মৃত্যু ঘনিয়ে আসার ব্যাপারে যেন জানতেন ফিলিস্তিনি স্বাধীনতাকামী সংগঠন হামাসের প্রধান ইসমাইল হানিয়া। তাই মৃত্যুর কিছু সময় আগে ইসমাইল হানিয়া বলেছিলেন, যদি এক নেতা চলে যায় তবে আরেকজনের উত্থান ঘটবে।
গত মঙ্গলবার (৩০ জুলাই) ইরানের রাজধানী তেহরানে যান ইসমাইল হানিয়া। দেশটির নতুন প্রেসিডেন্ট মাসুদ পেজেশকিনের শপথ অনুষ্ঠানে অংশ নেন তিনি। এরপর ওইদিন স্থানীয় সময় রাত ২টা নাগাদ হত্যার শিকার হন হামাসের রাজনৈতিক প্রধান হানিয়া। এ সময় তার এক দেহরক্ষীও নিহত হন।
ইরানের তেহরানে অতিথি ভবনে নিহত হওয়ার কয়েক ঘণ্টা আগে হামাস প্রধান কথা বলেছিলেন ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলি খামেনির সঙ্গে। সেখানে জীবন, মৃত্যু, অমরত্ব এবং প্রতিরোধ সম্পর্কে পবিত্র কোরআনের এক আয়াত পাঠ করে হানিয়া বলেছিলেন, ‘আল্লাহ জীবন দান করেন এবং মৃত্যু ঘটান। তিনি সবকিছু সম্পর্কে অবগত। যদি এক নেতা চলে যায় তবে আরেকজনের উত্থান ঘটবে।’
হানিয়া খামেনির সঙ্গে কথা বলার সময় টেলিভিশনে প্রচারিত এই মন্তব্যটি বিশেষভাবে ধারণ করা হয়।
তার এই জীবন দর্শন হামাসের প্রতিষ্ঠাতা শেখ আহমেদ ইয়াসিনের দ্বারা প্রভাবিত। তিনি ইসরায়েলের বিরুদ্ধে জিহাদের পক্ষে ছিলেন। ২০০৪ সালে ইয়াসিন ইসরায়েলের হাতে নিহত হলেও সামরিক শক্তি হিসেবে হামাস ক্রমেই শক্তিশালী হতে থাকে।
১৯৯৪ সালে গাজায় বার্তা সংস্থা রয়টার্সকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে হানিয়া বলেছিলেন, ইয়াসিন তাদের শিখিয়েছেন, ফিলিস্তিনিরা কেবল সংগ্রামের মাধ্যমেই তাদের দখলকৃত মাতৃভূমি পুনরুদ্ধার করতে পারে।
হানিয়া জানিয়েছিলেন, তিনি শেখ ইয়াসিনের কাছ থেকে শিখেছেন ইসলামের প্রতি ভালোবাসা এবং এই ইসলামের জন্য আত্মত্যাগ এবং অত্যাচারী ও স্বৈরাচারীদের কাছে নতজানু না হওয়া।
ফিলিস্তিনি সমর্থকদের কাছে হানিয়া এবং হামাস নেতারা মানেই ইসরায়েলি দখলদারিত্ব থেকে মুক্তির পথ।
আন্তর্জাতিক কূটনীতিতে হানিয়া একজন বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব হয়ে ওঠেন। গত এপ্রিলে ইসরায়েলি বিমান হামলায় তার তিন ছেলে ও চার নাতি-নাতনি এবং অন্তত ৬০ জন আত্মীয় নিহত হয়।
সে সময় হানিয়া বলেছিলেন, আমার সন্তানদের রক্তের চেয়ে ফিলিস্তিনি জনগণের শিশুদের রক্ত আমার কাছে বেশি গুরুত্বের। ফিলিস্তিনের সকল শহীদই আমার সন্তান।
তিনি আরো বলেছিলেন, শহীদদের রক্ত এবং আহতদের কষ্টের বিনিময়ে আমরা ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখি। তাদের এই ত্যাগের বিনিময়েই আমরা আমাদের জনগণের জন্য স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখি।
২০১৭ সালে হামাসের শীর্ষ পদে নিয়োগ পাওয়া হানিয়া অবরুদ্ধ গাজায় ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা এড়িয়ে তুরস্ক ও কাতারের রাজধানী দোহা যান। তাকে যুদ্ধবিরতি আলোচনায় মধ্যস্থতাকারী হিসেবে কাজ করতে বা হামাসের মিত্র ইরানের সঙ্গে কথা বলার সুযোগ করে দেওয়া হয়।
গত ৭ অক্টোবর ইসরায়েলে হামাস যোদ্ধাদের হামলায় এক হাজার ২০০ মানুষ নিহত ও ২৫০ জনকে জিম্মি করার পর হানিয়া আরব দেশগুলোর উদ্দেশে বলেছিলেন, তারা (আরব দেশগুলো) ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার যে চুক্তি স্বাক্ষর করেছে, তাতে এই সংঘাতের অবসান ঘটাবে না।
ইসরায়েলের প্রতিক্রিয়া ছিল একটি সামরিক অভিযান, সেই অভিযানে এখন পর্যন্ত গাজার অভ্যন্তরে প্রায় ৪০,০০০ মানুষকে হত্যা করেছে এবং ছিটমহলের বেশিরভাগ অংশে বোমা ফেলে ধ্বংসস্তূপে পরিণত করেছে।
কাতার বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিলিস্তিন বিষয়ক বিশেষজ্ঞ আদিব জিয়াদেহ বলেন, হামাস একটি আদর্শ এবং হানিয়াকে হত্যা করে দলটিকে শেষ করা যাবে না।
তিনি বলেন, যখনই হামাস একজন নেতাকে হারায়, আরেকজন নেতা আসে, কখনো তার কর্মক্ষমতা ও হামাসের নীতি পূরণে আরো শক্তিশালী হয়।
গত মাসে গাজায় ইসরায়েলি বিমান হামলায় ৭ অক্টোবরের হামলার অন্যতম পরিকল্পনাকারী মোহাম্মদ দেইফ নিহত হয়েছেন বলে বৃহস্পতিবার জানিয়েছে ইসরায়েল।
হামাসের সামরিক শাখার অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা সালেহ আল-আউরিও ২০২৪ সালের জানুয়ারিতে বৈরুতের দক্ষিণ শহরতলিতে ইসরায়েলি ড্রোন হামলায় নিহত হন।
সূত্র: রয়টার্স, টিআরটি ওয়ার্ল্ড