বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে নিরস্ত্র ছাত্র-জনতার ওপর গুলি, হত্যার নির্দেশদাতা ও পরিকল্পনাকারী হিসাবে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ ৯ জনের নামে গণহত্যার অভিযোগটি মামলা হিসাবে নথিভুক্ত করা হয়েছে। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থায় বুধবার মামলাটি রেকর্ড হয়। মামলার তদন্ত কর্মকর্তা হিসাবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থার উপপরিচালক আতাউর রহমানকে।
সংশ্লিষ্ট আইনজীবীরা জানিয়েছেন, এই মামলার প্রাথমিক তদন্ত শেষে ট্রাইব্যুনাল থেকে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি হলে বিচারের ক্ষেত্রে ফৌজদারি কার্যবিধি, সাক্ষ্য আইন ও সংবিধানের ৪৯ ধারা প্রযোজ্য হবে না। অর্থাৎ ট্রাইব্যুনাল আইনের ধারামতে, সংবাদপত্রের তথ্য ও কারও মৌখিক সাক্ষী দ্বারা বিচার করা যাবে আসামিদের।
প্রসঙ্গত, বুধবার বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে নিরস্ত্র ছাত্র-জনতার ওপর গুলি, হত্যার নির্দেশদাতা ও পরিকল্পনাকারী হিসাবে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ ৯ জনের নাম উল্লেখ করে গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ আনা হয়। আবেদনে সংগঠন হিসাবে আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগ ও এর অঙ্গসংগঠনগুলোর বিরুদ্ধে একই অভিযোগ করা হয়। আসামিদের বিরুদ্ধে তদন্ত করে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ চাওয়া হয় আবেদনে। ওই আন্দোলনে নিহত নবম শ্রেণির ছাত্র আরিফ আহমেদ সিয়ামের বাবা বুলবুল কবিরের পক্ষে বুধবার ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থায় এই আবেদনটি করেন সুপ্রিমকোর্টের আইনজীবী গাজী এমএইচ তামিম। এ নিয়ে গত তিন দিনে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে মোট ছয়টি মামলা দায়ের হয়েছে।
জানতে চাইলে আইনজীবী গাজী এমএইচ তামিম বৃহস্পতিবার বলেন, শেখ হাসিনাসহ ৯ জনের নাম উল্লেখ করে গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগটি মামলা হিসাবে রেকর্ড করেছে তদন্ত সংস্থা। মামলা নম্বর-১২৭, তারিখ ১৪ আগস্ট ২০২৪। তিনি বলেন, মামলার তদন্তের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে তদন্ত সংস্থার উপপরিচালক আতাউর রহমানকে। তিনি ইতোমধ্যেই তদন্ত কাজ শুরু করেছেন।
গাজী এমএইচ তামিম বলেন, তদন্ত সংস্থা তদন্ত করে ট্রাইব্যুনাল বরাবরে একটি আবেদন করে আসামিদের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা চাইতে পারেন। তদন্ত কাজের জন্য আসামিদের হাজির করা দরকার। তখনই এটি ট্রাইব্যুনালের মামলা হিসাবে লিপিবদ্ধ হবে। আর যদি গ্রেফতারি পরোয়ানা না চান তাহলে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়ার পর চিফ প্রসিকিউটর একটা আনুষ্ঠানিক অভিযোগ ট্রাইব্যুনালে জমা দেবেন। জমা দেওয়ার পর আনুষ্ঠানিক বিচার শুরু হবে। বিদ্যমান আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালস অ্যাক্ট ১৯৭৩ অনুযায়ী এই অভিযোগের বিচার করতে আইনি কোনো বাধা আছে কিনা, জানতে চাইলে তিনি বলেন, কোনো বাধা নেই। কারণ এই আইনে চারটি অপরাধের বিচারের কথা বলা আছে। মানবতাবিরোধী অপরাধ, গণহত্যা, যুদ্ধাপরাধ ও শান্তির বিরুদ্ধে অপরাধ।
এর আগে বুধবার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থার উপপরিচালক আতাউর রহমান জানিয়েছিলেন, আমরা অভিযোগটি নথিভুক্ত করেছি এবং এর ফলে মামলার তদন্ত শুরু হলো। তদন্ত শেষ হওয়ার পর আমরা পরবর্তী কার্যক্রমের জন্য ট্রাইব্যুনালের প্রধান প্রসিকিউটর অফিসে প্রতিবেদন জমা দেব।
সর্বশেষ ঢাকায় অবস্থিত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে তিনজন বিচারপতি ছিলেন।
এরা হচ্ছেন ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান বিচারপতি মো. আবু আহমেদ জমাদার, সদস্য বিচারপতি কেএম হাফিজুল আলম ও বিচারপতি এএইচএম হাবিবুর রহমান ভূঁইয়া। এরই মধ্যে গত ১৩ জুন ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান বিচারপতি মো. আবু আহমেদ জমাদার অবসরে গেলে সেখানে আর কাউকে নিয়োগ দেওয়া হয়নি। গত মঙ্গলবার (১৩ আগস্ট) ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউশন প্যানেল থেকে ১০ জন প্রসিকিউটর পদত্যাগ করেন। বর্তমানে ট্রাইব্যুনালের কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে।
ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থায় দেওয়া আবেদনে আসামি হিসাবে সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা, সাবেক সেতুমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, সাবেক ডাক ও টেলিযোগাযোগ প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক, সাবেক তথ্য ও সম্প্রচার প্রতিমন্ত্রী মোহাম্মদ আলী আরাফাত এবং তৎকালীন সরকারের কিছু মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী ও সংসদ সদস্য, পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন, ঢাকা মহানগর ডিবির সাবেক প্রধান হারুন অর রশীদ, ঢাকা মহানগর পুলিশের সাবেক কমিশনার হাবিবুর রহমান ও কিছু অসাধু পুলিশ কর্মকর্তা ও সদস্য, র্যাবের সাবেক মহাপরিচালক মো. হারুন অর রশীদ ও কিছু অসাধু র্যাব কর্মকর্তা, সদস্যসহ অজ্ঞাতনামা অস্ত্রধারী আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ ও যুবলীগের নেতাকর্মী এবং সংগঠন হিসাবে আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগ ও এর অঙ্গসংগঠনগুলোর কথা উল্লেখ করা হয়েছে।
আবেদনে অপরাধের ধরনের বিষয়ে বলা হয়েছে, ১ থেকে ৯ নম্বর আসামির নির্দেশে ও পরিকল্পনায় অন্য আসামিরা দেশি ও আগ্নেয়াস্ত্র দিয়ে নির্বিচার গুলি করে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনকারী সাধারণ নিরস্ত্র ছাত্র-জনতাকে হত্যা করে তাদের সমূল বা আংশিক নির্মূল করার উদ্দেশ্যে গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটনের মতো অপরাধ করেছে।
ট্রাইব্যুনালে তদন্ত সংস্থার আবেদনে বলা হয়েছে, বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনকারীদের সমূলে নির্মূল করার হীন উদ্দেশ্যে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সংবাদ সম্মেলনে আন্দোলন প্রতিহত করার জন্য উসকানিমূলক বক্তব্য দেন। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এবং আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের আন্দোলনকারী ছাত্র-জনতাকে সমূলে বা আংশিক নির্মূল করার নির্দেশনা দেন।
এতে বলা হয়, শেখ হাসিনা, ওবায়দুল কাদের এবং অন্য আসামিদের নির্দেশে আওয়ামী লীগ ও এর অঙ্গসংগঠন এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এ সময় দেশব্যাপী আন্দোলনরত সাধারণ ছাত্রছাত্রীদের ওপর আগ্নেয়াস্ত্র এবং দেশীয় অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে হামলা করে। তাদের নির্বিচারে গুলি করে হত্যা করে। কুপিয়ে, পিটিয়ে মারাত্মক আহত করে গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটন করে। ১৫ জুলাই থেকে ৫ আগস্ট পর্যন্ত সারা দেশে কমপক্ষে ৪৩৯ জন শিক্ষার্থী হত্যা করা হয় বলে এই আবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।