নভেম্বর ১৫, ২০২৪ ৫:২৪ পূর্বাহ্ণ
কয়েক দশক ধরে ইরান এবং সৌদি আরবের মধ্যে বৈরি সম্পর্ক বিরাজ করছে৷ তবে গত বছর চীনের মধ্যস্থতায় কূটনৈতিক সম্পর্ক পুনঃস্থাপনের পর দেশ দুটি সেই বৈরি সম্পর্ক থেকে অনেকটাই বেরিয়ে এসেছে বলা যেতে পারে৷ আর মধ্যপ্রাচ্যের এই দুই দেশের সাম্প্রতিক সময়ের কূটনৈতিক আদানপ্রদান এমন ইঙ্গিত দেয় যে, সম্পর্ক গভীর করতে চায় তারা৷
যেমন ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্বাস আরঘাচির সর্বশেষ সৌদি সফরের কথা বলা যেতে পারে৷ সফরে তিনি সৌদি আরবের ক্রাউন প্রিন্স মোহাম্মদ বিন সালমানের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন৷
এই দেশ দুটির বৈরি সম্পর্কের ইতিহাস বেশ পুরোনো৷ বলা যেতে পারে, ১৯৭৯ সালে ইরান বিপ্লবের পর থেকেই এমন সম্পর্ক বিরাজ করছে৷ কয়েক দশকের পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে বলা যায়, সম্পর্ক পুনঃস্থাপনে দুই দেশের এই চেষ্টা খুবই নতুন এক রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট৷
মূলত রাজনীতিতে ধর্মের ভূমিকা নিয়ে দুই দেশের ভাবনা একেবারে দুই রকম৷ আর এখান থেকেই পরস্পরবিরোধী রাজনৈতিক অবস্থানের যাত্রা শুরু৷ ১৯৭৯ সালের বিপ্লবের পর ইসলাম নিয়ে ইরান সরকারের বোঝাপড়া ছিল সামাজিক বিপ্লবের জায়গা থেকে৷ দীর্ঘ সময় ধরে এই অঞ্চলে দেশটি নিজেকে শিয়া মুসলিমদের নেতা হিসেবে মেলে ধরেছে৷
এদিকে সুন্নি মতাদর্শের সৌদি রাজপরিবার নিজের ক্ষমতা ধরে রাখতে ধর্মের ভূমিকার ওপর নির্ভর করে থাকে৷ মধ্যপ্রাচ্যে নিজেকে ইসলামের নেতৃত্বদানকারী দেশ হিসেবে এবং মুসলমানদের পবিত্র স্থান মক্কা এবং মদিনার জিম্মাদার মনে করে দেশটি৷
২০১০ সালের আরব বসন্তের সময়ে দেশ দুটির দুই মেরুর অবস্থান আরো স্পষ্ট হয়ে উঠে৷ সৌদি রাজপরিবারের আশঙ্কা ছিল, গাঠনিক রূপ দিয়ে ইরান এই আন্দোলনকে ব্যবহার করতে পারে৷
দ্বন্দ্বের কেন্দ্রে ইয়েমেন
তবে সম্পর্ক পুনঃস্থাপনের নানা আলাপ-আলোচনা থাকা সত্ত্বেও দেশ দুটি ইয়েমেন প্রশ্নে দুই মেরুতেই অবস্থান করছে৷ ইরান সমর্থিত হুতি মিলিশিয়ারা ইয়েমেনের সাবেক প্রেসিডেন্ট আবেদ রাবু মানসুরকে ক্ষমতাচ্যুত করা চেষ্টা করেছে এবং দেশটির কিছু অঞ্চল নিজেদের নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিয়েছে৷
এদিকে সৌদি আরবের নেতৃত্বে সুন্নি দেশগুলোর যে জোট তা আবার পশ্চিমাদের, বিশেষ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন পাচ্ছে৷ তারা হুতিদের মোকাবিলা করতে চায়৷ মূলত এই অঞ্চলে ইরানের প্রভাব ঠেকাতে তৎপর তারা৷
সম্পর্ক পুনঃস্থাপনে সৌদির স্বার্থ
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সম্পর্ক পুনঃস্থাপনের এই চেষ্টায় সৌদি আরবের দৃষ্টিকোণ থেকে বেশ কিছু সুবিধা রয়েছে৷
জার্মানির থিংক ট্যাংক সিএআরপিও-এর বিশ্লেষক সেবাস্টিয়ান সোনস ডয়চে ভেলেকে বলেন, ২০১৯ সালে সৌদি আরবের তেলের স্থাপনায় ইরানের হামলার পর সৌদি সরকার বুঝতে পেরেছে যে, তারা যুক্তরাষ্ট্রের উপর পুরোপুরি নির্ভর করতে পারবে না৷ সেই সাথে প্রতিবেশী ইরানের সাথে বৈরিতার সমাধান করতে হবে৷
তিনি বলেন, তেলের ওপর নির্ভর করা রিয়াদের কাছে দেশটির অর্থনীতির সফলতা নির্ভর করবে এই অঞ্চলের স্থিতিশীলতার ওপর৷ এই বিষয়টি বুঝতে পেরেছে সৌদি আরব৷
তাছাড়া সৌদি আরবে মিসাইল হামলার ঘটনাও বন্ধ করতে চায় রিয়াদ৷ সৌদি আরব মনে করে, হুতি মিলিশিয়াদের প্রভাবিত করতে পারে ইরান৷
তবে বার্লিনের ইনস্টিটিউট ফর ইন্টারন্যাশনাল অ্যান্ড সিকিউরিটি অ্যাফেয়ার্সের হামিদরেজা আজিজি ডয়চে ভেলেকে বলেন, হুতির সব কার্যক্রমের ওপর ইরান প্রভাব ফেলতে পারবে বিষয়টি এমন নয়৷ তবে হুতি এবং ইরান একে অপরের স্বার্থ রক্ষা করে থাকে৷ এই সম্পর্ক ইয়েমেনে যুদ্ধবিরতিতে ভূমিকা রাখতে পারে৷
ইরানের স্বার্থ
সৌদি আরবের সঙ্গে সম্পর্ক পুনঃস্থাপনের মাধ্যমে নিজের সুনির্দিষ্ট স্বার্থ হাসিল করতে চায় ইরান৷
আজিজি বলেন, বছরের পর বছর ধরে ইরানের ওপর আরোপিত নিষেধাজ্ঞা, দেশের ভেতরে অর্থনৈতিক অব্যবস্থাপনা এবং দুর্নীতি ইরানকে ক্ষতির মুখে ফেলেছে৷ অর্থনৈতিক এই অস্থিরতার কারণে দেশের ভেতরে মারাত্মক বিক্ষোভ, আন্দোলন তৈরি হতে পারে আশঙ্কা ইরান সরকারের৷
আজিজির মতে, সরকার কার্যকরভাবে দেশ পরিচালনা করতে পারছে না এমন ভাবনা ইরানিদের মধ্যে রয়েছে৷
যেহেতু পশ্চিমাদের সঙ্গে পরমাণু বিষয়ে কোনো সমঝোতায় পৌঁছাতে পারেনি এবং অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা উঠাতে পারেনি, এই ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে ইরান ভিন্ন পথ খোঁজার চেষ্টা করছে৷ এর অংশ হিসেবে বিভিন্ন বহুজাতিক সংস্থা যেমন ব্রিকস, সাংহাই কোঅপারেশন অর্গানাইজেশন ইত্যাদি জায়গায় নিজেদের যুক্ত করতে চাইছে৷ সেই সঙ্গে প্রতিবেশী দেশ যেমন সৌদি আরবের সঙ্গেও সম্পর্ক উন্নয়ন করতে চাইছে ইরান৷
নিরাপত্তার বিষয়েও উদ্বেগ রয়েছে ইরানের৷ আজিজির মতে, চীনের মধ্যস্ততায় সৌদি আরব ও ইরানের মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্ক পুনঃস্থাপনের আগে সৌদি আরব এবং ইসরাইলের মধ্যে সম্পর্ক তৈরি হওয়ার ইঙ্গিত দেখা গিয়েছিল৷ এই অবস্থায় মধ্যপ্রাচ্যে ইসরাইল ও আরব দেশগুলোর মিলে ইরানবিরোধী একটি জোট তৈরি হতে পারে, এমন আশঙ্কা করছিল ইরান৷ এর সমাধান হিসেবে কূটনৈতিকভাবে আরব দেশগুলোর সঙ্গে যোগাযোগে এগিয়ে আসে ইরান৷
যদিও বর্তমান প্রেক্ষাপটে সৌদি-ইসরাইলের সম্পর্ক স্থাপনের চেষ্টা আর প্রাসঙ্গিক নয়৷ উদাহরণ হিসেবে আজিজি বলেন, সৌদি আরব এরই মধ্যে ফিলিস্তিন সমস্যা সমাধানে দুই রাষ্ট্রের পরিকল্পনা সামনে এনেছে যা ইসরাইলের কূটনৈতিক মনোভাবের বিরোধী৷
তবে আজিজি এ-ও বলেন, ইসরাইলের বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়া কিংবা ইরানের সঙ্গে গভীরতা বাড়িয়ে পশ্চিমাদের থেকে দূরে সরে যাওয়ার কোনো ইচ্ছা সৌদি আরবের নেই৷ এর পরিবর্তে এক ধরনের কৌশলগত অবস্থান তৈরি করতে চায় সৌদি আরব৷
মধ্যস্থতাকারী হওয়ার ইচ্ছা সৌদির
বিশ্লেষক সোনসের মতে, সব পক্ষের মধ্যস্থতাকারী হওয়ার মতো একটি অবস্থানে যেতে চায় সৌদি আরব৷
সোনস বলেন, একই ভূমিকা পালন করছে কাতার৷ সৌদি আরব ছিল অনেকটা রক্ষণশীল, কিন্তু এখন মনে হচ্ছে এটি তেহরানের সঙ্গে যোগাযোগের রাস্তা উন্মুক্ত রাখতে চায়৷
তিনি বলছেন, যুক্তরাষ্ট্র থেকে সৌদি আরবের মাধ্যমে ইরানকে বার্তা পাঠানো হয়েছে৷ এধরনের কৌশলগত অবস্থান হতে পারে সৌদি আরবের আঞ্চলিক নীতি ওবং কূটনীতির গুরুত্বপূর্ণ অংশ।
একই কথা বললেন আজিজি৷ এই বিশ্লেষকের মতে, ইরান-সৌদি আরবের সুসম্পর্ক এই অঞ্চলে দীর্ঘমেয়াদে স্থিতিশীলতা তৈরি করবে৷ আর ইরান বুঝতে পারছে, সম্পর্ক পুনঃস্থাপন সব পক্ষের জন্যই লাভজনক৷