অক্টোবর ৬, ২০২৪ ৩:২৫ পূর্বাহ্ণ
টানা বৃষ্টি ও পাহাড়ি ঢলে শেরপুর ও ময়মনসিংহে বন্যা পরিস্থিতির আরও অবনতি হয়েছে। দুই জেলার সীমান্তবর্তী উপজেলাগুলোর বেশিরভাগ এলাকা পানিতে তলিয়ে গেছে। ভেসে গেছে ফসলের মাঠ, সবজি খেত ও মাছের খামার। ঘরে পানি ওঠায় অনেকের চুলা জ্বলছে না।
বন্যাকবলিত পরিবারগুলোতে শুকনো খাবার ও বিশুদ্ধ পানির চরম সংকট দেখা দিয়েছে। কোথাও প্লাবিত হয়েছে সড়ক, কোথাও প্রবল স্রোতে সড়ক ভেঙে গেছে। এতে অনেক এলাকায় যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। বাড়িঘর ডুবে যাওয়ায় অনেকে নিরাপদ স্থান ও আশ্রয়কেন্দ্রে ছুটছেন। শেরপুরের নালিতাবাড়ীতে বন্যার পানিতে দুই নারীসহ ৩ জনের মৃত্যু ও ৩ জন নিখোঁজ হয়েছেন।
টানা বৃষ্টির কারণে ঢাকার কেরানীগঞ্জ, রংপুর, নোয়াখালী, টাঙ্গাইল ও কুড়িগ্রামে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়েছে। ফেনী ও জামালপুরের দেওয়ানগঞ্জে নদী ভাঙনে বিলীন হয়েছে বহু ঘরবাড়ি। ভাঙন আতঙ্কে অনেকে বাড়িঘর ভেঙে সরিয়ে নিচ্ছেন।
ব্যুরো ও প্রতিনিধিদের পাঠানো খবর-
শেরপুর ও নালিতাবাড়ী: ঝিনাইগাতী, নালিতাবাড়ী ও শ্রীবরদী উপজেলার কমপক্ষে ১৮টি ইউনিয়নের আংশিক বন্যাকবলিত হয়েছে। শনিবার সকাল থেকে থেমে থেমে বৃষ্টি হয়েছে। এতে এসব ইউনিয়নের বানভাসি মানুষের দুর্ভোগ আরও বেড়েছে। বন্যাকবলিত এলাকার বহু বাড়িঘর, অধিকাংশ রাস্তাঘাট, ফসলের মাঠ তলিয়ে গেছে। ভেসে গেছে মাছের পুকুর ও খামার।
নিম্নাঞ্চলের হাজার হাজার মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। শেরপুর থেকে তিনআনী হয়ে নালিতাবাড়ী আঞ্চলিক সড়ক পাহাড়ি ঢলের প্রবল স্রোতে রানীগাঁও সেতুর কাছে ভেঙে গেছে। ওই সড়কে শনিবার দুপুর থেকে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। ঢলের পানির প্রবল তোড়ে ভেঙে গেছে অনেক ঘরবাড়ি ও গাছপালা।
নালিতাবাড়ী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. মাসুদ রানা ও নালিতাবাড়ী থানার ওসি মো. ছানোয়ার হোসেন জানান, শুক্রবার বিকালে বন্যার পানিতে ডুবে খালিসাকুড়া গ্রামের ইদ্রিস আলী (৬৫), শুক্রবার রাতে বাঘবের গ্রামের আম্বিয়া খাতুন (৪৫) ও আরেক নারীর মৃত্যু হয়েছে। তার নাম জানা যায়নি।
এছাড়া নালিতাবাড়ী উপজেলার নামা বাতকুচি গ্রামের মহুয়া খাতুন, অভয়নগর গ্রামের দুই ভাই হাতেম আলী ও আলমগীর শুক্রবার রাতে বন্যার পানিতে ভেসে গিয়ে নিখোঁজ রয়েছেন। ঝিনাইগাতী থানার ওসি মো. আল আমীন জানান, সন্ধ্যাকুড়া এলাকায় বন্যার পানিতে অজ্ঞাতনামা এক লাশ ভেসে এলে পুলিশ উদ্ধার করেছে। লাশটি ভারত থেকে এসেছে বলে পুলিশের ধারণা।
জেলা প্রশাসক তরফদার মাহমুদুর রহমান বলেন, বন্যার্তদের সহায়তার জন্য সব ধরনের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে শুকনো খাবার বিতরণের কাজ চলছে।
সেনাবাহিনী, বিজিবি, ফায়ার সার্ভিসের সদস্য ও বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন পানিবন্দি মানুষকে উদ্ধারে কাজ করছে। বানভাসি মানুষ উঁচু স্থানে ও বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আশ্রয় নিয়েছে। উপজেলা প্রশাসনসহ বিভিন্ন সংগঠনের পক্ষ থেকে বানভাসি মানুষকে ত্রাণ দেওয়া হচ্ছে।
ফুলপুর, ধোবাউড়া ও হালুয়াঘাট (ময়মনসিংহ): ধোবাউড়া উপজেলার ৭টি ইউনিয়নের অন্তত ২০ হাজার পরিবার পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। এসব পরিবারগুলোতে শুকনো খাবার ও বিশুদ্ধ পানির চরম সংকট দেখা দিয়েছে। এছাড়াও নেতাই নদীর আশপাশের এলাকায় অন্তত অর্ধশত ঘরবাড়ি বিলীন হয়ে গেছে।
পানিবন্দি অনেকে বাড়ি ছেড়ে অন্যত্র আত্মীয়স্বজনের বাড়িতে আশ্রয় নিচ্ছে। শুক্রবার বিকালে উপজেলার কলসিন্দুর, জিগাতলা এবং পঞ্চনন্দপুরসহ বিভিন্ন পয়েন্টে নেতাই নদীর বাঁধ ভেঙে লোকালয়ে পানি প্রবেশ করে। এতে পুরো উপজেলা প্লাবিত হয়েছে।
ফুলপুর উপজেলার ছনধরা, রামভদ্রপুর, সিংহেশ্বও, ফুলপুর ইউনিয়নের অধিকাংশ ও অন্যান্য ইউনিয়নের আংশিক এলাকা পানিতে তলিয়ে গেছে। এসব এলাকার আমন ফসল ও সবাজি খেত তলিয়ে গেছে। ভেসে গেছে মাছের খামার। উপজেলা সদর থেকে কলসিন্দুর পাকা রাস্তা, ঘোষগাঁও ধোবাউড়া পাকা রাস্তা, ঘোষগাঁও বালিগাঁও পাকা রাস্তা, মুন্সিরহাট বাজার থেকে শালকোনা পাকা রাস্তা বন্যার পানিতে তলিয়ে গেছে।
এদিকে হালুয়াঘাটের ১২টি ইউনিয়নের প্রায় সবকটিই প্লাবিত হয়েছে। তলিয়ে গেছে হাজার হাজার হেক্টর জমির ধান, সবজি খেত ও ভেসে গেছে পুকুরের মাছ। পানিবন্দি হয়ে আছে প্রায় ত্রিশ হাজার পরিবার। ঘরের মধ্যে পানি ঢোকার কারণে রান্নার কাজও ব্যাহত হচ্ছে। অনাহারে-অর্ধাহারে দিনাতিপাত করছে তারা।
নেত্রকোনা: জেলার কলমাকান্দা, দুর্গাপুর ও বারহাট্টার অন্তত পনেরোটি ইউনিয়নের নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। জেলা পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) জানিয়েছে, ভারতে বৃষ্টির কারণে আগামী ২৪ ঘণ্টা ঢলের পানি ও বৃষ্টি অব্যাহত থাকবে।
কলমাকান্দা উপজেলার পোগলা ইউনিয়নের পাঁচগড়া গ্রামের বাসিন্দা সিদ্দিক মিয়া বলেন, দুদিন ধরে অনেক বৃষ্টি হচ্ছে। পানি বাড়ির কাছাকাছি এসে পড়েছে। যে কোনো সময় ঘরের ভেতর পানি ঢুকবে। একই উপজেলার কৈলাটি ইউনিয়নের কনুড়া গ্রামের বাসিন্দা রেহান উদ্দিন বলেন, বৃষ্টি আর নদীর পানি সমানতালে বাড়ছে।
কুড়িগ্রাম, কাউনিয়া ও রৌমারী: শুক্রবার থেকে টানা বৃষ্টিতে কুড়িগ্রাম শহরের বিভিন্ন সড়ক ও অফিস চত্বরে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়েছে। এসব সড়কে হাঁটু পানি ভেঙে চলাচল করছে মানুষ। শহরে অনেক দোকানপাট বন্ধ রয়েছে। খুব প্রয়োজন ছাড়া মানুষ বাড়ি থেকে বের হচ্ছে না। এতে বিপাকে পড়েছে খেটে খাওয়া ও দিনমজুর শ্রেণির মানুষগুলো।
অন্যদিকে বৃষ্টি অব্যাহত থাকায় নদ-নদীর পানিও বৃদ্ধি পাচ্ছে। শনিবার বিকালে রাজারহাট আবহাওয়া অফিসের তথ্যমতে, ২৪ ঘণ্টায় কুড়িগ্রামে ১৫৭ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে। কুড়িগ্রাম পৌর শহরের রিকশাচালক আপেল বলেন, সকাল থেকে বসে আছি। রাস্তায় কোনো যাত্রীর দেখা নেই।
বৃষ্টিতে রৌমারী-রাজিবপুরের নিম্নাঞ্চলও প্লাবিত হয়েছে। এদিকে কাউনিয়ায় তিস্তার পানি বৃদ্ধি পেয়ে বন্যার সৃষ্টি হয়েছে। পানির তোড়ে বালাপাড়া ইউনিয়নের মৌলভীবাজার এলাকায় সেতুর সংযোগ সড়কের দুই পাশ ভেঙে গেছে।
টাঙ্গাইল ও ভূঞাপুর: টাঙ্গাইল শহরের সাবালিয়া, বিশ্বাস বেতকা, পূর্ব আদালতপাড়া, থানাপাড়া, আদি টাঙ্গাইলসহ শহরের বিভিন্ন এলাকায় বৃষ্টিতে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়েছে। অনেকের বাসাবাড়িতে পানি জমে দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে। শহরের সাবালিয়া এলাকার স্কুলছাত্র মেরাজ উদ্দিন বলেন, অল্প বৃষ্টিতে পাকা সড়ক তলিয়ে আমার বাসায় পানি প্রবেশ করেছে। এতে আমাদের অনেক কষ্ট হচ্ছে। ভূঞাপুর পৌরসভার অধিকাংশ বাসাবাড়িতেও পানি ঢুকেছে। তলিয়ে গেছে পৌরসভার প্রধান সড়ক।
দেওয়ানগঞ্জ (জামালপুর): পাহাড়ি ঢলের তীব্র স্রোতের কারণে ডাংধরা সীমান্তঘেঁষা পাথরের চর গ্রাম সংলগ্ন নোকাইঝোড়া ভাঙন তীব্র আকার ধারণ করেছে। শুক্রবার জিঞ্জিরাম নদীর ভাঙনে ১৬টি পরিবারের বাড়িঘর বিলীন হয়েছে। হুমকিতে রয়েছে পাথরের চর বিওপি ক্যাম্প, আদর্শ গ্রাম, সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, দেওয়ানগঞ্জ ডাংধরা রৌমারী টু রাজিবপুর সড়ক, হাটবাজারসহ গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা।
নোয়াখালী: টানা বৃষ্টিতে নোয়াখালী পুলিশ সুপার, ডিবি অফিস, জেলা রেকর্ড রুম, গণপূর্ত অফিস, ডিসি, এসপির বাসভবনের নিচ তলা, হাউজিং এলাকা জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়েছে। এতে সেবাপ্রত্যাশীরা পড়েছে চরম দুর্ভাগে। এছাড়াও সদর উপজেলাসহ বিভিন্ন উপজেলার সড়ক ও বাসাবাড়ির উঠোন পানিতে ডুবে গেছে।
চাঁদপুর ও হাজীগঞ্জ: জেলায় ২৪ ঘণ্টায় ২৭৭ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে। টানা বৃষ্টিতে জেলা সদরসহ বিভিন্ন এলাকায় সড়ক ও বাসাবাড়িতে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়েছে। শহরের নাজিরপাড়া, মিশন রোড আশ্রম এলাকা, প্রফেসরপাড়া, মমিনপাড়া, গুয়াখোলা, চিত্রলেখা মোড়, পালপাড়া, আলিমপাড়া, আদালতপাড়া, রহমতপুর আবাসিক এলাকা, গাজী সড়ক, মাদ্রাসা সড়কে বৃষ্টির পানিতে জলাবদ্ধতা দেখা দিয়েছে। হাজীগঞ্জ উপজেলার বিভিন্ন এলাকায়ও জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়েছে।
কেরানীগঞ্জ (ঢাকা): কেরানীগঞ্জের কলাতিয়া ইউনিয়নের নিশানবাড়ি এলাকায় শতাধিক পরিবার পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা না থাকায় এমন অবস্থার সৃষ্টি হচ্ছে। সরেজমিন দেখা যায়, কারো থাকার ঘরে হাঁটু পানি, কারো চুলায় পানি, কারো টিউবওয়েল নিমজ্জিত পানিতে।
কৃষক নারায়চন্দ্র মণ্ডল বলেন, এলাকার পানি নিষ্কাশনের জন্য যে খালটি রয়েছে, সেটি ভরাট হয়ে যাওয়ায় পানি নিষ্কাশনে ব্যাঘাত ঘটছে।
সোনাগাজী দক্ষিণ (ফেনী): কোম্পানীগঞ্জের মুসাপুর রেগুলেটর নদীগর্ভে বিলীনের পর থেকে বড় ও ছোট ফেনী নদীর অব্যাহত ভাঙনে সোনাগাজী উপজেলার ফসলি জমি, ঘরবাড়ি, রাস্তাঘাট ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নদীগর্ভে বিলীন হয়ে যাচ্ছে। ভাঙন আতঙ্কে আনেকে ঘরবাড়ি রেখে নিরাপদ আশ্রয়ে চলে গেছেন। কেউ কেউ ভবন ভেঙে রড ও আসবাবপত্র সরিয়ে নিচ্ছেন।