রাজনৈতিক, ব্যবসায়িক ও আদর্শিক- এ তিন ধরনের বিরোধের জেরে খুন হয়েছেন ঝিনাইদহ-৪ আসনের সংসদ-সদস্য (এমপি) আনোয়ারুল আজিম আনার। হত্যাকাণ্ডের মাস্টারমাইন্ড আক্তারুজ্জামান শাহীনের সঙ্গে আনারের ছিল ব্যবসায়িক বিরোধ।
হত্যা মিশনে সরাসরি নেতৃত্ব দেওয়া চরমপন্থি নেতা শিমুল ভূঁইয়া ওরফে আমানুল্লার সঙ্গে আদর্শিক এবং কিলারদের অর্থের জোগানদাতা ঝিনাইদহ জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সাইদুল করিম মিন্টুর সঙ্গে ছিল রাজনৈতিক বিরোধ। আনারের বিরোধী পক্ষগুলো একাট্টা হয়ে তাকে দুনিয়া থেকে সরানোর মিশনে নামে। দীর্ঘদিন আনার তাদের টার্গেটে ছিলেন। কিন্তু অত্যন্ত চতুর আনারকে কোনোভাবেই বাগে পাচ্ছিল না শত্রু পক্ষ। ফলে অপেক্ষায় ছিল ঝোপ বুঝে কোপ মারার। যেন ‘সাপও মরে, লাঠিও না ভাঙে’- এমন ছকে সাজানো হয় এমপি আনার হত্যা পরিকল্পনা। এ পরিকল্পনার অংশ হিসাবে আনারকে প্রলোভন দেখিয়ে কৌশলে ভারতে ডেকে নেয় কিলাররা। পরে তাকে হত্যা থেকে শুরু করে লাশ টুকরো টুকরো করে গুম করার মিশন সম্পন্ন হয়েছে কাটআউট পদ্ধতিতে।
সুপরিকল্পিতভাবে সংঘটিত এ হত্যাকাণ্ডের পেছনে একত্রে কাজ করেছে তার বিরোধী তিনটি পক্ষই। আনার হত্যার ঘটনায় গ্রেফতার আসামিদের জিজ্ঞাসাবাদে এখন পর্যন্ত এমন তথ্যই পেয়েছে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশ। মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ডিবি ওয়ারী বিভাগের সহকারী কমিশনার (এসি) মাহফুজুর রহমান বিভিন্ন সময় আদালতে আসামিদের রিমান্ড আবেদনে আনার হত্যার নেপথ্যে এ তিন বিরোধের কথা উল্লেখ করেছেন।
সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, গ্রেফতার চরমপন্থি নেতা শিমুল রিমান্ডে জানিয়েছেন তিনি নিষিদ্ধ ঘোষিত পূর্ববাংলা কমিউনিস্ট পার্টির (এমএল) শীর্ষস্থানীয় নেতা। খুলনা, ঝিনাইদহ, যশোরসহ দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে পার্টির কার্যক্রম পরিচালনা করতেন। তাদের দলের আদর্শের সঙ্গে এমপি আনারের দীর্ঘদিনের বিরোধ ছিল। এমপি আনারের এলাকায় পুলিশের সঙ্গে বিভিন্ন সময় বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয়েছেন এমএল-এর বেশকিছু নেতাকর্মী। এসব বন্দুকযুদ্ধের পেছনে আনারের ইন্ধন ছিল বলে অভিযোগ শিমুলের। অন্যদিকে হত্যার মাস্টারমাইন্ড শাহীনের সঙ্গে ব্যবসায়িক বিরোধ ছিল আনারের। এর জেরে শাহীনও দীর্ঘদিন আনারকে হত্যার পরিকল্পনা করে আসছিলেন। আর স্থানীয় রাজনীতিতে জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মিন্টুর পথের কাঁটা ছিলেন আনার। ফলে আনারকে হত্যার জন্য কিলারদের দুই কোটি টাকা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেন মিন্টু। আনার হত্যায় গ্রেফতার চরমপন্থি নেতা শিমুল ও ঝিনাইদহ জেলা আওয়ামী লীগের ত্রাণ ও সমাজকল্যাণবিষয়ক সম্পাদক কাজী কামাল আহম্মেদ ওরফে গ্যাস বাবুর স্বীকারোক্তিতে উঠে এসেছে এসব তথ্য। তারা আদালতে হত্যার দায় স্বীকার করে ১৬৪ ধারায় দেওয়া জবানবন্দিতেও আনার হত্যার নেপথ্যের কারণ উল্লেখ করেছেন।
মিন্টুকে গ্রেফতারের পর ঢাকা মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার (গোয়েন্দা) মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ নিজ কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে জানান, আনারের সঙ্গে মিন্টুর রাজনৈতিক বিরোধ ছিল। ঝিনাইদহ-৪ আসনে এমপি হওয়ার খায়েশ ছিল মিন্টুর। ফলে আনার হত্যা মিশন শেষ করতে দুই কোটি টাকার বাজেটও করেন তিনি। খুনি ভাড়া থেকে শুরু করে সার্বিক কাজের দায়িত্ব দেন মিন্টুর ঘনিষ্ঠ সহযোগী কাজী কামাল আহম্মেদ ওরফে গ্যাস বাবুকে।
এদিকে আনার হত্যাকাণ্ডে এখন পর্যন্ত ১০ জনের সম্পৃক্ততার বিষয়ে নিশ্চিত হয়েছে ডিবির তদন্ত দল। তাদের মধ্যে পাঁচজনকে বাংলাদেশ ও দুজনকে ভারতের পুলিশ গ্রেফতার করেছে। বাকি তিনজন এখনো অধরা রয়েছেন। এর মধ্যে হত্যার মূল মাস্টারমাইন্ড আক্তারুজ্জামান শাহীন যুক্তরাষ্ট্রে আছেন। তাকে গ্রেফতারে ইন্টারন্যাশনাল ক্রিমিনাল পুলিশ অর্গানাইজেশনের (ইন্টারপোল) সহায়তা চেয়ে ইতোমধ্যে লিখিত আবেদনও করা হয়েছে।
পুলিশের একটি সূত্র বলছে, পুলিশের এ আবেদনে এখনো কোনো সাড়া দেয়নি ইন্টারপোল। এছাড়া অপর দুই আসামি মোস্তাফিজ ও ফয়সাল হত্যা মিশন শেষে বৈধপথেই বাংলাদেশে প্রবেশ করে আত্মগোপনে আছেন। তাদের গ্রেফতারে ডিবি লাগাতার অভিযান চালাচ্ছে।
ভারতের সিআইডির ডাকে ডিএনএ নমুনা দিতে এমপি আনারের মেয়ে ডরিন ও ভাই এনামুল হক ইমান ভারত যাচ্ছেন। বৃহস্পতিবার ভারতের সিআইডি ডরিনকে ফোন করে ভারত যাওয়ার কথা বলেছে। এছাড়া ডিবির তদন্ত কর্মকর্তাকেও বিষয়টি অবহিত করেছে ভারতের সিআইডি। তবে এমপির স্বজনরা ভারত যাওয়ার বিষয়ে ডিবির তদন্তসংশ্লিষ্টদের সহায়তাও চেয়েছেন। ফলে আনারের স্বজনদের সঙ্গে ডিবির একটি টিমও ভারতে যাওয়ার বিষয়ে নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে ডিবি। ডিবির এ টিমে আনার অপহরণ মামলার তদন্ত কর্মকর্তারও থাকার কথা রয়েছে। জিও (গভর্নমেন্ট অর্ডার)-এর অপেক্ষায় আছে ডিবি।
এ বিষয়ে ডিবির তদন্তসংশ্লিষ্টরা কোনো বক্তব্য দিতে অপারগতা প্রকাশ করেছেন। তবে এমপি আনারের ব্যক্তিগত সহকারী আব্দুর রউফ বলেন, ডিবির কর্মকর্তারা বলেছেন রোববার জিও হলেই তারা আমাদের সঙ্গে ভারত যাবেন। তিনি আরও জানান, স্বজনদের পক্ষ থেকে তিনজন ভিসা পেয়েছেন। তারা ভারতে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত রয়েছেন।
উল্লেখ্য, এমপি আনার ১২ মে ভারত যান। পরদিন ১৩ মে কলকাতার নিউটাউন এলাকার সঞ্জীবা গার্ডেনসের একটি ফ্ল্যাটে খুন হন তিনি। ঘটনাটি প্রকাশ্যে আসে ২২ মে। ওইদিন রাজধানীর শেরেবাংলা নগর থানায় আনারের মেয়ে ডরিন অজ্ঞাতনামা আসামিদের বিরুদ্ধে অপহরণ মামলা করেন। এছাড়া ভারতে একটি হত্যা মামলা হয়। দুদেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এ হত্যাকাণ্ডে জড়িত থাকার দায়ে সাত জনকে গ্রেফতার করেছে। তারা হলেন বাংলাদেশে গ্রেফতার শিমুল ভূঁইয়া, তানভীর, সেলেস্তি, বাবু ও মিন্টু। ভারতে গ্রেফতার আছেন সিয়াম ও কসাই জাহিদ। এছাড়া আরও তিনজনের নাম এসেছে, যারা হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে সরাসরি জড়িত নন। তারা হলেন, চেলসি চেরি ওরফে আরিয়া, তাজ মোহাম্মদ খান ও জামাল হোসেন। তবে আর্থিক লেনদেনের সঙ্গে তারা ব্যবহৃত হতে পারেন বলে ডিবির সন্দেহ। ইতোমধ্যে তারাসহ ১০ জনের ব্যাংক স্টেটমেন্ট খতিয়ে দেখার জন্য আদালতের অনুমতি নিয়েছে ডিবি। ডিবির সূত্র বলছে, তাদের বিষয়ে তথ্য চেয়ে দ্রুতই বাংলাদেশ ব্যাংকে আবেদন করা হবে।