সেপ্টেম্বর ২৩, ২০২৪ ৭:০৪ পূর্বাহ্ণ
জম্মু-কাশ্মীর বিধানসভা নির্বাচনের প্রথম ধাপে ৯০টি আসনের মধ্যে ২৪টিতে ভোটগ্রহণ শুরু হয়েছে। ভারতে লোকসভা নির্বাচনের পর এই প্রথম কোনো বড় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হচ্ছে। এক দশকের বেশি সময় পর ভারতের এই অঞ্চলে ভোট দিচ্ছেন ভোটাররা। কেননা, ২০১৯ সালে এই রাজ্যের বিশেষ মর্যাদা প্রদানকারী ৩৭০ অনুচ্ছেদ অপসরণের পর এটিই প্রথম নির্বাচন।
এবারের নির্বাচন ভারতের ক্ষমতাসীন দল বিজেপির জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ। কেননা, ইতিহাস বলে বিজেপি কোনো দিনই কাশ্মীর উপত্যকার কোনো বিধানসভা আসনে জেতেনি।
এই ভ্যালিটির মোট ৪৭টি বিধানসভা আসনের মধ্যে তারা এবার মেরেকেটে প্রার্থী দিয়েছে মাত্র ১৯টিতে– আর শ্রীনগরের একটি আসন ছাড়া বিজেপি যে কোথাও সেভাবে লড়াইতেই নেই, সেটাও সবারই জানা।
এমনকি মাসচারেক আগে ভারতে যখন সংসদীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হল, তখন কাশ্মীর উপত্যকার তিনটি আসনের কোনোটিতেই বিজেপি প্রার্থী পর্যন্ত দেয়নি।
সোজা কথায়, নির্বাচনি হিসেবে-নিকেশের অঙ্কে কাশ্মীর ভ্যালি তাদের জন্য একরকম ‘খরচের খাতা’তেই ধরা মোদি!
তাহলে বিজেপির সর্বোচ্চ নেতা ও প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এত ঝুঁকি নিয়ে শ্রীনগরে ভোটের জন্য জনসভা করতে এলেন কেন? কী বার্তা দেওয়া তার লক্ষ্য ছিল?
এর উত্তর হল, কাশ্মীরে বিজেপি কোনও আসন না-ই পেতে পারে, কিন্তু লাগোয়া জম্মুতে সবচেয়ে বেশি আসন জিতে জম্মু ও কাশ্মীর বিধানসভায় এককভাবে বৃহত্তম দল তারা হতেই পারে।
সে ক্ষেত্রে কাশ্মীর উপত্যকার আরও ছোটখাটো কিছু দল ও স্বতন্ত্র প্রার্থীদের সমর্থন নিয়ে তারা সরকার গড়ার চেষ্টা চালাবে – রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা এখন থেকেই সে কথা জানাচ্ছেন।
প্রধানমন্ত্রী মোদি শ্রীনগরে এসে সম্ভবত সেটাই বুঝিয়ে গেলেন, যে কাশ্মীরে তাদের প্রভাব সীমিত হতে পারে, তবে রাজ্যে ক্ষমতা দখলের ব্যাপারে বিজেপি খুবই সিরিয়াস!
মোদি এবার যে রাজনৈতিক ফমুর্লার এই রাজ্যে সরকার গড়ার স্বপ্ন দেখছে, সেটাকে অনেক পর্যবেক্ষকই বিজেপির ‘মিশন কাশ্মীর’ বলে বর্ণনা করছেন – আর তার অনেকগুলো কারণও আছে।
প্রসঙ্গত, কাশ্মীরের অনন্তনাগ আসনে বিজেপির প্রার্থী ও দলের পুরনো নেতা রফিক ওয়ানি দিনকয়েক আগে দিল্লির একটি খবরের কাগজের সঙ্গে কথা বলার সময় চমকপ্রদ এক ‘স্বীকারোক্তি’ করেছিলেন।
ভ্যালিতে একটিও আসন না-পেলে বিজেপি কীভাবে রাজ্যে সরকার গড়বে, এই প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেই ফেলেন, ঘাবড়ানোর কিছু নেই – এখানেও অনেক লোকই আসলে ‘আমাদের’!
তারপর একে একে নাম ধরে ধরে তিনি বলতে থাকেন, যেমন ধরুন ইঞ্জিনিয়ার রশিদ আমাদের, আলতাফ বুখারিও তাই, সাজ্জাদ লোন তো কবে থেকেই আমাদের, গুলাম নবি আজাদও আমাদেরই!
সোজা কথায়, বিজেপির আসন সংখ্যা কম পড়লে এই সব ছোটখাটো আঞ্চলিক দলের নেতারা বা বিভিন্ন আসনে জয়ী স্বতন্ত্র প্রার্থীরাই তাদের উতরে দেবেন – এটাই ছিল উপত্যকায় বিজেপির এই প্রবীণ নেতার দাবি।
প্রসঙ্গত, বারামুলার বর্তমান এমপি ইঞ্জিনিয়ার রশিদ আওয়ামী ইত্তেহাদ পার্টির প্রধান। আলতাফ বুখারির দলের নাম আপনি পার্টি, এছাড়া গুলাম নবি আজাদ ও সাজ্জাদ লোন যথাক্রমে ডেমোক্র্যাটিক প্রোগ্রেস আজাদ পার্টি ও পিপলস কনফারেন্সের সর্বোচ্চ নেতা।
সন্ত্রাসবাদে অর্থায়নের অভিযোগ তিহার জেলে আটক ইঞ্জিনিয়ার রশিদ দিনকয়েক আগে যেভাবে জামিন পেয়েছেন এবং ভোটের প্রচারে নেমেছেন, তার পেছনেও অনেকে বিজেপিরই হাত দেখছেন।
আসলে জম্মু থেকে অন্তত গোটা তিরিশেক আসন জিতে বিধানসভায় একক গরিষ্ঠ দল হওয়া – এবং তারপর কাশ্মীরের ছোট আঞ্চলিক দলগুলো ও স্বতন্ত্র প্রার্থীদের সহায়তায় সরকার গঠন – এটাকেই এই নির্বাচনে বিজেপির ‘ব্লু প্রিন্ট’ বলে অভিহিত করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও সেফোলজিস্ট অমিতাভ তিওয়ারি।
তবে কাশ্মীর ভ্যালিতে ছোটখাটো আঞ্চলিক দলগুলিকে সফল হতে হলে ও বেশ কয়েকটি আসন জিততে হলে উপত্যকার পুরনো বা প্রতিষ্ঠিত দলগুলোকে তুলনায় খারাপ ফল করতে হবে – বিজেপির সরকার গড়ার ফমুর্লা বা ‘মিশন কাশ্মীর’ সফল হওয়ার এটাও অন্যতম প্রধান শর্ত!
এই কারণেই শ্রীনগরে বা জম্মুর কাটরায় এসে প্রধানমন্ত্রী মোদিও লাগাতার ন্যাশনাল কনফারেন্স, পিপলস ডেমোক্র্যাটিক পার্টিকে লাগাতার আক্রমণ করে চলেছেন।
এদের সঙ্গে কংগ্রেসকেও জুড়ে নিয়ে তিনি বলছেন, এই তিনটে খানদান বা পরিবারই কাশ্মীরকে বছরের পর বছর ধরে লুটে চলেছে – কিন্তু এবার তাদের হাত থেকে সাধারণ মানুষের হাতে ক্ষমতা আসার পালা!
দশ বছর আগে বিজেপি যখন প্রথমবারের মতো জম্মু ও কাশ্মীর সরকারের শরিক হয়েছিল, তারা কিন্তু ক্ষমতায় এসেছিল মুফতি পরিবারের নেতৃত্বাধীন পিডিপি-র হাত ধরেই।
তবে সেই সরকারে তারা ছিল ছোট শরিক বা জুনিয়র পার্টনার, পেয়েছিল উপমুখ্যমন্ত্রীর পদ। কিন্তু এবারে তারা চাইছে ‘সিনিয়র পার্টনার’ হিসেবে ক্ষমতায় যেতে।
ভারতে এই মুহুর্তে মোট ৩৬টি রাজ্য ও কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল আছে, যার মধ্যে ক্ষুদ্র লাক্ষাদ্বীপ ছাড়া একমাত্র মুসলিম-প্রধান অঞ্চল হল জম্মু ও কাশ্মীর।
আগামী মাসে সত্যিই যদি কোনও বিজেপি নেতা শ্রীনগরে মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেন, তবে তা হবে মুসলিম-প্রধান কাশ্মীরের জন্য সত্যিই এক অভূতপূর্ব ঘটনা। কিন্তু বিজেপির জন্য সেই লক্ষ্যে পৌঁছনোর রাস্তা যাবে হিন্দুপ্রধান জম্মুর ভেতরে দিয়েই!
সূত্র: বিবিসি বাংলা