ফেব্রুয়ারি ২৭, ২০২৪ ৮:৪৮ পূর্বাহ্ণ
স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উত্তরণকালীন ১১ হাজার কোটি মার্কিন ডলার আয়ের লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে প্রণয়ন করা হয়েছে রপ্তানিনীতির (২০২৪-২০২৭) খসড়া। এ সময়ে উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশের বাজারগুলোতে দীর্ঘদিনের পাওয়া শুল্ক-কোটামুক্ত সুবিধা হারাবে বাংলাদেশ। ইউরোপের বাজারে দেশের পণ্য রপ্তানিতে নতুন করে ১০ শতাংশ শুল্ক গুনতে হবে রপ্তানিকারকদের। সীমিত হবে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা (ডব্লিউটিও’র) চুক্তির আওতায় বিশেষ সুবিধাগুলো। এসবসহ আরও বেশ কিছু চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করেই বাস্তবায়ন করতে হবে নতুন রপ্তানিনীতি।
যদিও এর আগের ২০২১-২০২৪ রপ্তানিনীতিতে আট হাজার কোটি মার্কিন ডলারের আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তা অর্জন সম্ভব হয়নি। কারণ কোভিড-১৯, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ ও বিশ্ব অর্থনৈতিক মন্দা রপ্তানি আয়ে বড় বাধা সৃষ্টি হয়।
জানা গেছে, রপ্তানিনীতির খসড়ার ওপর সংশ্লিষ্ট স্টেকহোল্ডারদের মত চেয়েছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। এরপর তা চূড়ান্ত আকারে ঘোষণা দেওয়া হবে। আর ঘোষণার দিন থেকে ২০২৭ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত এ নীতি কার্যকর থাকবে। প্রতি তিন বছর অন্তর রপ্তানি খাতের জন্য এ নীতি প্রণয়ন করে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়।
সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে বাণিজ্য প্রতিমন্ত্রী আহসানুল ইসলাম টিটু বলেন, বিশ্বের বিভিন্ন দেশে আমাদের পণ্যের রপ্তানি বাড়াতে সরকার নিরলসভাবে কাজ করছে। রপ্তানি বহুমুখীকরণের মাধ্যমে বাণিজ্য সম্প্রসারণে বিদেশে আমাদের মিশনগুলোকে আরও জোরালো ভূমিকা পালন করতে দিকনির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
জানতে চাইলে সাবেক বাণিজ্য সচিব (সিনিয়র) মাহবুব আহমেদ জানান, ২০২৬ সালে স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উত্তরণ ঘটবে আমাদের। এ ঘটনার পর উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলোর বাজারে যেসব সুবিধা কমবে সেগুলো আরও তিন বছর বহাল থাকবে। অর্থাৎ আগামী ২০২৯ সাল পর্যন্ত বলবত থাকবে। ফলে নতুন রপ্তানি নীতিমালা খুব বেশি প্রভাব পড়বে না। তবে এর বাইরে যে সমস্যা সেটি হচ্ছে বাজার ও পণ্য বহুমুখীকরণ। কিছুটা কার্যকর হলেও এখন অনেক বাকি আছে। পণ্য বৈচিত্র্যকরণে বিরাট সম্ভাবনা থাকলেও খুব বেশি এগোনো যায়নি। এ সময় অনেক পণ্য এলেও এখনো তৈরি পোশাকের ওপর নির্ভরশীল আছি।
সূত্র মতে, খসড়া রপ্তানিনীতির আওতায় বাইরে থাকবে বিদেশগামী জাহাজ অথবা বিমানের ভান্ডার, যন্ত্রপাতি, মেশিনের যন্ত্রাংশ, রন্ধন শালার অংশ হিসাবে ঘোষিত পণ্য, নাবিক, উড়োজাহাজ, যান বা বিমান ক্রু ও যাত্রীদের সঙ্গে বৃহনকৃত ব্যাগেজ।
আগামী তিন বছরে রপ্তানি ১১ হাজার কোটি মার্কিন ডলারে উন্নীত করতে বেশ কিছু পদক্ষেপের ঘোষণা থাকছে রপ্তানিনীতিতে। এর মধ্যে রয়েছে একটি ডাটা ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করা। এর মাধ্যমে রপ্তানি-আমদানিকারক, ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড এবং সরকারি ও বেসরকারি স্টেকহোল্ডারদের তথ্য আদান-প্রদান করা হবে। এছাড়া রপ্তানি খাতে স্বাভাবিক ঋণ প্রবাহ ও সুদের হার সিঙ্গেল ডিজিটে স্থিতিশীল রাখা, রপ্তানিকারকদের নগদ সীমা নির্ধারণ করা হবে। পাশাপাশি একটি উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন রপ্তানি ঋণ মনিটরিং কমিটি গঠন করা হবে। এ কমিটি মূলত রফতানি ঋণের চাহিদার অঙ্ক নির্ধারণ, ঋণ প্রবাহ পর্যালোচনা করবে। এছাড়া রাশিয়াসহ অন্যান্য সিআইএস দেশ, মিয়ানমার, ইরান এবং ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলোর সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্ক সম্প্রসারণে ব্যাংকিং চ্যানেল ব্যবস্থা চালু করা হবে। এটি করা হলে সংশ্লিষ্ট দেশগুলোতে রপ্তানি বাণিজ্যে লেনদেনে কোনো প্রতিবন্ধকতা থাকবে না। সেখানে আরও বলা হয়, এলসি কমিশন, ব্যাংক ঋণের সুদের হার, নানা ধরনের সার্ভিস চার্জ, ব্যাংক গ্যারান্টি ও কমিশন সর্বনিু পর্যায়ে রাখা হবে।
খসড়া নীতিতে স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উত্তরণের চ্যালেঞ্জকে পর্যবেক্ষণে রাখা হয়। সেখানে বলা হয়, এ উত্তরণে বিনিয়োগ সম্ভাবনা সৃষ্টি করবে। পাশাপাশি রপ্তানি ও অর্থনৈতিক খাতে বেশ কিছু চ্যালেঞ্জ সৃষ্টি হবে। বিশেষ করে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার চুক্তির আওতায় কঠোর কপ্লায়েন্স ও সঠিক মানদণ্ড পালন করতে হবে। রপ্তানি খাতে নগদ প্রণোদনা দেওয়া থেকে সরে আসতে হবে।
সূত্র মতে, খসড়া নীতিতে তৈরি পোশাকশিল্পকে জিডিপি, রপ্তানির প্রবৃদ্ধি ও কর্মসংস্থানের মূলভিত্তি হিসেবে শনাক্ত করা হয়। পণ্য বহুমুখীকরণের ক্ষেত্রে তৈরি পোশাকের বাইরে খাদ্য, চামড়াজাত পণ্য ও পাদুকা, লাইট ইঞ্জিনিয়ারিং পণ্য, পাট ও পাটজাত পণ্য, ফার্মাসিউটিক্যালস পণ্যের বিকাশে সুপারিশ করা হয়। এই নীতিতে সেবা খাতের মধ্যে পর্যটন খাত, সফটওয়্যার, আইসিটি সার্ভিসেস ও বিজনেস প্রসেস আউটসোর্সিংকে সম্ভাবনা হিসাবে চিহ্নিত করা হয়।
খসড়া নীতিতে আরও বলা হয়, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার (এআই) কারণে আগামীতে বাংলাদেশে স্বল্প-দক্ষ শ্রম নিবিড় উৎপাদন প্রক্রিয়ার তুলনামূলক সুবিধা হারাবে। শ্রমনির্ভর খাতে কর্মসংস্থান হারানোর আশঙ্কা থাকছে। প্রস্তুতি হিসাবে অবকাঠামো উন্নয়নের পাশাপাশি আইটি এনাবল সার্ভিসেস খাতে দক্ষ জনশক্তি গড়ে তুলতে হবে।
আগামী ২০২৭ সাল পর্যন্ত রপ্তানি খাতে ১২টি লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে এ নীতি প্রণয়ন করা হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে রপ্তানিতে আর্থিক প্রণোদনার বিপরীতে বিকল্প সহায়তা দিয়ে ব্যবসা-বাণিজ্য খাতের প্রবৃদ্ধি ধরে রাখা। কারণ স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উত্তরণের পর নগদ সহায়তা বন্ধ হবে। এ চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় এ উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে।
এছাড়া রপ্তানি বাণিজ্যে উচ্চ প্রবৃদ্ধি অর্জন, প্রয়োজনীয় বিনিয়োগ সহায়তা দিয়ে পণ্য ও বাজার বহুমুখীকরণ, বিশ্ব পরিস্থিতির সঙ্গে সংগতি রেখে বাণিজ্য ব্যবস্থার সক্ষমতা বাড়ানো, মুক্ত বাণিজ্য, দ্বিপাক্ষিক ও বহুপাক্ষিক বাণিজ্য চুক্তি সম্পাদন। লক্ষ্যের মধ্যে শিল্প খাতে উৎপাদনশীলতা বাড়িয়ে কর্মসংস্থান সৃষ্টি, কৃষি ও প্রক্রিয়াজাত কৃষিপণ্যের মান উন্নয়ন, আইসিটি খাতকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার, ই-কমার্স, ই-গভার্নেন্স ও চতুর্থ বিপ্লবের কৌশল গ্রহণ করে রপ্তানি বাণিজ্য সম্প্রসারণকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়।
নমুনা সংগ্রহ প্রসঙ্গে শর্ত দেওয়া হয় বাংলাদেশ ব্যাংকের সম্মতি নিয়ে শতভাগ রপ্তানিমুখী পোশাকশিল্প বছরে সর্বোচ্চ ৩০ হাজার মার্কিন ডলার এবং চামড়াশিল্পে ২০ হাজার মার্কিন ডলারের পণ্যের নমুন প্রেরণ করতে পারবে।
নানা চ্যালেঞ্জ থাকা সত্ত্বেও নতুন খসড়া নীতিতে ১৪টি পণ্যকে রপ্তানির ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেওয়া হচ্ছে। এর মধ্যে রয়েছে অধিক মূল্য সংযোজিত তৈরি পোশাক ও ডেনিম, কৃত্রিম ফাইবার, গার্মেন্ট এক্সেসরিজ, ফার্মাসিউটিক্যাল পণ্য, প্লাস্টিক পণ্য, জুতা, চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য, পাটজাত পণ্য, কৃষিপণ্য, লাইট ইঞ্জিনিয়ারিং, ফার্নিচার, হোম টেক্সটাইল উল্লেখযোগ্য।