্ঠিত প্রকল্প স্টিয়ারিং কমিটির (পিএসসি) সভায় প্রকল্প পরিচালক সৈয়দ রাকিবুল হাসান প্রকল্পের ব্যয় বৃদ্ধি ছাড়া ১ বছর মেয়াদ বাড়ানোর যৌক্তিকতা তুলে ধরেন। তিনি জানান, দেড় কোটি ইভিএম-এর মধ্যে প্রায় ৬৫ হাজার সেট মাঠ পর্যায়ে রয়েছে। এছাড়া ৮৪ হাজার সেট ইভিএম বাংলাদেশ মেশিন ট্যুলস ফ্যাস্টরিতে এবং নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ে প্রায় ১ হাজার সেট সংরক্ষিত আছে। ২৬ জুন পর্যন্ত ইভিএম-এর মাধ্যমে নির্বাচন পরিচালনা করা হবে। এ নির্বাচন শেষে অতি স্বল্পসময়ে বিপুলসংখ্যক মূল্যবান ইভিএম ও আনুষঙ্গিক যন্ত্রপাতি যথাযথভাবে প্রকল্পের পক্ষে হস্তান্তর করা দুরূহ। জেলা ও উপজেলা পর্যায়ের মধ্যে ৪১টি জেলায় ভাড়া করা গোডাউন, বাকি জেলা-উপজেলায় বিভিন্ন স্কুল ও কলেজে সাময়িকভাবে ইভিএম সংরক্ষণ হয়েছে। ৩০ জুন মেয়াদ শেষ হলেও (ইতোমধ্যেই শেষ হয়েছে) পর্যাপ্ত স্থান, সঠিক সংরক্ষণ ও রক্ষণাবেক্ষণ এবং প্রয়োজনীয় জনবলের অভাবে স্পর্শকাতর ও মূল্যবান সিস্টেমসহ সব ইভিএম-এর আয়ুষ্কাল শেষ হওয়ার আগেই বিনষ্ট হওয়ার ঝুঁকি আছে। ফলে বাস্তবতার পরিপ্রেক্ষিতে ইভিএম ব্যবহার, সংরক্ষণ এবং প্রকল্পের ফলাফল টেকসই করতে মেয়াদ বৃদ্ধি প্রয়োজন।
নির্বাচন কমিশন সচিব শফিউল আজিমের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত পিএসসি সভায় জানানো হয়, ইভিএম প্রকল্পটি ২০১৮ সালে শুরু হয়। ২০২৩ সালের ২২ জুন প্রকল্পটির প্রথম সংশোধনের মাধ্যমে ২০২৪ সালের জুন পর্যন্ত মেয়াদ এক বছর বাড়ানো হয়। সেসময় প্রকল্পের মোট ব্যয় না বাড়লেও প্রকল্পটি ২০২৪ সালের জুনের মধ্যে সমাপ্তির তালিকায় থাকায় চলতি অর্থবছরের এডিপিতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। কিন্তু প্রকল্পের মেয়াদ বৃদ্ধি বা সংশোধনের জন্য এডিপিতে অন্তর্ভুক্ত করা দরকার। এছাড়া মেয়াদ বৃদ্ধির জন্য তিন মাস আগে প্রস্তাব প্রক্রিয়াকরণ শুরু করা প্রয়োজন।