দেশের প্রধান শেয়ারবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) তথ্যপ্রযুক্তিতে (আইটি) রোববার স্মরণকালের সর্বোচ্চ বিপর্যয় হয়েছে। এর ফলে ওয়েবসাইটে দেখা যায়, একদিনেই ডিএসইর মূল্যসূচক ৫ হাজার ৯৭১ পয়েন্ট কমেছে। এর মানে হলো তালিকাভুক্ত সব কোম্পানির শেয়ারের দাম প্রায় ৯৮ শতাংশ কমেছে। অর্থাৎ দেশের পুরো শেয়ারবাজার অস্তিত্বহীন। আবার বাজারমূলধন প্রায় ৯০ গুণ বেড়ে ৬৭২ লাখ ৪৮ হাজার কোটি টাকায় উন্নীত হয়েছে। নজিরবিহীন এই কাণ্ডে পুরো বাজারে আতঙ্ক ছড়িয়েছে। বিষয়টি নিয়ে আলাদা দুটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) এবং ডিএসই। এছাড়াও বিনিয়োগকারীদের আতঙ্কিত না হওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। তবে সন্ধ্যা ৭টার পর পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক হয়ে আসে। বিএসইসি মনে করছে, এ ধরনের ঘটনা উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে ঘটানো হতে পারে। জানতে চাইলে বিএসইসির চেয়ারম্যান প্রফেসর শিবলী রুবাইয়াত-উল-ইসলাম রোববার বলেন, শেয়ারবাজারে প্রায়ই গুজব ছড়িয়ে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়াতে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে এ ধরনের কাজ করা হয়। এর সঙ্গে কারা জড়িত, তা আমরা খতিয়ে দেখছি। ইতোমধ্যে দুই সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটি রিপোর্ট দিলে আমরা ব্যবস্থা নেব। এর সঙ্গে যাদের সংশ্লিষ্টতা পাওয়া যাবে, তাদের কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না।
ডিএসই বলছে, তালিকাভুক্ত তথ্যপ্রযুক্তি খাতের একটি কোম্পানির তথ্য হালনাগাদ করতে গিয়ে সার্ভার ত্রুটিতে পড়ে। লেনদেনের শুরুতেই রোববার এ কারিগরি ত্রুটির কথা জানায় ডিএসই। বিনিয়োগকারীদের আন্দাজের ওপর ভিত্তি করে শেয়ার কেনাবেচা করতে হয়েছে। দিনের শুরুতে সূচক ছিল ৬ হাজার ১১২ পয়েন্ট। তবে ওয়েবসাইটের তথ্য বলছে, দিন শেষে তা ৫ হাজার ৯৭১ পয়েন্ট বা প্রায় ৯৮ শতাংশ কমে সূচক দেখাচ্ছে মাত্র ১৪১ পয়েন্ট। তবে এটি অসম্ভব। কারণ শেয়ারদর উঠানামায় সার্কিট ব্রেকার (সর্বোচ্চ কতটুকু উঠতে বা কমতে পারে) থাকায় একদিনে সর্বোচ্চ ১০ শতাংশ পতন হতে পারে। এর বাইরে কোনোভাবেই দাম কমা সম্ভব নয়। মূল সূচকে ত্রুটির মধ্যেই রোববার লেনদেন হওয়া আইটি খাতের কোম্পানি আমরা নেটওয়ার্কের সব লেনদেন বাতিল করার কথা জানিয়েছে ডিএসই। এদিকে বাজারে সমস্যা চিহ্নিত করতে দুই সদস্য বিশিষ্ট তদন্ত কমিটি গঠন করেছে বিএসইসি। সদস্যরা হলেন-বিএসইসির উপ-পরিচালক মো. সহিদুল ইসলাম এবং সহকারী পরিচালক মোহাম্মদ দস্তগীর হুসাইন। কমিটিকে ৩ দিনের মধ্যে রিপোর্ট দিতে বলা হয়েছে। এছাড়াও বাজার পরিস্থিতি নিয়ে বিবৃতি দিয়েছে ডিএসই। বিবৃতিতে বলা হয়-বিনিয়োগকারী তথা পুঁজিবাজার সংশ্লিষ্ট সবার অবগতির জন্য জানানো যাচ্ছে যে, অপারেশনাল ত্রুটিজনিত কারণে ডিএসইর সূচকে শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত অস্বাভাবিক পরিসংখ্যান লক্ষ্য করা যায়। এ বিষয়ে ডিএসই ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠান নাসডাকের সঙ্গে জরুরি বৈঠক করে তা সমাধানের চেষ্টা অব্যাহত রেখেছে। একইসঙ্গে ডিএসই প্রধান আর্থিক কর্মকর্তা এবং প্রধান পরিচালন কর্মকর্তা (চলতি দায়িত্ব) এজিএম সাত্বিক আহমেদ শাহকে প্রধান করে ৩ সদস্যর একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে। কমিটিকে আগামী ৩ দিনের মধ্যে প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়েছে। ডিএসই কর্তৃপক্ষ আশা করছে দ্রুতই সমস্যার সমাধান করা যাবে। এ বিষয়ে বিনিয়োগকারীসহ সংশ্লিষ্টদের আতঙ্কিত না হওয়ার অনুরোধ জানানো যাচ্ছে। এছাড়াও অনাকাঙ্ক্ষিত সমস্যার জন্য দুঃখ প্রকাশ করছে ডিএসই।
এদিকে কারিগরি সমস্যার বিষয়টি নতুন নয়। ডিএসইতে কিছুদিন পরপর কারিগরি সমস্যায় লেনদেন ব্যাহত হচ্ছে। গত বছরের ৭ আগস্ট বিভিন্ন ব্রোকারেজ হাউজের লেনদেন নিষ্পত্তিতে বড় ধরনের সমস্যা হয়েছিল। লেনদেন নিষ্পত্তিতে পরেরদিন পর্যন্ত সময় লেগেছে। এছাড়াও এর আগে গত বছরের ২৪ ও ৩০ অক্টোবর ডিএসইতে বিলম্বে লেনদেন শুরু হয়। ওই ঘটনায় সংস্থাটির প্রধান প্রযুক্তি কর্মকর্তা (সিটিও) মো. জিয়াউল করিমকে বাধ্যতামূলক ছুটিতে পাঠানো হয়। ওই সময়ে একটি তদন্ত কমিটিও হয়েছিল। কিন্তু প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। এতে শেয়ারবাজারের প্রতি বিনিয়োগকারীদের আস্থা কমছে।
জানতে চাইলে অর্থনীতি ও শেয়ারবাজার বিশেষজ্ঞ আবু আহমেদ বলেন, বারবার কেন সমস্যা হচ্ছে তা পরিষ্কার নয়। তিনি বলেন, আমি শুনেছি ডিএসইর নাসডাকের সফটওয়্যার ব্যবহার করে। আর ওইসব সফটওয়্যার যারা ব্যবহার করে সেখানে ৫০ থেকে ৭০ হাজার কোটি টাকা লেনদেন সম্ভব। কিন্তু আমাদের লেনদেন হয় মাত্র ৪ থেকে ৫শ কোটি টাকা। এখানে সমস্যা হলে তা মেনে নেওয়া যায় না। তিনি বলেন, বিষয়টি ভালো করে খতিয়ে দেখা উচিত। কারণ সফটওয়্যার তৃতীয় পক্ষের মাধ্যমে কেনা হয়। তারা হাতে কিছু ক্ষমতা রেখে দেয়। ফলে সমস্যা হলে তাদের ডাকতে হয়। ফলে চুক্তিতে কী আছে সেটিও খতিয়ে দেখতে হবে। প্রয়োজনে সফটওয়্যার পরিবর্তন করতে হবে।