মন্ত্রী হবেন! নয়তো সংসদ-সদস্য। তাতে পালটে যাবে দল ও নিজের ভাগ্য। এমন স্বপ্ন নিয়ে দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনের আগে এবারও মাঠে নেমেছিল ‘কিংস পার্টি’ খ্যাত কয়েকটি রাজনৈতিক দল। ঘোষণা দিয়েই অনেকটা ঝড়ের গতিতে রাজনীতিতে উত্থান ঘটে তাদের। নানা মহলে এসব দল নিয়ে বেশ আলোচনাও ছিল। তবে বেশি দিন স্থায়ী হয়নি। ৭ জানুয়ারি নির্বাচনে কোনো আসনেই জয়ী হতে পারেনি। বরং এসব দলের প্রার্থীরা হারিয়েছেন জামানত। নির্বাচন-পরবর্তী সময়ে দলগুলো এখন অস্তিত্ব সংকটে। নেই কোনো কর্মকাণ্ডে কিংবা আলোচনায়ও। দিনের বেশির ভাগ সময়ই অফিসে তালা ঝুলে। নেই নেতাকর্মীদের পদচারণা। পর্দার আড়ালেই থাকছেন তারা। আগামী দিনের কর্মকাণ্ড নিয়েও নেতাকর্মীরা ধোঁয়াশায়। অনেকে আবার আগের দল বিএনপিতেও ফিরতে চান। তবে দলগুলোর নেতারা বলছেন ভিন্নকথা। তাদের দাবি-নির্বাচন ঘিরে গড়ে ওঠা রাজনৈতিক দলগুলো ‘কিংস পার্টি’ নয়। নির্বাচন শেষ, এখন তারা ধীরগতিতে সারা দেশে কমিটি গঠনে মনোযোগ দিয়েছেন। কিছুদিনের মধ্যেই আগামী নির্বাচনের প্রস্তুতি শুরু করবেন।
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগেই নির্বাচন কমিশনের নিবন্ধন পায় তৃণমূল বিএনপি, বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী আন্দোলন (বিএনএম) ও বাংলাদেশ সুপ্রিম পার্টি (বিএসপি)। এসব দল ‘কিংস পার্টি’ নামে পরিচিতি পায়। এছাড়াও বেশ কয়েকটি দল নিবন্ধনের প্রাথমিক যাচাই-বাছাইয়ে উত্তীর্ণ হয়েছিল। নিবন্ধন না পেলেও দলগুলো নির্বাচনের আগে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে সরব ছিল। এখন তাদেরও খুঁজে পাওয়া যায় না।
সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক বদিউল আলম মজুমদার বলেন, নির্বাচনের আগে এসব পার্টি উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে সৃষ্টি হয়েছে। সরকার বিরোধী দলগুলোকে ভেঙে এনে তাদের নিয়ে নির্বাচন করানোর চেষ্টা চালিয়েছে। এ ধরনের দলের কোনো উদ্দেশ্য, কর্মসূচি কিংবা নীতি-আদর্শ নেই। একটা উদ্দেশ্যসাধনের জন্য সৃষ্টি করলেও তাতে সফল হয়নি। এদের টিকে থাকার সম্ভাবনাও নেই।
এদিকে নিবন্ধন পাওয়ার পরপরই আলোচনায় আসে তৃণমূল বিএনপি, বিএনএম ও বিএসপি। রাজপথের বিরোধী দল বিএনপি নির্বাচন বয়কট করলে সরকারের কাছে কদর বাড়ে দলগুলোর। বড় অফিস নিয়ে অনেকটা ঢাকঢোল পিটিয়ে প্রচার-প্রচারণায় নামে এসব পার্টি। বিক্রি করে দলীয় মনোনয়নপত্রও। আসন নিয়ে সরকারের সঙ্গে দরকষাকষিও করেন নেতারা। ক্ষমতাসীনরা কয়েকটি আসনে ছাড় দিলেও নির্বাচনে ভরাডুবি ঘটে তাদের। কোনো আসনেই বিজয়ী হতে পারেননি কিংস পার্টির প্রার্থীরা। দু-একটি বাদে সব আসনেই জামানত হারিয়েছেন তারা। এমন ভরাডুবির কারণে শীর্ষনেতাদের ওপর ক্ষুব্ধ প্রার্থীরাও। নানা আশ্বাসেও সংসদ-সদস্য হওয়ার স্বপ্নভঙ্গ মেনে নিতে পারছেন তাদের অনেকেই। ক্ষোভপ্রকাশ করে কেউ কেউ বলছেন, অতীতেও জাতীয় নির্বাচন ঘিরে এমন কিংস পার্টির পতন ঘটেছে। এসব রাজনীতিরই খেলা। যোগ্য নেতৃত্ব সংকটের কারণেই দলগুলোর কোনো কর্মকাণ্ড নেই। এমনকি অনিশ্চিত পথে আর রাজনীতি করতে চান না তারা।
জানা যায়, দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তৃণমূল বিএনপি, বিএনএম ও বিএসপির ২৭০ জন প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। এর মধ্যে শুধু বিএনএম-এর দুজন প্রার্থী ছাড়া বাকি ২৬৮ জনের জামানত বাজেয়াপ্ত হয়। বেশির ভাগ প্রার্থী ভোট পেয়েছেন চার অঙ্কের ঘরে। কেউ কেউ ৩ সংখ্যাও অতিক্রম করতে পারেননি। কোনো কোনো কেন্দ্রে তাদের ভোটের ফল ছিল শূন্য। বিরোধী দল হওয়ার স্বপ্নে বিভোর ‘তৃণমূল বিএনপি’ ও ‘বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী আন্দোলন-বিএনএম’-এর কেউই জিততে পারেননি। এমনকি হেভিওয়েট নেতা হিসাবে পরিচিতরাও জামানত খুইয়েছেন। জাতীয় সংসদে ‘বিরোধী দল’ হওয়ার ঘোষণা দিয়ে তৃণমূল বিএনপি ২৩০ আসনে আর বিএনএম ৮২ আসনে মনোনয়নপত্র জমা দেয়। এর মধ্যে তৃণমূল বিএনপির ১৩৩ এবং বিএনএম দলের ৫৪টি মনোনয়নপত্র বৈধ করে নির্বাচন কমিশন।
রাজধানীর তোপখানা রোডে মেহেরবা প্লাজার ১৬ তলায় তৃণমূল বিএনপির প্রধান কার্যালয়। রোববার বেলা ১২টার দিকে গিয়ে দেখা যায় পুরো অফিস ফাঁকা। নেই কোনো নেতাকর্মী। দরজা খোলা থাকলেও ৩০ মিনিট গেটে অবস্থান করেও কাউকে পাওয়া যায়নি। ওই ভবনের কয়েকজন বলেন, নির্বাচনের আগে মনোনয়নপ্রত্যাশী ও নেতাকর্মীদের চাপে অফিসে ঢুকতে কষ্ট হতো। লিফট ও সিঁড়িতে জায়গা হতো না। প্রতিদিন জনসমাগম হতো। ভোটের পর পুরো চিত্র পালটে গেছে। এখন আর কেউ আসেন না। পার্টির নেতাকর্মীরাও আসেন না। মাঝেমধ্যে দু-একজন এলেও ঘণ্টাখানে থেকে চলে যান। ভোটের পর কোনো মিছিল-মিটিং চোখে পড়েনি।
তৃণমূল বিএনপির মহাসচিব তৈমূর আলম খন্দকার বলেন, আমরা এখন জেলা, পৌর এলাকা ও সিটি করপোরেশনের কমিটি গঠনে জোর দিচ্ছি। আগে আমাদের দলকে একটা অবস্থানে নিয়ে তারপর কর্মসূচি ঘোষণা করব। তবে আমাদের অবস্থান পরিষ্কার-সরকারের যে কোনো অত্যাচার, অবিচারের বিরুদ্ধে সমালোচনা কিংবা আন্দোলন করার দরকার, সেটা আমরা করব। মূল কাজ হলো এ মুহূর্তে আমরা দল গুছানোর কাজে ব্যস্ত আছি। আমরা হারিয়ে যাইনি।
বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী আন্দোলনেরও (বিএনএম) একই অবস্থা। নির্বাচনের আগে গুলশানের প্লাটিনাম মার্কেটের তৃতীয় তলায় বড়সড় অফিস নিলেও বর্তমানে তা ছেড়ে দিয়েছেন নেতারা। কার্যালয়ের গেটে ঝুলছে দুটি তালা। ভেতরের আসবাবপত্র সরানো হয়েছে অনেক আগেই। এখন শুধু ময়লা-আবর্জনার স্তূপ জমে আছে। ভবনের কয়েকজন ব্যবসায়ী বলেন, ভোটের পর বিএনএম-এর অফিসে নেতাকর্মীদের তেমন একটা দেখা যায়নি। এখন হঠাৎ করে অফিসও ছেড়ে দিয়েছে।
বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের (বিএনএম) মহাসচিব মো. শাহজাহান বলেন, আমরা গুলশানের অফিস ছেড়ে দিচ্ছি। নতুন একটা অফিস দেখছি। নির্বাচন-পরবর্তী সব পার্টির অফিসই আগের মতো জমজমাট থাকে না। নেতাকর্মীরা নিজ নিজ এলাকায় আছে। আমরা সাংগঠনিক কর্মকাণ্ড জোরদার করতে কমিটি করে দিয়েছি। সব জেলা, মহানগর ও বিভাগে ১০/১৫ মার্চ তাদের কার্যক্রম শেষ হলে আমরা নতুন করে মাঠে নামব।
নির্বাচনের আগে ঢাকাকেন্দ্রিক যে সমাগম ছিল, এটা তো এখন প্রত্যেকে নিজ নিজ এলাকায় কাজ করছেন। সুবিধাজনক সময়ে আমাদের দলীয় কার্যক্রম চালিয়ে যাব। তিনি বলেন, আমরা কিংস পার্টি নই। সরকারের সঙ্গে কোনো সমাঝোতা নেই, আঁতাতও হয়নি। এমনটা হলে তো আমরা সংসদে থাকতাম। এখন পর্যন্ত আমরা সরকারের সঙ্গে দেখা করিনি। লিয়াজোঁও করিনি। বরং সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন না হওয়ায় আমরা আমাদের ন্যায্য আসনগুলোও পাইনি।
এদিকে বাংলাদেশ সুপ্রিম পার্টির অফিস মিরপুর-১-এর শাহ্ আলীবাগে। কার্যালয়ের সামনে ব্যানার থাকলেও দিনের বেশির ভাগ সময় গেট বন্ধ থাকে। নেতাকর্মীদের আনাগোনাও নেই সেখানে। স্থানীয়রাও জানেন না এখানে একটি রাজনৈতিক দলের অফিস আছে। অভিন্ন তথ্য দিয়ে তারা জানান, মাঝেমধ্যে ধর্মীয় অনুষ্ঠান হয় সেখানে। যখন অনুষ্ঠান হয়, তখনই লোকজন আসেন, আবার চলেও যান। তবে কোনো রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড স্থানীয়দের চোখে পড়েনি।
বাংলাদেশ সুপ্রিম পার্টির (বিএসপি) ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব বীর মুক্তিযোদ্ধা অ্যাডভোকেট আব্দুল আজিজ সরকার বলেন, আমাদের কমিটি গঠনের কাজ চলছে। এ কারণে নেতারা যার যার জেলায় অবস্থান করছেন। সামনে উপজেলা ও ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন-এসব নিয়ে আমাদের কার্যক্রম চলবে। বর্তমানে ঢাকার অফিসে লোকজন কম থাকে। তবে অফিস বন্ধ থাকে না। নির্বাচনের সময় ঢাকার বাইরের নেতারা আসতেন, তাদের নিয়ে নিয়মিত মিটিং করতাম। যেহেতু নির্বাচন শেষ, এ কারণে আমরা ঢাকার বাইরে গিয়ে কার্যক্রম চালাচ্ছি।