নভেম্বর ৫, ২০২৩ ১১:৩৬ পূর্বাহ্ণ
‘মেট্রোরেলে বাঁচবে সময়, বাঁচবে পরিবেশ, কমবে যানজট’ এই স্লোগান বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে পূর্ণতা পেলে রাজধানীবাসীর বহুল প্রতীক্ষিত স্বপ্নের মেট্রোরেল। রোববার থেকে পুরোদমে রাজধানীর বুকে ডানা মেলে ঘুরে বেড়াবে এই মেট্রোরেল। এখন থেকে প্রতিদিন লাখ লাখ কর্মঘণ্টা বেঁচে যাবে।
শনিবার দুপুরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ট্রেনে চড়ে এ যাত্রার শুভ সূচনা করেন। তাতে তিলোত্তমা ঢাকার দুর্বিষহ যানজট নিরসনের স্বপ্ন পূরণে যোগাযোগ ব্যবস্থায় উন্নয়নের আধুনিক গণপরিবহন মেট্রোরেল চালুর মাধ্যমে এগিয়ে গেলে বাংলাদেশ। শুধু মেট্রোরেলই নয়, যোগযোগ ব্যবস্থায় উন্নয়নে তৃণমূল থেকে রাজধানী পর্যন্ত নিজস্ব অর্থায়নে তৈরি হয়েছে পদ্মাসেতু, দৃষ্টিনন্দন উড়াল সড়ক, বঙ্গবন্ধু টানেল, থার্ড টার্মিনাল। চালু হওয়ার অপেক্ষায় আরো কয়েকটি প্রকল্প।
তিলোত্তমা ঢাকায় লক্করঝক্কর গণপরিবহনে যাত্রীদের কষ্ট করে আসা-যাওয়া নৈমিত্তিক ঘটনা। আবার বাড়তি ভাড়ার বিষয়টিতো আছেই। এ বাস্তবতায় নগরবাসীকে যানজট থেকে মুক্তি দিতে স্বপ্নের মেট্রোরেলের যাত্রা শুরু হয়েছিল ২০২২ সালের ২৮ ডিসেম্বর। তবে সেই যাত্রা ছিল আংশিক। এবার তা পূর্ণতা পেয়ে উত্তরা থেকে মতিঝিল এলাকায় ডানা মেলে উড়ে বেড়াবে। এতে বাঁচবে কর্মঘণ্টা, ঘুরে দাঁড়াবে অর্থনীতির চাকা।
পূর্ণতা পেল মেট্রোরেল, বাঁচবে লাখ লাখ কর্মঘণ্টা
শনিবার দুপুরে ম্যাস র্যাপিড ট্রানজিট লাইন-৬ (এমআরটি লাইন-৬) আগারগাঁও থেকে মতিঝিল অংশ পর্যন্ত উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। একই অনুষ্ঠান থেকে এমআরটি লাইন-৫ অর্থাৎ হেমায়েতপুর থেকে ঢাকার ভাটারা পর্যন্ত মেট্রোরেল নির্মাণ কাজেরও উদ্বোধনও করেন তিনি। এরপর বিকেল ৪টায় সুধী সমাবেশে যোগ দেন প্রধানমন্ত্রী।
এদিকে মেট্রোরেল চালু হওয়ায় ফুরফুরে মেজাজে আছেন রাজধানীবাসী। তারা বলছেন, এখন থেকে আর চিরচেনা যানজটে পড়তে হবে না। যানজটের নগরীতে ভরসা এখন মেট্রোরেল।
শুরুতে এমআরটি লাইন-৬ উত্তরা থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত চালু হলেও এটি এখন মতিঝিল পর্যন্ত যাবে। এর মধ্য দিয়ে আপাতত নগরবাসী ২০.১ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিতে পারবে মাত্র ৩১ মিনিটে। জনসাধারণের চলাচলের খুলে দেওয়া হবে রোববার সকাল সাড়ে ৭টা থেকে।যোগাযোগ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যানজটের কারণে যে আর্থিক, শারীরিক ও মানসিক ক্ষতি হচ্ছে তার লাগাম টানা যাবে। মেট্রোরেল মতিঝিল পর্যন্ত পূর্ণ সময় চলাচল করলে দিনে ১০ লাখ কর্মঘণ্টা বাঁচবে। যাতায়াত ব্যবস্থায় গতিও যোগ হবে।
মতিঝিল পর্যন্ত মেট্রোরেল চালু হওয়াকে আশীর্বাদ বলে মনে করেন চাকরিজীবী আসাদ আবেদীন জয়। তিনি বলেন, মিরপুর থেকে প্রতিদিন ১২ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে জাতীয় প্রেসক্লাব এলাকায় যেতে-আসতে ৪ ঘণ্টা লেগে যায়। এখন মতিঝিল পর্যন্ত মেট্রোরেল চালু হওয়ায় ৪০ মিনিটে কর্মস্থলে আসতে পারবো। ভাড়া একটু বেশি হলেও সময় অনেক কমে যাবে।
পূর্ণতা পেল মেট্রোরেল, বাঁচবে লাখ লাখ কর্মঘণ্টা- ফাইল ফটো
ডিএমটিসিএল-এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক এম এ এন ছিদ্দিক বলেন, রোববার থেকে মতিঝিল পর্যন্ত চলাচল শুরু হওয়ার পর উত্তরা থেকে মতিঝিল পর্যন্ত সবগুলো চালু স্টেশনে দাঁড়িয়ে একটি ট্রেন মতিঝিল পৌঁছাতে সময় লাগবে মাত্র ৩১ মিনিট। আগারগাঁও থেকে মতিঝিল পর্যন্ত অংশে যাত্রা পথে ট্রেনগুলো শুধু ফার্মগেট, সচিবালয় ও মতিঝিল স্টেশনে থামবে। সকাল সাড়ে ৭টা থেকে বেলা সাড়ে ১১টা পর্যন্ত চলাচল করা ট্রেনগুলো উত্তরা উত্তর স্টেশন থেকে মতিঝিল পর্যন্ত উভয় দিকে চলাচল করবে। বেলা সাড়ে ১১টা থেকে পরবর্তী ট্রেনগুলো শুধু উত্তরা থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত চলাচল করবে। এ সময় মতিঝিল পর্যন্ত কোনো ট্রেন আর চলাচল করবে না।
২১ দশমিক ২৬ কিলোমিটার রেলপথে মোট স্টেশন থাকছে ১৭টি। স্টেশনগুলো হচ্ছে— উত্তরা উত্তর, উত্তরা সেন্টার, উত্তরা দক্ষিণ, পল্লবী, মিরপুর ১১, মিরপুর ১০, কাজীপাড়া, শেওড়াপাড়া, আগারগাঁও, বিজয় সরণি, ফার্মগেট, কারওয়ান বাজার, শাহবাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, সচিবালয়, মতিঝিল ও কমলাপুর।
এমএএন ছিদ্দিক বলেন, শুরুতে তিনটি স্টেশন দিয়ে চালু হলেও ধীরে ধীরে স্টেশনের সংখ্যা ও মেট্রোরেল চলাচলের সময় বাড়ানো হবে।
সম্প্রতি সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেন, আগারগাঁও থেকে মতিঝিল সেকশনের দৈর্ঘ্য ৮ দশমিক ৭২ কিলোমিটার। ফার্মগেট-সচিবালয়-মতিঝিল স্টেশনে মেট্রোরেল আপাতত থামবে। উত্তরা-মতিঝিল রুটে ৫ নভেম্বর থেকে প্রতিদিন সকাল সাড়ে ৭টা থেকে সকাল সাড়ে ১১টা পর্যন্ত মেট্রো চলাচল করবে। সকাল সাড়ে ১১টার পর মতিঝিল-আগারগাঁও রুটে মেট্রোরেল চলাচল বন্ধ থাকবে এবং উত্তরা- আগারগাঁও সেকশনে রাত সাড়ে ৮টা পর্যন্ত চলবে।
তিনি বলেন, জনগণের সুবিধার কথা বিবেচনা করে মতিঝিল থেকে কমলাপুর পর্যন্ত ১ দশমিক ১৬ কিলোমিটার পথ বাড়ানো হয়েছে। বর্ধিত এই অংশ ২০২৪ সালের জুনের মধ্যে শেষ হবে।
যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ ও বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) অধ্যাপক মো. হাদিউজ্জামান বলেন, মেট্রোরেল মতিঝিল পর্যন্ত যাওয়া মাত্রই এখন যে ৯০ হাজার যাত্রী প্রতিদিন যাতায়াত করছে, সেটি পাঁচগুণ বেড়ে যাবে।
পূর্ণতা পেল মেট্রোরেল, বাঁচবে লাখ লাখ কর্মঘণ্টা- ফাইল ফটো
মতিঝিলকে ঢাকা শহরের বাণিজ্যিককেন্দ্র বলা হয়। এখন মাত্র চার ঘণ্টা, যখন এটি ১২ ঘণ্টা চলবে তখন প্রতিদিন ৫ লাখ যাত্রী যাতায়াত করতে পারবে। উত্তরা থেকে মতিঝিল যেতে আড়াই ঘণ্টা সময় লাগে, মেট্রোতে সেখানে সময় লাগবে মাত্র আধাঘণ্টা। সেই হিসাবে প্রতিদিন একজন মানুষের দুই ঘণ্টা করে কর্মঘণ্টা বাঁচবে। এতে দৈনিক মোট ১০ লাখ কর্ম ঘণ্টা বাঁচবে।
তিনি আরো বলেন, এটাকে যদি আমি অর্থনৈতিক টার্মে বলি— প্রতি ঘণ্টার ভ্যালু ৯০ টাকা, তাহলে এটি প্রায় সাড়ে ৮ কোটি টাকার মতো চলে আসে। যারা মেট্রোতে এই পথে যাতায়াত করবেন, তারা প্রতিদিন সবাই মিলে সাড়ে ৮ কোটি টাকা ক্ষতি বাঁচাতে পারবেন।
কর্তৃপক্ষ বলছে, মেট্রোরেল পুরোপুরি চালু হওয়ায় ঘণ্টায় ৬০ হাজার এবং দিনে পাঁচ লাখ যাত্রী যাতায়াত করতে পারবে। ছয়টি কোচসংবলিত প্রতিটি একমুখী ট্রেন প্রতিবারে সর্বোচ্চ দুই হাজার ৩০৮ জন যাত্রী পরিবহন করতে পারবে। এই পথে দিনে ২০টি ট্রেন চলাচল করবে। আরো চারটি ট্রেন বিকল্প হিসেবে প্রস্তুত থাকবে। মাঝের চার কোচের প্রতিটিতে যাত্রী ধারণক্ষমতা ৩৯০ জন। দুই পাশের ট্রেইলার কোচের (ইঞ্জিন) প্রতিটিতে সর্বোচ্চ যাত্রী ধারণক্ষমতা ৩৭৪ জন। নারী যাত্রীদের জন্য সব ট্রেনেই থাকছে আলাদা কোচ।
উত্তরা থেকে কমলাপুর পর্যন্ত পথ ২১ দশমিক ২৬ কিলোমিটার। মেট্রোরেলের এই পুরো পথে ১৭টি স্টেশন থাকবে। প্রথম ধাপে চালু হয়েছে আগারগাঁও পর্যন্ত দৈর্ঘ্য ১১ দশমিক ৭৩ কিলোমিটার অংশ। মতিঝিল পর্যন্ত পথ ২০ দশমিক ১০ কিলোমিটার। ২০২৫ সালের শেষের দিকে কমলাপুর পর্যন্ত যাত্রী পরিবহন করা সম্ভব হবে।
সূত্রে আরো জানা যায়, এমআরটি লাইন-৬ বা বাংলাদেশের প্রথম উড়াল মেট্রোরেল রুটের প্রতিটি স্টেশনে কনকোর্স লেভেল আছে। কনকোর্স লেভেলে ওঠার জন্য প্রতিটি স্টেশনে সিঁড়ি, লিফট ও এস্কেলেটর আছে। শুধু মেট্রো ট্রেন চলার সময় কনকোর্স লেভেল দিয়ে রাস্তার এপার থেকে ওপারে যাওয়া যাবে। তবে পেইড জোন এলাকা ও মূল প্লাটফর্মে যাওয়া যাবে না। পথচারীরা রাস্তা পারাপারের জন্য এই ব্যবস্থাকে ফুট ওভারব্রিজের অতিরিক্ত সুযোগ হিসেবে ব্যবহার করতে পারছেন।
কমিউনিকেশন বেইজড ট্রেন কন্ট্রোল (সিবিটিসি) সিস্টেমের এই মেট্রোরেলে দুটি ট্রেইলার কোচসহ মোট ৬টি কোচ নিয়ে চলাচল করছে। ভবিষ্যতে ৮টি কোচে উন্নীত করা যাবে। ট্রেইলার কোচের প্রতিটিতে সর্বোচ্চ ৩৭৪ জন এবং বাকি ৪টি কোচের প্রতিটিতে সর্বোচ্চ ৩৯০ জন যাত্রী পরিবহনের সক্ষমতা রয়েছে। সেই হিসাবে প্রতিটি মেট্রোরেল দুই হাজার ৩০৮ জন যাত্রী পরিবহন করা যাচ্ছে। ফলে ঘণ্টায় ৬০ হাজার এবং দৈনিক পাঁচ লাখ যাত্রী পরিবহন করা সম্ভব হচ্ছে। মেট্রো ট্রেনের ঘণ্টায় সর্বোচ্চ গতিবেগ থাকবে ১০০ কিলোমিটার।
পূর্ণতা পেল মেট্রোরেল, বাঁচবে লাখ লাখ কর্মঘণ্টা- ফাইল ফটো
মেট্রোরেলে ‘সিঙ্গেল জার্নি টিকিট’ ও ‘এমআরটি পাস’ ব্যবহার করে যাতায়াত করা যাবে। র্যাপিড পাস ব্যবহার করেও যাত্রীসাধারণ স্বাচ্ছন্দ্যে মেট্রোরেলে যাতায়াত করতে পারবেন। টিকিট অফিস মেশিন (টিওএম) থেকে টিকিট বিক্রয়কারীর সহায়তায় সিঙ্গেল জার্নি টিকিট এবং এমআরটি পাস কেনা যাবে। টিকিট ভেন্ডিং মেশিন (টিভিএম) থেকে যাত্রীরা নিজেই স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতিতে সিঙ্গেল জার্নি টিকিট এবং এমআরটি পাস টপ-আপ করতে পারবেন।
মোবাইল ও ওয়েব অ্যাপ্লিকেশন্সের মাধ্যমেও এমআরটি পাস টপ-আপ করা যায়। ভ্রমণ-দূরত্ব অনুযায়ী সরকার নির্ধারিত ভাড়া পরিশোধ করে সিঙ্গেল জার্নি টিকিট কেনা যায়। এমআরটি পাস ও র্যাপিড পাস থেকে ভ্রমণ-দূরত্ব অনুযায়ী সরকারের নির্ধারিত ভাড়া কাটা হয়। যেকোনো সময় যাত্রী এমআরটি পাস ফেরত দিয়ে জমানতের অর্থ ও অব্যবহৃত অর্থ ফেরত নিতে পারেন।
এমআরটি পাস হারিয়ে গেলে বা নষ্ট হয়ে গেলে রেজিস্টার্ড কার্ডের বাহককে জামানত পরিশোধ করে নতুন এমআরটি পাস নেয়ার নিয়ম আছে। এক্ষেত্রে অব্যবহৃত অর্থ স্বয়ংক্রিয়ভাবে নতুন এমআরটি পাসে স্থানান্তরিত হয়। এমআরটি পাস হারিয়ে গেলে নিকটস্থ স্টেশনের টিওএম অপারেটরকে অবহিত করে রেজিস্টার্ড কার্ডের অবৈধ ব্যবহার বন্ধ করা যায়।
যাত্রীর প্রতি কিলোমিটারের জন্য ভাড়া ৫ টাকা; সর্বনিম্ন ভাড়া ২০ টাকা এবং সর্বোচ্চ ভাড়া ১০০ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। তবে স্মার্টকার্ডে ভাড়া পরিশোধ করলে ১০ শতাংশ রেয়াত প্রদান; যুদ্ধাহত বীর মুক্তিযোদ্ধাদের বিনা ভাড়ায় মেট্রোরেলে যাতায়াত এবং বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন ব্যক্তিদের প্রতিটি সিঙ্গেল ট্রিপের জন্য বিশেষ রেয়াতের বিষয়ে ব্যবস্থা রয়েছে।