পবিত্র মাহে রমজানের প্রথম রাত। রোজা রাখার উদ্দেশ্যে একসঙ্গে সেহরিতে বসেছে পুরো পরিবার। একটু পরই ফজরের নামাজ। এমনই সময় হঠাৎ গোটা-কয়েক বোমা এসে পড়ল বাড়ির ছাদে। নিমেষেই রক্তাক্ত গোটা মেঝে। নিরীহ মানুষগুলোর প্রাণহীন দেহ ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়ল পুরো ঘরে। রমজানের প্রথম দিনে এমনই দৃশ্য দেখল সেন্ট্রাল গাজার এক হতভাগ্য পরিবার। সকালে আরও কয়েকটি স্থানে বিমান হামলা। আরও রক্ত, আরও লাশ। এর আগে কখনো এমন রমজান দেখেনি ক্ষুধা, হামলা এবং অবরোধ সব মিলিয়ে- এবার ‘ঐতিহাসিক’ রমজানের সাক্ষী হচ্ছে অবরুদ্ধ গাজা।
সোমবার সেহরির সময় ওই হামলায় একই পরিবারের ১৬ জন নিহত হয়েছে। পাশাপাশি ডজনখানেক নিরীহ ফিলিস্তিনি আহত হয়েছে। নিহতদের মধ্যে অধিকাংশই নারী ও শিশু। আলজাজিরা
রমজানের প্রথম দিনেই অবরুদ্ধ গাজার বেশ কয়েকটি স্থানে হামলা চালিয়েছে ইসরাইলের সেনাবাহিনী। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছে, অধিকাংশ হামলাই সেহরি এবং ফজরের নামাজের ওয়াক্তে হয়েছে। গাজায় এমন একটি পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে যে, প্রতিটি পরিবারেই একজন করে শহিদ আছেন। রাফাহ শহরের পূর্বে আল-জেনিনা এলাকায় বোমা হামলা চালিয়েছে ইসরাইল। সেই এলাকার বারাকাত পরিবারের বাড়িতে বোমা হামলা চালিয়েছে তারা।
সেখানে তিনজনসহ আহত হয়েছে আরও কয়েকজন। একই শহরের আল-সালাম পাড়ায় মিসর-ফিলিস্তিন সীমান্তের কাছে কৃষিজমিকে লক্ষ্য করে আর্টিলারি ভারী বোমাবর্ষণ করেছে ইসরাইলি বাহিনী। এমনকি খান ইউনিস শহরের দক্ষিণাঞ্চলেও হিংসাত্মক বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে। রমজান শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পূর্ব জেরুজালেমের আল-আকসাকে ঘিরেও শুরু হয়েছে উত্তেজনা। সেখানে তারাবির নামাজ আদায় করতে যাওয়া ফিলিস্তিনি মুসল্লিদের পথ আটকায় ইসরাইলি পুলিশ। তাদের মসজিদে প্রবেশে বাধা দেয় তারা। একপর্যায়ে ইসরাইলের পুলিশরা মারধর শুরু করে এবং ধাক্কা দিয়ে বের করে দেয় ফিলিস্তিনি ধর্মপ্রাণ মুসলিমদের। সোমবার এই ভিডিও প্রকাশিত হলে ব্যাপক সমালোচনা শুরু হয়। এরপর আল-আকসায় ৪০ বছর বয়সের ঊর্ধ্বে মুসল্লিদের নামাজ পড়তে অনুমতি দেওয়া হয়। অথচ বছরের এই সময়টাতেই সেজে ওঠে জেরুজালেমের রাস্তা। রমজান মাস উপলক্ষ্যে চলে নানা আয়োজন। পথ-ঘাটে চলে আলোকসজ্জা। কিন্তু এ বছর জেরুজালেমের ওল্ড সিটির সেই রাস্তা বিবর্ণ। মানুষের আনাগোনাও কম। গাজায় নিজেদের নিপীড়িত ভাই-বোনদের কথা চিন্তা করে অনেকেই ব্যথিত।
উম্ম আমার নামে এমনই একজন বাসিন্দা জানিয়েছেন, ‘আমরা তো ইফতার করব। কিন্তু গাজায় হয়তো হাজার হাজার মানুষ কিছুই খেতে পারবে না। সেখানে দুর্ভিক্ষের পরিস্থিতি।’ এছাড়াও অধিকৃত পশ্চিম তীরে হামলা চালিয়েছে ইসরাইলি বাহিনী। সেখানকার তুলকারেম শহর, বালাতা ক্যাম্প, নাবলুসের পূর্বে বুলডোজার বোমায় আঘাত হেনেছে ইসরাইলের সামরিক বাহিনী। এমনকি বেথলেহেমের দক্ষিণ-পূর্বে তুকু শহরের প্রবেশপথ বন্ধ করে দিয়েছে তারা। শুধু হামলা নয় চরম খাদ্যাভাবে গাজার পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ।
দুর্ভিক্ষকবলিত অঞ্চলটি ক্ষুধার জ্বালা দিন দিন বেড়েই চলেছে। অতিরিক্ত খাদ্যঘাটতিতে ইতোমধ্যেই অবরুদ্ধ অঞ্চলটির প্রায় ২৫ জন শিশু, দুই বৃদ্ধ এবং এক যুবতীর মৃত্যু হয়েছে। অন্য দিকে প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহুর দাবি, গাজায় নিহত ফিলিস্তিনিদেন মধ্যে ১৩,০০০ ‘সন্ত্রাসী’ সদস্য ছিল।
রোববার জার্মান মিডিয়া সংস্থা অ্যাক্সেল স্প্রিংগারের সাথে একটি সাক্ষাৎকারের সময় এ কথা বলেন তিনি। নেতিনয়াহুকে উদ্ধৃত করে জার্মানের সংবাদপত্র বিল্ড জানিয়েছে, ‘আমরা বিজয়ের খুব কাছাকাছি… একবার আমরা রাফাতে অবশিষ্ট সন্ত্রাসী ব্যাটালিয়নের বিরুদ্ধে সামরিক পদক্ষেপ শুরু করলে, যুদ্ধের নিবিড় পর্যায় শেষ না হওয়া পর্যন্ত এটি কেবল কয়েক সপ্তাহের প্রশ্ন।’
যুদ্ধবিরতি না হওয়ায় এখন গাজাবাসী নানা ধরনের রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। দীর্ঘস্থায়ী কিডনি রোগে আক্রান্ত অবরুদ্ধ অঞ্চলটির এক হাজার ১০০ রোগী। তাদের অতিদ্রুত ডায়ালাইসিসের প্রয়োজন। কিন্তু ইসরাইলের অবরোধের কারণে সঠিক চিকিৎসা পাচ্ছে না। ফলে বোমার না মরলেও রোগে মারা যাবে অসহায় ফিলিস্তিনি। একজন ফিলিস্তিনি বলেছেন, ‘আমার পরিবারের তিন সদস্যের অবশ্যই তাদের রক্ত পরিষ্কার করা উচিত। হাসপাতালে যাত্রা একটি চ্যালেঞ্জ। খাদ্য ও পুষ্টির অভাব এবং বিশুদ্ধ পানির অভাব সবই আমাদের দুর্ভোগ বাড়িয়ে দেয়। আমরা ওজন হারাচ্ছি এবং ক্লান্তি ও অবসাদে আক্রান্ত। অনেক রোগীর এখন রক্তের প্রয়োজন, যা পাওয়া যাচ্ছে না।’