বর্তমান সময়ে খাদ্য সরবরাহের জন্য প্লাস্টিকের তৈরি ওয়ান টাইম কিংবা টেক আউট বক্স ক্রমেই জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। তবে এ বক্সগুলো কতটা নিরাপদ ও স্বাস্থ্যসম্মত, তা নিয়ে কিন্তু রয়েছে অনেক প্রশ্ন। বিশেষজ্ঞদের মতে, প্লাস্টিকের বাক্সগুলো আমাদের স্বাস্থ্যের ওপর যে প্রভাব ফেলে তা কল্পনার চেয়েও বেশি ভয়াবহ।
গবেষকদের ভাষ্যমতে, প্লাস্টিকের বক্সের গরম খাবার খাওয়া স্বাস্থ্যের জন্যে ক্ষতিকর। এর ফলে শরীরে ক্যান্সারের মতো রোগও হতে পারে। শুধু তাই নয়, গরম খাবার বহন করার সময় এসব বক্স থেকে যেসব বিষাক্ত পদার্থ নির্গত হয় তা হরমোনের ব্যাঘাত, বন্ধ্যাত্ব, মস্তিষ্কের বিকাশের ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলে। এমনকি ডায়াবেটিস এবং স্থূলতার মতো সমস্যা সৃষ্টিরও একটি কারণ এ বক্সগুলো।
হার্ভার্ড মেডিকেল স্কুল কর্তৃক হার্ভার্ড হেলথ পাবলিশিংয়ের একটি নিবন্ধে উল্লেখ করা হয়, যখন প্লাস্টিক তাপের সংস্পর্শে আসে তখন অধিক মাত্রায় দ্রুত ক্ষরণ হতে পারে। ফলে প্লাস্টিকের বক্সে থাকা খাবার খাওয়ার ফলে আমরা খাবারের সঙ্গে অনেক ক্ষতিকারক রাসায়নিকও গ্রহণ করি।
এর কারণ প্লাস্টিকের বক্সে যখন গরম খাবার রাখার হয়, তখন গরম খাবারের তাপের কারণে প্লাস্টিকের অনেক ক্ষতিকারক উপাদান খাবারে প্রবেশ করে। বিশেষজ্ঞদের মতে, খাদ্য শৃঙ্খল জুড়ে হাজার হাজার প্লাস্টিক পণ্য পাওয়া গেলেও আমরা সেগুলোর সম্পর্কে খুব কমই জানি।
প্লাস্টিকের বক্সে পাওয়া ক্ষতিকর যৌগগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো থ্যালেটস। থ্যালেটসের কারণে প্লাস্টিক আরও টেকসই এবং নমনীয় হয়ে থাকে। ইউএস সেন্টারস ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশন (সিডিসি) দ্বারা পরিচালিত একটি গবেষণায় দেখা যায়, এই উপাদানটির কারণে মানুষের প্রজনন ক্ষমতা হ্রাস পায় এবং স্নায়বিক সমস্যা এবং হাঁপানির সমস্যাও সৃষ্টি করে।
গরম খাবারের তাপের কারণে খাবারে প্রবেশ করা প্লাস্টিকের আরেকটি ক্ষতিকারক রাসায়নিক উপাদান হলো বিসফেনল-এ। এটি ‘বিপিএ’ নামেও বেশি পরিচিত। ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের মাইক্রোবায়োলজি বিভাগের অধ্যাপক মাহবুব হোসেনের মতে, বিসফেনল জীবাণুমুক্ত ও স্তন ক্যান্সারের অন্যতম কারণ। তিনি বলছেন, এই রাসায়নিক (বিসফেনল) শরীরের হরমোনের সঙ্গে মিশে বন্ধ্যাত্ব এবং অনেক ক্ষেত্রে স্তন ক্যান্সার সৃষ্টি করে।
যেহেতু বিপিএ নবজাতক এবং শিশু মস্তিষ্ক, প্রজনন ক্ষমতা হ্রাসের কারণ তাই প্রস্তুতকারকরা প্লাস্টিকের বক্সগুলো বিপিএ ফ্রি করার জন্যে বিসফেনল-এ এর পরিবর্তে প্লাস্টিকের বক্সে বিসফেনল এস (বিপিএস) এবং বিসফেনল (বিপিএফ) ব্যবহার করছেন।
তবে এতে প্লাস্টিকের বক্সের গুণগত মানের যে উন্নতি হচ্ছে না, তাও জানিয়েছেন গবেষকরা। কারণ বিভিন্ন গবেষণায় স্তন ক্যান্সার, প্রজনন ক্ষমতার হ্রাসসহ বিভিন্ন হরমোনজনিত সমস্যার কারণ হিসেবে বিসফেনলের নাম উঠে এসেছে।
বাংলাদেশ সোসাইটি অব সেফ ফুডের সভাপতি ড. মোহাম্মদ রফিকুল ইসলাম গণমাধ্যমকে জানান, প্লাস্টিক বক্সে বহন করা গরম খাবার খাওয়ার ফলে যেসব স্বাস্থ্যগত সমস্যা দেখা দেয় তা বহু বছর ধরে বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে। তবে বাংলাদেশের মানুষ খাবার প্যাকেটজাতকরণের জন্যে প্লাস্টিকের প্যাকেজিংয়ের উপর অনেকাংশেই নির্ভরশীল বলেও স্বীকার করেন তিনি।
তিনি জানান, রেস্তোরাঁয় থাকা অবশিষ্ট খাবার সাধারণত গরম না হওয়ায় গ্রাহকরা প্লাস্টিকের বক্সে খাবার নিয়ে গেলেও তা তেমন ঝুঁকিপূর্ণ নয়।
ব্র্যাকের অধ্যাপক মাহবুব হোসেন বলেন, সহজলভ্য এবং সাশ্রয়ী বলে রেস্তোরাগুলো খাবার প্যাকেটজাতের জন্যে প্লাস্টিকের বক্স ব্যবহার করে। তবে অ্যালুমিনিয়াম ফয়েল কন্টেইনারগুলোও বেশ সাশ্রয়ী এবং গরম খাবার সরবরাহের জন্য প্লাস্টিকের বক্সের একটি ভাল বিকল্প।
এদিকে ডা. মোহাম্মদ রফিকুল ইসলাম মনে করেন এই সমস্যার সর্বোত্তম সমাধান হলো প্লাস্টিক পণ্যের মাধ্যমে গরম খাবার পরিবেশনে যে স্বাস্থ্যঝুঁকি রয়েছে সে সম্পর্কে জনসচেতনতা সৃষ্টি করা।
তিনি জানান, শহরাঞ্চলের মানুষ বছরের পর বছর ধরে গরম খাবারের জন্য প্লাস্টিকের বক্স ব্যবহার করে আসছে।
তিনি আরও জানান, প্লাস্টিক পণ্য থেকে গরম খাবার খাওয়ার সঙ্গে সম্পর্কিত স্বাস্থ্য সংক্রান্ত বিষয়ে সকলের সচেতন হওয়া দরকার। রেস্তোরাঁর মালিক এবং কর্মীরা যে তাদের গ্রাহকদের স্বাস্থ্য ঝুঁকির মধ্যে ফেলছেন সে সম্পর্কে তাদের সচেতন করার মাধ্যমেই এর শুরু করাটা শ্রেয়।
প্লাস্টিকের খাদ্য পাত্রে মারাত্মক ক্ষতিকর প্রভাব থাকা সত্ত্বেও বাংলাদেশ খাদ্য নিরাপত্তা কর্তৃপক্ষের নির্দেশিকা বিশেষভাবে প্লাস্টিকের প্যাকেজিং সম্পর্কে কিছু উল্লেখ নেই। তবে ক্ষতিকর রাসায়নিক পদার্থ থাকা বক্সে পণ্য ব্যবহারের বিরুদ্ধে সতর্ক করে।