এপ্রিল ১৩, ২০২৪ ৫:৫০ পূর্বাহ্ণ
বান্দরবানের রুমা ও থানচিতে ব্যাংকে হামলা চালিয়ে এখন আলোচনায় পাহাড়ের অপেক্ষাকৃত নতুন এই সশস্ত্র সংগঠন কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট (কেএনএফ)। সংগঠনটি কেন এমন বেপরোয়া হয়ে উঠলো? এই হামলার নেপথ্যে কী? কী চায় কেএনএফ?
পার্বত্য চট্টগ্রামে ৭০-এর দশকে আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনের দাবিতে সশস্ত্র লড়াই শুরু করে জনসংহতি সমিতির (জেএসএস) সশস্ত্র শাখা শান্তি বাহিনী। দুই দশক ধরে চলা এই লড়াইয়ে নানা সহিংসতার ঘটনা ঘটে। কিন্তু এ সময় পার্বত্য তিন জেলার কোথাও দিনদুপুরে প্রকাশ্যে শান্তি বাহিনী ব্যাংক ডাকাতির ঘটনা ঘটিয়েছে, এর কোনো নজির নেই। তাই সম্প্রতি বান্দরবানের দুই ব্যাংকের তিন শাখায় দুইদিন ধরে কেএনএফের ডাকাতির ঘটনা এবং একেবারে নির্বিঘ্নে দুর্বৃত্তদের চলে যাওয়ার বিষয়গুলো বিস্ময়কর বটে।
ব্যাংক ডাকাতি না হলেও অন্য স্থান থেকে ব্যাংক ডাকাতি করে এসে পাহাড়ে বহাল তবিয়তে আশ্রয় নেয়ার নজির অবশ্য আছে। এটা ঘটেছিল ১৯৭১ সালের দিকে। পার্বত্য চট্টগ্রাম লাগোয়া ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের কয়েকটি রাজ্যে গত শতকের ৫০-এর দশক থেকেই বিভিন্ন সশস্ত্র গোষ্ঠীর তৎপরতা শুরু হয়। এসব গোষ্ঠীর সদস্যরা তৎকালীন পাকিস্তানি শাসক গোষ্ঠীর সহায়তা পেতেন। গোষ্ঠীগুলোর একটি মিজোরামের মিজো ন্যাশনাল ফ্রন্ট (এমএনএফ)। এর প্রধান লালদেঙ্গা ও তার সহকারীরা ১৯৭১ সালে মিজোরামের রাজধানী আইজলের ব্যাংক লুট করেন।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের প্রায় পুরোটা সময় বর্তমান রাঙ্গামাটির জেলা পুলিশ সুপারের বাসভবনের কাছে (তৎকালীন সড়ক ও জনপথ বিভাগের ডাকবাংলো) সপরিবার ছিলেন লালদেঙ্গা। লালদেঙ্গার বাহিনী পাকিস্তানি বাহিনীকে সহায়তা করতো। শুধু তা-ই নয়, মুক্তিযোদ্ধাদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র অবস্থান ছিল। তাদের-রাঙ্গামাটিতে মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক ও জেলা পরিষদের প্রথম নির্বাচিত চেয়ারম্যান গৌতম দেওয়ান এখনো সেসব কথা মনে করতে পারেন।
শুধু গৌতম দেওয়ান নন, স্থানীয় অনেকেই লালদেঙ্গার বাহিনীর তৎপরতার কথা স্মরণে রেখেছেন। তবে ১৯৭১-এর ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ স্বাধীন হলে দ্রুত লালদেঙ্গা তার বাহিনীসমেত রাঙ্গামাটি থেকে চলে যান মিয়ানমারে। ঘটনাক্রমে মিজো নেতা লালদেঙ্গা আর এখনকার কেএনএফের সদস্যরা জাতিগত দিক দিয়ে সমগোত্রীয়। কেএনএফের ব্যাংক ডাকাতির কথায় প্রাসঙ্গিকভাবে উঠে এল লালদেঙ্গার প্রসঙ্গ। কিন্তু এখন সময় ও পরিপ্রেক্ষিত পাল্টেছে। লালদেঙ্গাদের সহযোগিতায় পাকিস্তানি রাষ্ট্রশক্তি ছিল। কিন্তু এখন কেএনএফের এই দুর্বৃত্তপনার বিরুদ্ধে সজাগ এবং কঠোর অবস্থানে সরকার। সেনাপ্রধান এবং পুলিশের প্রধান কেএনএফের বিরুদ্ধে অবস্থানের কথা জানিয়েছেন। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী শুধু হুঁশিয়ারিই দেননি, শান্তি আলোচনার পথও উন্মুক্ত রেখেছেন।
এই শান্তি আলোচনার বিষয়টি বেশ ঘোলাটে। কেএনএফের বিরুদ্ধে যৌথ বাহিনীর অভিযানের মধ্যে ২০২৩ সালের ৩০ মে ‘শান্তি প্রতিষ্ঠা কমিটি’ গঠিত হয়। এর প্রধান বান্দরবান পার্বত্য জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান ক্য শৈ হ্লা। ঐ বছরের জুলাই ও আগস্ট মাসে কমিটির সঙ্গে কেএনএফের কয়েকবার ভার্চ্যুয়াল বৈঠকও হয়। পরে গত নভেম্বরে ও এ বছরের ৫ মার্চ কেএনএফের সঙ্গে শান্তি প্রতিষ্ঠা কমিটির সরাসরি দুটি বৈঠক হয়। সেই বৈঠকে প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর প্রতিনিধিরাও উপস্থিত ছিলেন।
এখন প্রশ্ন হলো, রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণাকারী একদল সশস্ত্র গোষ্ঠীর সঙ্গে আলোচনার জন্য গঠিত কমিটি রাষ্ট্রের কোন সংস্থা বা দফতরের সম্মতিতে তৈরি হলো?
কমিটির প্রধান জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান ক্য শৈ হ্লা বলেন, কোনো দফতর থেকে বলা হয়নি। এলাকার শান্তির কথা ভেবে, মানুষের কথা ভেবে নিজেরাই এই কমিটি করেছি। জেলা পরিষদ তো সরকারেরই অংশ। তাই সেখানে সরকারের সম্মতি আছে বলেই ধরা যায়। আর আমাদের আলোচনায় পুলিশ ও প্রশাসনের লোকজনও থেকেছেন।
শান্তি কমিটির বিষয়ে পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক প্রতিমন্ত্রী কুজেন্দ্র লাল ত্রিপুরা বলেন, আমি এই কমিটির বিষয়ে কিছু জানি না। আমাদের মন্ত্রণালয় থেকে এমন কোনো কমিটি করার বিষয়ে বলা হয়নি।
পাহাড়ে যখন শান্তি বাহিনীর সশস্ত্র তৎপরতা ছিল, তখন সেই এরশাদ সরকার থেকে শুরু করে প্রতিটি সরকারের সময় সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে কমিটি গঠনের মাধ্যমে জেএসএসের সঙ্গে আলোচনা চলেছে। ১৯৯১ সালে খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে বিএনপি সরকার গঠনের পর তৎকালীন যোগাযোগমন্ত্রী অলি আহমদের নেতৃত্বে জাতীয় কমিটি গঠন করে শান্তি আলোচনার উদ্যোগ নেয়া হয়। ঐ কমিটির সদস্য ছিলেন রাশেদ খান মেননসহ সংসদ সদস্যরা। পরে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করার পরও উচ্চপর্যায়ের কমিটি আলোচনা করে। আর ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপস্থিতিতে ঐতিহাসিক পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তিতে বাংলাদেশ সরকারের পক্ষে স্বাক্ষর করেন তৎকালীন জাতীয় সংসদের চিফ হুইপ আবুল হাসানাত আবদুল্লাহ আর জেএসএসের পক্ষে জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় সন্তু লারমা। এখন পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়নে যে কমিটি আছে, সেটিরও প্রধান আবুল হাসানাত আবদুল্লাহ।
রাষ্ট্রীয় অখণ্ডতার প্রশ্ন উত্থাপনকারী একটি সশস্ত্র গোষ্ঠীর সঙ্গে একটি জেলা পরিষদের শান্তি উদ্যোগ কতটুকু যুক্তিযুক্ত? এ প্রশ্নের উত্তরে রাশেদ খান মেনন বলেন, কেএনএফ এবং আমাদের সঙ্গে শান্তি আলোচনা-সমস্ত বিষয় আমার কাছে রহস্যাবৃত বলে মনে হয়। এখানে স্বচ্ছতা নেই।
সরকারের এতটা উচ্চপর্যায়ে না হোক, কেএনএফের সঙ্গে শান্তি আলোচনার বিষয়টি পার্বত্য চুক্তি অনুযায়ী গঠিত আঞ্চলিক পরিষদকে তো অন্তত জানানোর কথা। কারণ চুক্তি অনুযায়ী, পার্বত্য তিন জেলা পরিষদের কর্মকাণ্ডের সমন্বয় করবে আঞ্চলিক পরিষদ। কিন্তু আঞ্চলিক পরিষদ সূত্র জানায়, কোনোদিন এসব আলোচনার বিষয়ে তাদের কিছু জানানো হয়নি।
আঞ্চলিক পরিষদের প্রতি বান্দরবান জেলা পরিষদের এই ‘অভক্তি’র কারণ স্পষ্ট নয়। তবে আঞ্চলিক পরিষদের প্রতি কেএনএফ তাদের বিদ্বেষ ও ঘৃণা প্রকাশ্যেই জানিয়েছে।
কেএনএফের পরিবর্তিত ৬ দফা, কী আছে তাতে?
কোনো গোষ্ঠী যদি নতুন কোনো রাজ্য দাবি করে, তাদের কোনো বঞ্চনা থাকে, তবে এসব তারা কার কাছে করবে? রাষ্ট্র বা সরকারের প্রতিনিধিদের কাছে। কিন্তু কেএনএফের বেলায় একটা ভিন্ন বিষয় দেখা গেছে। তা হলো, তারা সেই ২০২২-এর শুরুর দিক থেকে ফেসবুকে পাহাড়ের ৯ উপজেলা নিয়ে পৃথক রাজ্যের ঘোষণা দেয়। তাদের ফেসবুক পেজে সরকারের কোনো দফতর বা প্রতিষ্ঠানের ওপর নয়, সমস্ত ক্ষোভ আঞ্চলিক পরিষদ, জেএসএস এবং চাকমাদের ওপর চাপায়। এই তিনটি ছাড়া তাদের ঘৃণার আর কোনো জায়গা ছিল না। বিভিন্ন মহল্লায় হামলা চালিয়ে চাকমাদের বিরুদ্ধে ‘প্রতিশোধ’ নেয়ার নানা বার্তা তারা দিতে থাকে। এরই মধ্যে তারা রাঙ্গামাটির বিলাইছড়ি উপজেলার ফারুয়া ইউনিয়নের একটি ত্রিপুরা গ্রামে দুজন জুম চাষিকে হত্যা এবং শিশুসহ কয়েকজনকে আহত করে।
২০২২-এর অক্টোবরে জঙ্গিগোষ্ঠীকে সহযোগিতার অভিযোগ উঠলে কেএনএফের বিরুদ্ধে র্যাবের বিশেষ অভিযান শুরু হয়। এর মধ্যেই গত বছরের মে মাস থেকে শুরু হলো শান্তি আলোচনার উদ্যোগ। এরপর ‘রাজ্যের’ দাবি ছেড়ে কেএনএফ ৬ দফা দিয়ে নতুন আবদার করলো বাঘাইছড়ি, জুরাছড়ি, বরকল, বিলাইছড়ি, রোয়াংছড়ি, রুমা ও থানচি নিয়ে পৃথক প্রশাসনিক ব্যবস্থা প্রণয়নসহ স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল দেওয়ার। এই অঞ্চলের নামও তারা দিয়ে দেয়, ‘কুকি-চিন টেরিটোরিয়াল কাউন্সিল’ বা কেটিসি। শান্তি কমিটির কাছে নতুন ৬ দফা তুলে ধরে কেএনএফ।
কেএনএফের শর্ত, কেটিসির যাবতীয় দাফতরিক কার্যাবলি কোনোভাবেই পার্বত্য জেলা পরিষদসমূহ বা পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদের আওতাধীন থাকবে না।
এখানেই শেষ নয়। কেএনএফ চায়, কেটিসির চেয়ারম্যান হবেন পূর্ণমন্ত্রীর মর্যাদাসম্পন্ন।
কেএনএফ দাবি করে, কুকি–চিন তথা বম, পাংখোয়া, লুসাই, খুমি, ম্রো ও খিয়াং জনগোষ্ঠীর মানুষ পার্বত্য চট্টগ্রামের ভূমিপুত্র। কিন্তু এই ভূখণ্ডে সরকার ও বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর মাধ্যমে বঞ্চনার শিকার।
নিজেদের সঙ্গে অন্য ৫ জাতিগোষ্ঠীকে জড়ালেও এসব জাতিগোষ্ঠীর প্রতিনিধিরা সংবাদ সম্মেলন করে কেএনএফের দাবির সঙ্গে তাদের কোনো সমর্থন নেই বলে জানান।
বম জনগোষ্ঠীর সবচেয়ে বড় সংগঠন বম সোশ্যাল কাউন্সিলের সভাপতি ও কেএনএফের সঙ্গে আলোচনার জন্য গঠিত শান্তি কমিটির সদস্য সচিব জারলাম বম বলেন, এ সংগঠন বা এর কোনো সদস্যেরও কেএনএফের সঙ্গে বিন্দুমাত্র সংশ্লিষ্টতা নেই। শান্তিপ্রিয় বমেরা অন্য জাতিগোষ্ঠীর সঙ্গে শান্তিতে বসবাস করছে। তাদের আলাদা কোনো দাবি নেই।
পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রথাগত ভূমি ব্যবস্থাপনাকেও পাল্টে দিতে চায় কেএনএফ। পুরো পার্বত্য চট্টগ্রাম সুদীর্ঘকাল ধরে চাকমা, বোমাং ও মং সার্কেলে বিভক্ত। তিন সার্কেল প্রধান বা রাজা সরকারের হয়ে রাজস্ব আদায় করেন। বাংলাদেশের ৬১ জেলা থেকে ভিন্ন এখানকার ভূমি ব্যবস্থাপনা আর সেটা আইনত স্বীকৃত। কিন্তু কেএনএফ চায়, ভূমিতে সার্কেল প্রধান বা মৌজার হেডম্যানদের কোনো ক্ষমতা থাকবে না।
ভূমি পাহাড়ের অন্যতম সমস্যা। পার্বত্য চট্টগ্রামে এ সমস্যার বড় কারণ ১৯৮০-এর দশকে তৎকালীন সামরিক সরকারের সময় অন্তত ৪ লাখ সমতলের বাঙালির অভিবাসন। পাহাড়ি মানুষের যুগ যুগের আবাসস্থলে অনেক বাঙালির বসতি গড়ে তোলা হয়। এতে পাহাড়ের ভূমি সমস্যা জটিলতর হয়ে পড়ে। ভূমি কমিশন গঠনের দুই যুগ পরও একজনের ভূমি সমস্যারও সমাধান হয়নি। পাহাড়ের যেকোনো জাতিগোষ্ঠীর মানুষকেই ভূমির এই জটিলতার মুখোমুখি হতে হয়। কিন্তু কেএনএফ বলছে, তাদের কল্পিত কেটিসিতে যেকোনো পাহাড়ি ও বাঙালি নতুনভাবে বসতি স্থাপন করতে পারবে। এমনকি দেশের যেকোনো অঞ্চলের ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী ও বাঙালি এসে জমি কিনতে পারবে!
ভূমিবিরোধে নাকাল পাহাড়ে কেএনএফের এই প্রস্তাব কাদের স্বার্থ বিবেচনা করে দেওয়া?
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ইমতিয়াজ আহমেদ বলেন, কেএনএফ আসলে দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চেয়েছে। এজন্য তারা দিনদুপুরে ব্যাংক ডাকাতির মতো কাজ করেছে। আবার পাহাড়ের ভূমি কেনাবেচা বাঙালিসহ সবার জন্য অবারিত করে দেওয়ার সুযোগ রেখেছে। কেএনএফের এসব প্রস্তাব বাস্তবসম্মত না হলেও অনেকের দৃষ্টি আকর্ষিত হবে। সেটাই হয়তো তাদের চাওয়া।