সেপ্টেম্বর ১২, ২০২৩ ৯:৫৮ পূর্বাহ্ণ
রপ্তানি উন্নয়ন তহবিল (ইডিএফ) থেকে ঋণ নিয়ে তা আর ফেরত দেয়নি থার্মেক্স গ্রুপ। বাধ্য হয়ে বিদেশি মুদ্রার ঋণটিকে ফোর্সড লোনে রূপান্তর করেছে রাষ্ট্রায়ত্ত রূপালী ব্যাংক। সময়মতো ঋণ ফেরত না দেওয়ায় রূপালী ব্যাংকে ঋণখেলাপি হয়ে পড়ে শিল্প গ্রুপটি। এখানেই শেষ নয়। সেই ঋণ বিশেষ বিবেচনায় পুনঃতফসিল করে দায় পরিশোধের সময় বৃদ্ধি করেছে রূপালী ব্যাংক।
খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, রপ্তানিকারকদের সহায়তায় ১৯৮৯ সালে গঠন করা হয়েছিল ইডিএফ, যা থেকে কাঁচামাল আমদানির জন্য উদ্যোক্তাদের ডলারে ঋণ দেওয়া হয়। এ ফান্ডের আকার বাড়তে বাড়তে ৮ বিলিয়ন (৮০০ কোটি) ডলারে পৌঁছালেও আইএমএফের চাপে তা কমিয়ে ৪ দশমিক ১০ বিলিয়নে (৪১০ কোটি) নিয়ে এসেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। কিন্তু যারা এ ফান্ড থেকে ঋণ নিয়েছে তাদের অনেকেই ফেরত দিতে পারছে না মার্কিনি মুদ্রায় নেওয়া এসব ঋণ। এতে বিপাকে পড়েছে রূপালীসহ আরও কিছু ব্যাংক।
প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, রিজার্ভ থেকে গঠিত ইডিএফ থেকে থার্মেক্স গ্রুপকে ৬৬ কোটি ২৭ লাখ টাকা ঋণ দিয়েছে রূপালী ব্যাংক। কিন্তু নির্ধারিত সময় শেষ হয়ে গেলেও তা শোধ দিতে পারেনি গ্রুপটি। বাধ্য হয়ে থার্মেক্স গ্রুপের নামে সুদে আসলে মোট ৭১ কোটি ৭৩ লাখ টাকার ফোর্সড লোন সৃষ্টি করেছে ব্যাংকটি।
বর্তমানে মাসিক কিস্তিতে আগামী ছয় মাসে এই ঋণ পরিশোধের আবেদন করেছে থার্মেক্স।
এরই পরিপ্রেক্ষিতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অনুমতি চেয়েছে রূপালী ব্যাংক। কিন্তু সেই আবেদন নাকচ করে দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। পাশাপাশি এই ৭১ কোটি ৭৩ লাখ এবং থার্মেক্স গ্রুপের অপর সহযোগী প্রতিষ্ঠান সিস্টার ডেনিম কম্পোসিট লিমিটেডের নামে নেওয়া ১৭ কোটি ৫২ লাখ টাকা চলতি মাসের ৩০ তারিখের মধ্যে দিতে না পারলে মন্দমানে খেলাপি করার নির্দেশ দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। কারণ এই ঋণগুলোর মাধ্যমে রূপালী ব্যাংকের একক গ্রাহক ঋণসীমা অতিক্রম করেছে থার্মেক্স। অর্থাৎ মূলধনের ২৫ শতাংশ (ফান্ডেড-ননফান্ডেড) অতিক্রম করেছে।
রূপালী ব্যাংকের বার্ষিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, ব্যাংকের রেগুলেটরি ক্যাপিটাল বা মূলধন ২ হাজার ২২৩ কোটি টাকা। বিধিমতে, কোনো একক গ্রাহক বা গ্রুপকে ৫৫৫ কোটি ৭৫ লাখ টাকার বেশি ঋণ দেওয়ার সুযোগ নেই এই ব্যাংকের। এদিকে বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে, থার্মেক্স গ্রুপের মোট ঋণ রূপালী ব্যাংকের মূলধনের ২৫ শতাংশ অতিক্রম করেছে। অর্থাৎ গ্রুপটি রূপালী ব্যাংকের একটি বৃহৎ গ্রাহক। কিন্তু বার্ষিক প্রতিবেদনে বৃহৎ গ্রাহকের তালিকায় নাম নেই থার্মেক্সের। ৩৬৬ কোটি টাকা ঋণ নেওয়া গ্রাহক নোমান স্পিনিং মিলসের নাম বৃহৎ গ্রাহকের তালিকায় থাকলেও কেন থার্মেক্সের নাম নেই-এমন প্রশ্ন তুলেছেন সংশ্লিষ্টরা।
বিশ্বস্ত সূত্র জানায়, রূপালী ব্যাংক থেকে থার্মেক্স গ্রুপের ঋণের পরিমাণ ৫০০ কোটি টাকার আশপাশে ছিল। কিন্তু এতদিন একক গ্রাহক ঋণসীমা অতিক্রম করেনি। নতুন করে ৮৩ কোটি ৭৯ লাখ (৬৬.২৭ ও ১৭.৫২) টাকা যুক্ত হয়ে ঋণের সমষ্টি একক গ্রাহক ঋণসীমা অতিক্রম করে। বাংলাদেশ ব্যাংকের নিয়ম অনুযায়ী যা অনৈতিক এবং অনিয়ম।
আরও পড়ুন: বহুমুখী ঝুঁকিতে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ
ব্যাংকের বার্ষিক প্রতিবেদনে আরও দেখা যায়, ২০১১ সাল থেকে ব্যাংকের মূলধন সরকারের দেওয়া মূলধন পুনর্ভরণের অর্থ ও স্টক ডিভিডেন্ড দেওয়ার মাধ্যমে ক্রমাগত বেড়েছে। বর্তমানে ব্যাংকের পরিশোধিত মূলধন ৪৬৪ কোটি ৭০ লাখ টাকা। ব্যাংকের রেগুলেটরি ক্যাপিটাল ২ হাজার ২২৩ কোটি ৯ লাখ টাকা। ন্যূনতম প্রয়োজনীয় মূলধন (এমসিআর) ৪ হাজার ৫১৯ কোটি টাকা। মূলধন ঘাটতি ২ হাজার ২৯৬ কোটি টাকা।
এসব বিষয়ে জানতে রূপালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মোহাম্মদ জাহাঙ্গীরের মোবাইল ফোনে সোমবার একাধিকবার কল করলেও তিনি রিসিভ করেননি।
তবে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মো. মেজবাউল হক বলেন, কোনো ব্যাংক যদি আইন লঙ্ঘন করে তাহলে কেন্দ্রীয় ব্যাংক নিশ্চয় তাদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। আর ইডিএফের ঋণখেলাপি হলে বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভে কোনো প্রভাব পড়ে না। কারণ নির্ধারিত সময় শেষে ব্যাংকের অ্যাকাউন্ট থেকে কেন্দ্রীয় ব্যাংক সেই টাকা কেটে নেয়। এখন কোনো ব্যাংক যদি অন্যায়ভাবে ফোর্সড লোন তৈরি করে, সেই ঋণ খেলাপি হয়ে যায় এবং নীতিবহির্ভূতভাবে পুনঃতফশিল করে তাহলে আইন অনুযায়ী তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
জানা যায়, গত বছরের এপ্রিলে ডলার সংকট শুরু হওয়ার পর ইডিএফ ঋণে সুদহার বাড়ানো হয়। এরপর চলতি বছরের মার্চে নানা নিয়ম-কানুন জারি করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। ফলে ইডিএফের আকার ধীরে ধীরে কমছে। ইডিএফের ঋণ ৭০০ কোটি ডলার থেকে কমে হয়েছে ৪১০ কোটি ডলার। ইডিএফ সুবিধা ধীরে ধীরে বন্ধের পরিকল্পনা করছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
কারণ ইডিএফের ঋণকে আর রিজার্ভের হিসাবে দেখানো যাচ্ছে না। আবার রিজার্ভ বাড়াতে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) ঋণের শর্ত রয়েছে। রোববার আইএমএফের হিসাব পদ্ধতি বিপিএম-৬ অনুযায়ী, রিজার্ভ ছিল ২১ দশমিক ৪৮ বিলিয়ন বা ২ হাজার ১৪৮ কোটি ডলার।
পণ্য রপ্তানির জন্য কাঁচামাল আমদানিতে ইডিএফ থেকে ঋণ দেওয়া হয়। এ ঋণ ফেরত দিতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অনুমোদন সাপেক্ষে ঋণ পরিশোধে সর্বোচ্চ ২৭০ দিন সময় নিতে পারেন উদ্যোক্তারা। জানা গেছে, রাষ্ট্রমালিকানাধীন ব্যাংকগুলোর ইডিএফ গ্রাহক, যারা রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী তারা অনেকেই ইডিএফ বা রিজার্ভ থেকে ঋণ নিয়ে তা আর ফেরত দিচ্ছেন না। এতে ইডিএফের ভালো গ্রাহকরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। গত জানুয়ারিতে ঋণের সুদহার সাড়ে ৪ শতাংশ করা হয়, আর অনাদায়ী অর্থের ওপর অতিরিক্ত ৪ শতাংশ দণ্ডসুদ আরোপ করা হয়। এখন পর্যন্ত ইডিএফ থেকে ঋণ নিয়েছে ৪৯টি শিল্পপ্রতিষ্ঠান।
এদিকে ইডিএফের বিকল্প হিসাবে ১০ হাজার কোটি টাকার রপ্তানিসহায়ক তহবিল গঠন করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। ৬টি ব্যাংক এ তহবিল থেকে সাড়ে ৪ হাজার কোটি টাকা ঋণ নিয়েছে। এ তহবিল থেকে ৪ শতাংশ সুদে টাকা নিয়ে রপ্তানি পণ্যের কাঁচামাল সংগ্রহ করতে পারছেন রপ্তানিকারকরা। যদিও কাঁচামালের বড় অংশই ব্যয় হয় ডলারে। তৈরি পোশাক শিল্প মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ তৈরি পোশাক প্রস্তুত ও রপ্তানিকারক সমিতি (বিজিএমইএ) ও বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিএমএ) সদস্যরা ইডিএফ থেকে দুই কোটি ডলার পর্যন্ত ঋণ নিতে পারেন। একসময় এ ঋণের সীমা ছিল ২ কোটি ৫০ লাখ ডলার। বাংলাদেশ ডাইড ইয়ার্ন এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিডিওয়াইইএ) সদস্যরা ঋণ নিতে পারেন সর্বোচ্চ ১ কোটি ডলার। আগে তাদের ঋণের সীমা ছিল ১ কোটি ৫০ লাখ ডলার।