ভারতে তৃতীয়বারের জন্য প্রধানমন্ত্রী পদে শপথ নিয়েছেন এনডিএ জোটের প্রধান নরেন্দ্র মোদি (৭৩)। জওহরলাল নেহেরু ছাড়া আর কোনো প্রধানমন্ত্রী টানা তিনবার শপথ নেওয়ার কৃত্বিত্ব পাননি। রোববার সন্ধ্যায় রাষ্ট্রপতি ভবনে আয়োজিত শপথ অনুষ্ঠানে মন্ত্রিপরিষদের ৭২ সদস্যও শপথগ্রহণ করেন। এ অনুষ্ঠানে কংগ্রেস সভাপতি মল্লিকার্জুন খাড়গে উপস্থিত থাকলেও এতে যোগ দেননি তৃণমূল কংগ্রেস নেত্রী পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি। খবর এনডিটিভি, ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস, আনন্দবাজার পত্রিকার।
স্থানীয় সময় সন্ধ্যা ৭টা ১৫ মিনিটে প্রধানমন্ত্রী হিসাবে নরেন্দ্র মোদিকে শপথবাক্য পাঠ করান রাষ্ট্রপতি দ্রৌপদী মুর্মু। মোদির পাশাপাশি তার মন্ত্রিপরিষদে ৭২ সদস্যও এ অনুষ্ঠানে শপথগ্রহণ করেন। তাদের মধ্যে ক্যাবিনেট পদের মন্ত্রী ৩০ জন। স্বাধীন দায়িত্বপ্রাপ্ত রাষ্ট্রমন্ত্রী পাঁচজন। বিজেপির পাশাপাশি মোট ১১টি জোটসঙ্গীকে মন্ত্রীর পদ দেওয়া হয়েছে। এদের মধ্যে কাকে কোন মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দেওয়া হবে সেটা পরে জানানো হবে। ৪৩ জন মন্ত্রী তিনবার বা তার বেশিবার এ দায়িত্ব পালন করেছেন। ৭২ মন্ত্রীর মধ্যে ৩৯ জনই আগের সরকারে দায়িত্ব পালন করেছেন বলে এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।
নরেন্দ্র মোদির পরই একের পর এক শপথ নেন বিদায়ি মন্ত্রিসভার প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিংহ, বিদায়ি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ, বিদায়ি সড়ক পরিবহণমন্ত্রী নিতিন গডকড়ী, বিজেপি সভাপতি জেপি নাড্ডা, মধ্যপ্রদেশের শিবরাজ সিংহ চৌহান, বিদায়ি অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারমন, বিদায়ি পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর, হরিয়ানার সাবেক মুখ্যমন্ত্রী মনোহরলাল খট্টর, সাবেক প্রধানমন্ত্রী এইচডি দেবগৌড়ার ছেলে এইচডি কুমারস্বামী, বিদায়ি ক্রেতাসুরক্ষা, খাদ্য এবং সরবরাহ দপ্তরের মন্ত্রী পীযূষ গয়াল, বিদায়ি শিক্ষামন্ত্রী ধর্মেন্দ্র প্রধান, এনডিএ-র শরিক দল হিন্দুস্তান আওয়াম মোর্চা (হাম)-র জিতনরাম মাঝি, জেডিইউ-র রাজীবরঞ্জন সিংহ ওরফে লাল্লন, চন্দ্রবাবু নাইডুর টিডিপির নেতা কে রামমোহন নাইডুসহ অন্যরা।
কড়া নিরাপত্তায় ঘেরা জমকালো এ অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। রোববার তিনি বিজেপির ৯৬ বছর বয়সি সিনিয়র নেতা লালকৃষ্ণ আদভানির সঙ্গে তার বাড়িতে সৌজন্য সাক্ষাৎ করেন। ভারতে বাংলাদেশের হাইকমিশনার মো. মুস্তাফিজুর রহমান বলেন, ‘বৈঠকে দুই নেতা তাদের ব্যক্তিগত বিষয় নিয়ে কথা বলেন।’ এরপর সন্ধ্যায় প্রধানমন্ত্রী তার মেয়ে সায়মা ওয়াজেদের সঙ্গে রাষ্ট্রপতি ভবনে তৃতীয় বিদেশি নেতা হিসাবে শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানে যোগ দেন। নয়াদিল্লিতে অবস্থানকালে শেখ হাসিনা রাষ্ট্রপতি ভবনে শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানে যোগদানের পর নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে ওয়ান-টু-ওয়ান বৈঠক করবেন। প্রধানমন্ত্রীর সোমবার বিকালে ঢাকার উদ্দেশে নয়াদিল্লি ত্যাগ করার কথা রয়েছে।
এছাড়া শ্রীলংকার প্রেসিডেন্ট রনিল বিক্রমাসিংহে, মালদ্বীপের প্রেসিডেন্ট মহম্মদ মুইজ্জুসহ আট হাজার আমন্ত্রিত অতিথি উপস্থিত ছিলেন। শপথ অনুষ্ঠানের পর নেতারা রাষ্ট্রপতি ভবনে রাষ্ট্রপতি দ্রৌপদী মুর্মুর দেওয়া ভোজসভায় যোগ দেন। রাষ্ট্রপতি ভবনের এ আয়োজনে উপস্থিত ছিলেন শাখরুখ খান, অক্ষয় কুমার, চলচ্চিত্র পরিচালক রাজকুমার হিরানিসহ বলিউডের অনেক তারকাও।
কংগ্রেস শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানে হাজির থাকার কথা জানালেও বিরোধী জোট ‘ইনডিয়া’র তৃতীয় বৃহত্তম শরিক তৃণমূল শপথে উপস্থিত ছিল না। শনিবারই ভোটের ফল পর্যালোচনা করতে কালীঘাটের বাড়িতে বৈঠকের পর মমতা জানান, শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানে যোগ দেওয়ার আমন্ত্রণ তিনি পাননি। পেলেও তিনি যেতেন না। তিনি বলেন, ‘অগণতান্ত্রিক ও অসাংবিধানিকভাবে যে সরকার তৈরি করছে, তাকে আমি শুভেচ্ছা জানাতে পারছি না! দেশের জন্য শুভেচ্ছা জানাচ্ছি।’
বিজেপি এবার নির্বাচনে এককভাবে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়নি। তাই সরকার গড়তে এনডিএ’র শরিক দলগুলোর ওপর পদ্মশিবিরকে অনেকাংশে নির্ভর করতে হচ্ছে। তবে বিজেপি স্বরাষ্ট্র, প্রতিরক্ষা, অর্থ, শিক্ষা এবং সংস্কৃতির মতো ‘গুরুত্বপূর্ণ’ মন্ত্রণালয়গুলো নিজের হাতেই রেখেছে। অন্য গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ের মধ্যে বেশ কিছু বণ্টন করা হয়েছে শরিক দল চন্দ্রবাবু নাইডুর টিডিপি, নীতীশ কুমারের জেডিইউ, চিরাগ পাসোয়ানের এলজেপি (আর), একনাথ শিন্ডের শিবসেনা, এইচডি দেবগৌড়ার জেডিএস এবং জয়ন্ত চৌধুরীর আরএলডির মধ্যে।
রোববার লোককল্যাণ মার্গের বাড়িতে এনডিএ’র বেশ কয়েকজন সাংসদকে চা-চক্রে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন মোদি। মোদির ডাক পাওয়া সাংসদদের প্রায় প্রত্যেকেই মন্ত্রিসভায় ঠাঁই পেয়েছেন।
বিজেপি সূত্রে জানা গেছে, বিদায়ি মন্ত্রিসভার মতো নতুন মন্ত্রিসভায়ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ, প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিং, সড়ক ও জনপথমন্ত্রী নিতিন গডকড়ী তাদের পদে বহাল থাকছেন। রাজ্যসভার সদস্য নির্মলা সীতারমন এবং এস জয়শঙ্কর দুজনই যথাক্রমে অর্থ এবং পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে আছেন বলে এনডিটিভি জানিয়েছে।
চা-চক্রে হাজির ছিলেন বিজেপি সভাপতি জেপি নাড্ডা। সাংগঠনিক দায়িত্ব থেকে ফের তাকে মন্ত্রিসভায় আনা হচ্ছে। মন্ত্রী হওয়ার দৌড়ে রয়েছেন তিন সাবেক মুখ্যমন্ত্রী মধ্যপ্রদেশের শিবরাজ সিংহ চৌহান, হরিয়ানার মনোহরলাল খট্টর এবং কর্নাটকের বাসবরাজ বোম্মাই। তিনজনই শনিবারের চা-চক্রে হাজির ছিলেন। চন্দ্রবাবুর দল থেকে পূর্ণমন্ত্রী হচ্ছেন কে রামমোহন নাইডু এবং চন্দ্রশেখর পেম্মাসানি। নীতীশের দল থেকে মন্ত্রী হচ্ছেন লাল্লন সিংহ।
‘ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস’ বিজেপি সূত্রকে উদ্ধৃত করে জানিয়েছে, একটি পূর্ণমন্ত্রী এবং একটি প্রতিমন্ত্রীর পদ পাচ্ছে চন্দ্রবাবুর দল। শিবসেনার (শিন্ডে) পক্ষে পূর্ণমন্ত্রী হচ্ছেন প্রতাপরাও জাধব। জেডিএস থেকে মন্ত্রী হচ্ছেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী দেবগৌড়ার ছেলে এইচডি কুমারস্বামী। এ ছাড়া এনডিএ’র ছোট শরিক দলগুলোর মধ্যে হিন্দুস্তান আওয়াম মোর্চা (হাম)-এর জিতনরাম মাঝি, রিপাবলিক পার্টি অব ইন্ডিয়ার (আরপিআই-এ) রামদাস অঠওয়ালে, আজসুর চন্দ্রশেখর চৌধুরী পূর্ণমন্ত্রী হচ্ছেন বলে জানা গেছে।
বাংলাদেশ ভুটান থেকে জলবিদ্যুৎ আমদানি করতে আগ্রহী : প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারতের মধ্য দিয়ে ভুটান থেকে জলবিদ্যুৎ আমদানির বিষয়ে আগ্রহ প্রকাশ করেছেন। ভুটানের প্রধানমন্ত্রী দাশো শেরিং তোবগে রোববার প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে নয়াদিল্লিতে তার আবাসস্থলে সৌজন্য সাক্ষাৎ করতে এলে তিনি এ আগ্রহের কথা জানান। তিনি ভুটানের প্রধানমন্ত্রীকে বলে, ‘এর জন্য একটি ত্রিপক্ষীয় চুক্তির প্রয়োজন এবং আমরা ইতোমধ্যেই ভারতের সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করেছি। পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ সাক্ষাৎ শেষে এক সংবাদ ব্রিফিংয়ে এসব কথা বলেন। তিনি বলেন, ভুটান বাংলাদেশে জলবিদ্যুৎ রপ্তানির জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে। ভুটানের প্রধানমন্ত্রী তার দেশে একটি বার্ন ইউনিট নির্মাণ এবং এক বছরের জন্য প্রয়োজনীয় ওষুধ দেওয়ার জন্য বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যবাদ জানান। তিনি শেখ হাসিনার গতিশীল নেতৃত্বে বাংলাদেশের উন্নয়নের ভূয়সী প্রশংসা করেন।
শেখ হাসিনা বলেন, ভুটান বাংলাদেশের হৃদয়ে একটি বিশেষ স্থান দখল করে আছে। কেননা ভুটান ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের পর বাংলাদেশকে একটি স্বাধীন দেশ হিসাবে প্রথম স্বীকৃতি দেয়। তিনি বলেন, আমরা ভুটানকে সব ধরনের সহায়তা দিতে প্রস্তুত।
তিনি কুড়িগ্রামে বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলে ভারতকে দেওয়া জায়গার যথার্থ ব্যবহারের ওপর জোর দেন এবং আশা করেন ভুটান সেখানে শিল্প গড়ে তুলবে। প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশে ভুটানের বিনিয়োগ চেয়েছেন।
ভুটানের প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর একমাত্র কন্যা এবং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া অঞ্চলের আঞ্চলিক পরিচালক সায়মা ওয়াজেদের ভূয়সী প্রশংসা করেন এবং তার সাম্প্রতিক ভুটান সফরের কথা উল্লেখ করেন।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ, এমপি, প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ বিষয়ক উপদেষ্টা সালমান ফজলুর রহমান, বাণিজ্য প্রতিমন্ত্রী আহসানুল ইসলাম টিটু, প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব মোহাম্মদ তোফাজ্জেল হোসেন মিয়া, পররাষ্ট্র সচিব (সিনিয়র সচিব) মাসুদ বিন মোমেন, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের (পিএমও) সচিব মোহাম্মদ সালাহউদ্দিন এবং প্রেস সচিব নাঈমুল ইসলাম খানসহ অন্যরা বাংলাদেশের পক্ষে উপস্থিত ছিলেন।
অবকাঠামো ও পরিবহণমন্ত্রী চন্দ্র বাহাদুর গুরুং, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী শেরিং, ভারতে ভুটানের রাষ্ট্রদূত মেজর জেনারেল ভি. নামগিয়েল, মন্ত্রিপরিষদ সচিব কেসাং ডেকি এবং পররাষ্ট্র সচিব পেমা চোডেন, ভুটানের পক্ষে উপস্থিত ছিলেন।