সেপ্টেম্বর ৪, ২০২৩ ৯:৫৫ পূর্বাহ্ণ
বাংলাদেশের আগামী দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনকে ঘিরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা রাষ্ট্র এবং সংস্থাগুলো বেশ তৎপর। কয়েক মাস ধরে যুক্তরাষ্ট্র ছাড়াও পশ্চিমা বিভিন্ন দেশ, চীন, ভারত, ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ নানা মহল থেকে আসন্ন নির্বাচন ঘিরে নানা বক্তব্য ও পরামর্শ এসেছে। সফরের পর সফরে আসছেন কূটনীতিকরা। ভিসানীতি, বিবৃতি, কংগ্রেসম্যানদের বক্তব্য, সাংবিধানিক পরিবর্তনসহ নানা আলোচনার ডালপালা বিস্তৃত হচ্ছে।
দেশের প্রধান দুই রাজনীতিক দল ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ এবং বিরোধী শক্তি বিএনপি তাদের কূটনৈতিক তৎপরতা জানান দিয়ে চলছে। কিন্তু এখনো দেশের সব রাজনৈতিক দলের অংশগ্রহণে নির্বাচন নিয়ে শঙ্কা রয়েই গেছে।
এমন বাস্তবতায় দেশি-বিদেশি বিভিন্ন মহল থেকে অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের কথা বলা হলেও নির্বাচন কমিশন বলছে, জনগণ স্বাধীনভাবে ভোট দিতে পারলেই সেটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন হবে। ইসির শনিবারের বক্তব্যে রাজনৈতিক দলের অংশগ্রহণের কথা উহ্য রেখে জনগণের ভোটাধিকারের বিষয়টি সামনে আনায় এ নিয়ে কথা বলছেন অনেকেই।
অন্যদিকে দেশের আসন্ন নির্বাচনকে ঘিরে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের তৎপরতার পরিপ্রেক্ষিতে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের প্রস্তুতিতেও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের বিশেষ নজরে রয়েছে। তারা মনে করেন, গ্রহণযোগ্য নির্বাচন না হলে নির্বাচন-উত্তর সময়ে দেশ জটিলতায় পড়তে পারে। কেউ কেউ বলছেন, দেশের নাগরিকদের মতামতের ভিত্তিতে সরকার গঠন এবং পরিচালিত হলে এই সংকটময় পরিস্থিতির সৃষ্টি হতো না। আগামী নির্বাচন সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক হলে ভবিষ্যতে সংকট কমে আসবে।
আসন্ন নির্বাচনকে ঘিরে বিদেশিদের এত তৎপরতা নির্বাচনে কী প্রভাব ফেলতে পারে জানতে চাইলে সাবেক রাষ্ট্রদূত হুমায়ুন কবির গণমাধ্যমকে বলেন, বিদেশিরা আমাদের ভালো-মন্দ পরামর্শ দিতে পারে। কিন্তু নির্বাচন কেমন হবে, কতটা অংশগ্রহণমূলক এবং অবাধ ও সুষ্ঠু হবে এটা আমাদের বিষয়। নির্বাচন গ্রহণযোগ্য না হলে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে নির্বাচনোত্তর পরিস্থিতিতে দেশ জটিলতার মধ্যে পড়ার আশঙ্কা থাকবে।
তিনি বলেন, নির্বাচন একটি প্রক্রিয়া, একদিনের ঘটনা নয়। তাই নির্বাচনের প্রক্রিয়া নির্বাচন কেমন হবে তার ইঙ্গিত দেয়। সেই প্রক্রিয়া কী পরিমাণে হচ্ছে, কতটা অংশগ্রহণমূলক, কতটা স্বাধীনভাবে মানুষ মতপ্রকাশ করতে পারে, কতটা প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক হবে-সেটি আগে থেকে আন্দাজ করা যাবে না। পরিবেশের ওপর নির্ভর করে তার ইঙ্গিত পাওয়া যেতে পারে।
নাগরিক সংগঠন সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার এ বিষয়ে রাজনীতিবিদদের সমালোচনা করেন। চলমান সংকটের জন্য তাদের দায়ী করে তিনি বলেন, আমাদের কাছে দুটো প্রশ্ন আছে। একটি ভোটাধিকার এবং আরেকটি মানবাধিকারের। মানবাধিকারের বিষয়ে বিদেশিরা সোচ্চার হতেই পারে। এটি অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ নয়। কিন্তু সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, দেশের নাগরিকরা কী বলেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত দেশের রাজনীতিবিদরা এমন পর্যায়ে পৌঁছেছেন যে, তাদের কাছে নাগরিকরা কী বলল তাতে কিছু আসে যায় না। নাগরিকদের মতামতের কোনো গুরুত্বই নেই। এটার পরিবর্তন হওয়া দরকার। নাগরিকদের মতামতের গুরুত্ব নেই বলেই আজকের এই সংকট। দেশের নাগরিকদের মতামতের ভিত্তিতে যদি সরকার গঠিত, পরিচালিত হতো তাহলে আমরা এই সংকটে পড়তাম না। রাজনীতিবিদরা দেশের জনগণকে উপেক্ষা করে বিদেশিরা কী বলছে, সেটাকেই দেশের জন্য হুমকি বা সহায়ক মনে করে। এটি অত্যন্ত দুঃখজনক।
বাংলাদেশের আসন্ন নির্বাচনের বিষয়ে পশ্চিমা রাষ্ট্রগুলো বিশেষ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের চিন্তায় পরিবর্তন এসেছে বলে মনে করেন আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষক অধ্যাপক ইমতিয়াজ আহমেদ। তিনি গণমাধ্যমকে বলেন, পশ্চিমাদের গণতন্ত্র ও মানবাধিকার নিয়ে কথা বলা নতুন নয়। গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, ঘাটতি বাংলাদেশের আছে। সেটি অস্বীকার করলে চলবে না। সরকার বলছে, তারাও একটি সুষ্ঠু নির্বাচন চায়। পশ্চিমা দেশগুলো এখন মনে করে, সব দলের অংশগ্রহণ বা সংবিধান পরিবর্তনের মতো বিষয়গুলো অতটা গুরুত্বপূর্ণ নয়, যতটা জনগণ ভোট দিতে পারছে কিনা তা। উদাহরণ হিসাবে বলতে হয়, গাজীপুর সিটির মতো নির্বাচন হলে তাদের কোনো আপত্তি নেই। অন্যদিকে বিরোধী শক্তির মূল দাবি তত্ত্বাবধায়ক সরকার। পশ্চিমা দেশ বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র সেখান থেকেও সরে গেছে বলে মনে হয়।
এই বিশ্লেষক বলেন, আরেকটি বিষয় উল্লেখযোগ্য। পশ্চিমা দেশগুলো বাংলাদেশের বিষয়ে যতটা বলছে, তার সঙ্গে সঙ্গে রাশিয়া এবং চীনও তাদের অবস্থান ব্যাখ্যা করেছে। যা আগে ছিল না। এ কারণে পশ্চিমারাও জানে, বেশি বলপ্রোয়গ করলে স্বাভাবিকভাবে ক্ষমতাসীনরা তাদের বাইরে অন্য দেশের সঙ্গে সম্পর্ক আরও নিবিড় করার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করবে। যেটি পদ্মা সেতুর ক্ষেত্রে দেখেছি।
এদিকে নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে অনড় অবস্থানে রয়েছে দেশের প্রধান দুই রাজনৈতিক দল ও তাদের মিত্ররা। সংবিধান মেনে বর্তমান সরকারের অধীনে নির্বাচনে কোনো ছাড় দেওয়া হবে না বলে সাফ জানিয়ে দিয়েছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। নির্বাচনের প্রস্তুতিও শুরু করে দিয়েছে দলটি। অন্যদিকে বর্তমান সরকারের পদত্যাগ এবং নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়া কোনো নির্বাচনে না যাওয়ার স্পষ্ট ঘোষণা দিয়েছে বিএনপি। এ নিয়ে একদফা আন্দোলনেও নেমেছে তারা।
দুই দলের অনড় অবস্থানের কারণে দেশের সব রাজনৈতিক দলের অংশগ্রহণে আগামী জাতীয় নির্বাচন নিয়ে শঙ্কা দেখা দিয়েছে। এমন প্রেক্ষাপটে বড় রাজনৈতিক দলগুলোর অংশগ্রহণ ছাড়া নির্বাচন হলে তা জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে সর্বজন গ্রহণযোগ্যতা পাবে না বলেও মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। যদিও প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়াল শনিবার এক অনুষ্ঠানে বলেছেন, আমাদের রাজনৈতিক ও গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি সর্বোচ্চ ধাপে পৌঁছায়নি। তবে জনগণ সত্যিকার অর্থে স্বাধীনভাবে তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারলে সেটি মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য হবে।
সাবেক সিনিয়র সচিব আবু আলম মো. শহীদ খান এ বিষয়ে গণমাধ্যমকে বলেন, নির্বাচনে জনগণের অংশগ্রহণ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তবে কত শতাংশ জনগণের অংশগ্রহণ হলে সেটা অংশগ্রহণমূলক হবে-এটা সিইসি পরিষ্কার করবেন।
অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনে সব দলের আস্থার জায়গা তৈরি করার ক্ষেত্রে কমিশনের দায় আছে কিনা জানতে চাইলে আবু আলম মো. শহীদ খান বলেন, আস্থার জায়গা এই নির্বাচন কমিশন তৈরি করতে পারবে না। কারণ বিএনপি ও তাদের জোট এবং জাতীয় পার্টি ইতোমধ্যে প্রকাশ করে দিয়েছে যে, নির্বাচন কমিশনের প্রতি তাদের আস্থা নেই। এছাড়া বর্তমান সরকারের অধীনে এই কমিশন অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন করতে পারবে বলেও আপাতদৃষ্টিতে মনে হচ্ছে না। তাদের করা নির্বাচন দেখেও সেটা বোঝা যাচ্ছে। ১০, ১২, ১৫ শতাংশ ভোটার ভোট দিতে আসে।
এ বিষয়ে বদিউল আলম মজুমদার মনে করেন, প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক নির্বাচন না হলে সেটা কোনো নির্বাচনই হবে না। নির্বাচন হলো বিকল্পের মধ্য থেকে যোগ্যকে বেছে নেওয়া। বিকল্প না থাকলে সেটা ভালো নির্বাচন নয়। সিদ্ধ পানি মিনারেল ওয়াটারের বিকল্প হতে পারে, কিন্তু মিনারেল ওয়াটারের বিকল্প ট্যাপের পানি হতে পারে না। আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে জাতীয় পার্টি বিকল্প হতে পারে না। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে বিএনপি হবে সত্যিকারের প্রতিদ্বন্দ্বী।
তিনি আরও বলেন, গ্রহণযোগ্য হতে হলে নির্বাচন হতে হবে সত্যিকার অর্থে প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক। যেখানে দলগুলোর সমান সুযোগ থাকবে। সাধারণ মানুষ বা ভোটারদের সামনেও বিকল্প থাকবে। একতরফা নির্বাচন কোনো নির্বাচনই নয়। এটা করলে তা হবে আত্মঘাতী। যা দেশের জন্যও শুভ নয়।