মালয়েশিয়ায় শ্রম অভিবাসনে অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে। এ অভিযোগ উঠেছে খোদ মালয়েশিয়ার সরকারের বিরুদ্ধে। বাংলাদেশে রিক্রুটিং এজেন্টদের সিন্ডিকেট এবং মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশ হাইকমিশনের বিরুদ্ধেও উঠেছে অনিয়মের অভিযোগ।
অনিয়মের কারণে কর্মীদের কাছ থেকে অভিবাসন ব্যয় বাবদ নির্ধারিত সীমার অধিক অর্থ নেওয়া হচ্ছে। বিষয়টি নিয়ে আন্তর্জাতিক মহলের চাপের পর মালয়েশিয়া কাল থেকে বিদেশি কর্মী নিয়োগ বন্ধ করে দিচ্ছে। বাংলাদেশসহ ১৫টি ‘সোর্স কান্ট্রি’ থেকে কর্মী নিয়ে থাকে মালয়েশিয়া। এদিকে মালয়েশিয়ার সরকারের কর্মী বন্ধের সিদ্ধান্ত এক মাস আগে বাংলাদেশকে জানালেও বিষয়টি প্রথমে গোপন রাখা হয়।
শেষ মুহূর্তে বিষয়টি জানানো হলে অনুমোদন পাওয়ার পরও প্রায় ২০ হাজার কর্মীর নির্ধারিত সময়ের মধ্যে ফ্লাইট পেতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। বিষয়টি নিয়ে সৃষ্টি হয়েছে এক অনিশ্চিত পরিস্থিতির। জাতিসংঘের চারজন স্বাধীন বিশেষজ্ঞ অভিযোগ করেছেন, কর্মী নিয়োগ প্রক্রিয়া শুরুই হয় মালয়েশিয়ার মানবসম্পদ ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে ঘুস দেওয়ার মাধ্যমে।
ঘুস দেওয়ার মাধ্যমে ভুয়া নিয়োগকর্তারা কর্মীর চাহিদাপত্রের অনুমোদন নিয়ে যায়। তারা এও অভিযোগ করেন যে, বাংলাদেশের রিক্রুটিং এজেন্টদের একটি সিন্ডিকেটকে এবং কুয়ালালামপুরে বাংলাদেশ হাইকমিশনেও কর্মীদের ঘুস দিতে হয়। ফলে বিমান টিকিট, পাসপোর্ট ও ভিসা বাবদ দুই দেশের সরকারের মধ্যে সম্পাদিত সমঝোতা স্মারক মোতাবেক নির্ধারিত ৭২০ ডলারের চেয়ে অনেক বেশি অর্থ কর্মীদের কাছ থেকে নেওয়া হয়।
এ অর্থের পরিমাণ সাড়ে চার হাজার থেকে ছয় হাজার ডলার পর্যন্ত হয়ে থাকে বলে তাদের অভিযোগ। বিষয়টি জানিয়ে ২৮ মার্চ মালয়েশিয়া ও বাংলাদেশ সরকারের কাছে জাতিসংঘের চার স্বাধীন বিশেষজ্ঞ চিঠি দেন। কিন্তু কোনো দেশই ৬০ দিনের মধ্যে চিঠির জবাব না দেওয়ায় ২৬ মে জাতিসংঘের মানবাধিকার হাইকমিশন চিঠি প্রকাশ করে দিয়েছে। বিষয়টি নিয়ে জাতিসংঘ মানবাধিকার কাউন্সিলে আলোচনা হবে বলেও চিঠিতে উল্লেখ করা হয়।
এদিকে বেসামরিক বিমান চলাচল ও পর্যটনমন্ত্রী ফারুক খান বৃহস্পতিবার এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, এ প্রক্রিয়ায় জড়িত রিক্রুটিং এজেন্ট এবং অন্যদের এক মাস আগে মালয়েশিয়ার সরকার জানিয়ে দিয়েছে যে, ৩১ মের মধ্যে অনুমোদন পাওয়া ২০ হাজার কর্মীর সবাইকে মালয়েশিয়ায় যেতে হবে। কিন্তু আমাদের জানানো হয়েছে মাত্র তিনদিন আগে। এ তিনদিনে প্রতিদিন বিমান ৩/৪টা এক্সট্রা ফ্লাইটের ব্যবস্থা করেছে। এরই মধ্যে মালয়েশিয়া থেকে একটি কোম্পানি উড়োজাহাজ ভাড়া করেছে। তারা আমাদের কাছে পারমিশন চেয়েছে বৃহস্পতিবার। বৃহস্পতিবারই সন্ধ্যার মধ্যে পারমিশন তাদের দিয়ে দিয়েছি। এর থেকে এফিসিয়েন্ট হবে কি না জানি না।
মন্ত্রী আরও বলেন, আমরা আমাদের পক্ষে বিমান ও সিভিল এভিয়েশন যতটুকু করার আমরা করছি। তবে আমি মনে করি, এ ব্যাপারে আমাদের যদি আরও ১০/১৫ দিন আগে জানানো হতো, টিকিটের দাম এতটা বাড়ত না বলে মনে করি। বিমান বর্তমানে হজ ফ্লাইট পরিচালনা করছে। এর মধ্যে আমরা এটা অ্যাকোমোটেড করেছি।
মালয়েশিয়া ২০০৮ সালে বাংলাদেশ থেকে কর্মী নিয়োগ বন্ধ রাখার পর ২০১২ সালে শ্রমবাজার চালুর সমঝোতা স্মারক সই হয়। তখন সরকারি পর্যায়ে প্রাথমিকভাবে ৩০ হাজার কর্মী নেওয়ার কথা ছিল। কিন্তু মালয়েশিয়া ২০১২ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত চার বছরে মাত্র আট হাজার কর্মী নেয়। ফলে ২০১৬ সালে দুই দেশের মধ্যে সই হয় জিটুজি প্লাস চুক্তি। ফলে মালয়েশিয়া ও বাংলাদেশের সিন্ডিকেট এ প্রক্রিয়ায় যুক্ত হয়। ২০১৭-২০১৮ সালে প্রায় ২ লাখ ৭৮ হাজার কর্মী মালয়েশিয়া যায়। তখনই অনিয়মের অভিযোগ ওঠে।
মালয়েশিয়ার সরকার ২০১৯ সালে এ কর্মসূচিও স্থগিত করে। ২০২১ সালের ১৯ ডিসেম্বর পুনরায় সমঝোতা স্মারক সই হয়। আবারও মালয়েশিয়া সিন্ডিকেটের মাধ্যমে সীমিতসংখ্যক রিক্রুটিং এজেন্সিকে লোক পাঠানোর অনুমতি দেয়। মালয়েশিয়ায় কর্মী পাঠানোর ক্ষেত্রে অনিয়মের কথা অনুধাবন করে যুক্তরাষ্ট্র জনশক্তির মাধ্যমেও মানব পাচার হতে পারে বলে তাদের প্রতিবেদনে অন্তর্ভুক্ত করে। বাংলাদেশ তখন মানব পাচারবিরোধী কঠোর আইন করলে বাংলাদেশ মানব পাচারের র্যাংকিং ঠিক রাখতে সমর্থ হয়।
মালয়েশিয়ার হাইকমিশনার হাজনাহ মো. হাশিম বুধবার সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, মালয়েশিয়ার সরকার অনিয়ম দূর করার জন্য বিদেশি কর্মী নিয়োগ বন্ধ করেছে। এ সময়ে অভ্যন্তরীণ নিয়মনীতি ঠিক করা হবে। ভবিষ্যতে চাহিদার বিপরীতে লোক নিয়োগ করবে মালয়েশিয়া।
তিনি আরও বলেন, শ্রমবাজারের সিন্ডিকেট দুই দেশের সরকারের নিয়ন্ত্রণের বাইরে। বাংলাদেশের কোনো কর্মী যেন মালয়েশিয়ায় গিয়ে চাকরির নিশ্চয়তা চায়, এ লক্ষ্যে আপাতত বিদেশি কর্মী নিয়োগ বন্ধ করা হচ্ছে।