ডিসেম্বর ১৩, ২০২৩ ৮:২২ পূর্বাহ্ণ
দেশের প্রাণকেন্দ্র রাজধানী ঢাকায় বিএনপির চলমান আন্দোলন জোরদার না হওয়ায় হতাশ তৃণমূল নেতাকর্মীরা। ঢাকা মহানগর উত্তর ও দক্ষিণ বিএনপি নেতাদের দৃশ্যমান কোনো তৎপরতা না থাকায় অনেকটা ঢিলেঢালাভাবে পালন হচ্ছে হরতাল ও অবরোধের মতো কর্মসূচি। মূল দলের এখন সাংগঠনিক শক্তি নিয়েও নানা প্রশ্ন উঠেছে। বাইরের জেলাগুলো ইতোমধ্যে দলটির নীতিনির্ধারকদের স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন, ঢাকায় কর্মসূচি সফল না হলে বাকি জেলাগুলোর নেতাকর্মীরা যতই মাঠে সক্রিয় থাকুক কোনো লাভ হবে না।
অতীতে সারা দেশে আন্দোলন জোরালো হলেও ঢাকা মহানগরের কারণে সফলতা ঘরে আনা যায়নি-এমন অভিযোগ ছিল বিএনপির তৃণমূলের। পরে মহানগর উত্তর ও দক্ষিণকে সাংগঠনিকভাবে শক্তিশালী করতে কেন্দ্রীয় নেতাদের সমন্বয়ে নতুন কমিটি করে দলটি। তারা মহানগরের দুই শাখা ঢেলেও সাজান। কিন্তু প্রায় দেড় মাস ধরে সরকার পদত্যাগের একদফা দাবিতে চলমান আন্দোলনে এর কোনো ফল পাচ্ছে না দল। শুরুতে মহানগর বিএনপির নেতাকর্মীদের মাঠে দেখা গেলেও এখন তাদের দৃশ্যমান কোনো তৎপরতা নেই। শুধু অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠন কিছু ‘ঝটিকা মিছিল’ করছে। যে কারণে রাজধানীর আন্দোলন জমাতে পারছে না। কর্মসূচির দিনে রাজধানীর চিত্র দেখে স্বাভাবিক মনে হচ্ছে। এ নিয়ে চিন্তিত দলটির নীতিনির্ধারকও। আন্দোলন জোরদার করতে করণীয় নিয়ে কয়েক দফা বৈঠকও করেছেন। নেতাকর্মীদের মাঠে নামাতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে কয়েকজন কেন্দ্রীয় নেতাকেও দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। তারা কাজ করছেন। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে এসব তথ্য।
যদিও মহানগর নেতারা জানান, ক্ষমতাসীন দল রাজধানীর নিয়ন্ত্রণ রাখার জন্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে ব্যবহার করছে। গুরুত্বপূর্ণ সড়কের পাশাপাশি অলিগলিতেও পুলিশ মোতায়েন রাখছে। গণহারে গ্রেফতার করছে। রাতে নেতাকর্মীরা বাসায় থাকতে পারছেন না। পুলিশকে সঙ্গে নিয়ে সরকারি দলের নেতাকর্মীরাও বিএনপি নেতাকর্মীদের ধরিয়ে দিচ্ছে। এমন বাস্তবতায়ও নানা কৌশলে মাঠে নামতে হচ্ছে। এখন ঢিলেঢালা হলেও সামনের দিনে আন্দোলন আরও জোরদার করতে নানা পরিকল্পনা নেওয়া হচ্ছে। এজন্য থানাওয়ারি সমন্বয়কেরও দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।
জানতে চাইলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য বেগম সেলিমা রহমান বলেন, ‘সারা দেশে শান্তিপূর্ণভাবে কর্মসূচি পালন করছে বিএনপির নেতাকর্মীরা। রাজধানীতে আন্দোলন কর্মসূচিতে কিছুটা ঢিলেঢালা হচ্ছে। এটার কারণও আছে। আমরা দেখছি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা প্রতিটা মোড়ে মোড়ে অবস্থান করছে। বিএনপি নেতাকর্মীদের পেলেই গ্রেফতার করছে। নানাভাবে অত্যাচার-নির্যাতন করছে। যার ফলে নেতাকর্মীরা মাঠে নামলেই তাদের ওপর হামলা করছে, গুলি করছে। তারপরও বিচ্ছিন্নভাবে আমাদের নেতাকর্মীরা রাজধানীতে কর্মসূচি পালন করে। বিক্ষোভ মিছিলসহ পিকেটিং করে আসছে। সামনের দিনগুলোতে নেতাকর্মীদের উপস্থিতি আরও বাড়বে। কেন্দ্রীয় নেতারা সক্রিয়ভাবে কর্মসূচিতে অংশ নেবে। এ বিষয়ে কাজ চলছে। দল থেকে নির্দেশনাও দেওয়া হচ্ছে।’
ঢাকা মহানগর উত্তরের আহ্বায়ক আমানউল্লাহ আমান ও সদস্য সচিব আমিনুল হক কারাগারে রয়েছে। এখন ভারপ্রাপ্ত আহ্বায়ক অধ্যাপক ডা. ফরহাদ হালিম ডোনার ও ভারপ্রাপ্ত সদস্য সচিবের দায়িত্বে রয়েছেন এজিএম শামসুল হক। অন্যদিকে ঢাকা মহানগর দক্ষিণের আহ্বায়ক আব্দুস সালাম আত্মগোপনে রয়েছেন। সদস্য সচিব রফিকুল আলম মজনু গ্রেফতার হলে ভারপ্রাপ্ত সদস্য সচিবের দায়িত্ব দেওয়া হয় তানভীর আহমেদ রবীনকে। পরে তাকেও গ্রেফতার করা হলে এখন ভারপ্রাপ্ত সদস্য সচিবের দায়িত্বে রয়েছেন লিটন মাহমুদ। মহানগর নেতারা জানান, ২৮ অক্টোবর ঢাকার মহাসমাবেশ পণ্ড হওয়ার পর থেকেই সবচেয়ে বেশি গ্রেফতার ও নির্যাতনের শিকার ঢাকা মহানগরের সক্রিয় নেতাকর্মীরা। হরতাল ও অবরোধ শুরুর পর থেকে এ পর্যন্ত মহানগর উত্তরের তিনশরও বেশি ও দক্ষিণের তিনশ নেতাকর্মী গ্রেফতার হয়েছেন। মহানগরের শীর্ষ নেতারা গ্রেফতার হওয়ায় সাংগঠনিক কাজে সাময়িকভাবে একটু সমস্যা হবে-এটাই স্বাভাবিক। সামনে সব নেতাকর্মীরাই মাঠে নামবে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, উত্তরে কেন্দ্রীয় কমিটির পাশাপাশি সাংগঠনিক ২৬ থানারই আহ্বায়ক কমিটি রয়েছে। আর ৭১টি সাংগঠনিক ওয়ার্ডে রয়েছে পূর্ণাঙ্গ কমিটি। অন্যদিকে দক্ষিণে ৮০টি সাংগঠনিক ওয়ার্ডে কমিটি রয়েছে। তবে ২৪ থানার কমিটি স্থগিত রাখা হয়েছে। যদিও এসব থানার সাবেক শীর্ষ নেতাদের দায়িত্ব দিয়ে আন্দোলন পরিচালনা করা হচ্ছে। দক্ষিণের এক নেতা জানান, ওয়ার্ড কমিটি করার আগে থানা কমিটির হস্তক্ষেপ ঠেকাতে তা স্থগিত করা হয়। থানা কমিটি করার জন্য সমন্বয় কমিটি ও অঙ্গ-সহযোগী সংগঠনের মতামত এবং ওয়ার্ডের মতামত নিয়ে মোটামুটি এগিয়ে আনা হয়েছিল। কিন্তু সদস্য সচিব গ্রেফতার হওয়ায় এবং পরে হরতাল ও অবরোধ শুরু করার পর তা আর করা যায়নি। থানা কমিটি না থাকার কারণেও আন্দোলনে প্রভাব পড়ছে।
ইতোমধ্যে দেশব্যাপী চার দফা হরতাল ও দশ দফা অবরোধ কর্মসূচি পালন করেছে বিএনপি। এগারো দফায়ও ৩৬ ঘণ্টার অবরোধ চলছে। যা আজ সন্ধ্যা ৬টায় শেষ হবে। হরতাল-অবরোধের কর্মসূচির ওপর নজর রাখছেন, বিএনপির এমন নেতারা জানিয়েছেন, মূলত রাজধানীতে কর্মসূচিগুলো করছে যুবদল, ছাত্রদল ও স্বেচ্ছাসেবক দল। এছাড়া বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতাদের মধ্যে রুহুল কবির রিজভী, আব্দুল কাদির ভূঁইয়া জুয়েল, ফজলুর রহমান খোকন (কারাগারে), কাজী রওনকুল ইসলাম শ্রাবণসহ আরও কয়েকজনকে বিক্ষোভ মিছিল করতে দেখা যায়। কিন্তু মহানগরের মূল দল বিএনপিকে সেভাবে দেখা যাচ্ছে না। অথচ উত্তর ও দক্ষিণ বিএনপির কেন্দ্রীয়সহ প্রতিটি সাংগঠনিক থানা ও ওয়ার্ড কমিটি রয়েছে। যদিও দক্ষিণের থানা কমিটি স্থগিত, কিন্তু সেখানেও দায়িত্ব দেওয়া রয়েছে। বিএনপির এসব নেতা কোথায়? এর বাইরে কর্মীও রয়েছে, তারা এখন কোথায়?-এমন প্রশ্ন তৃণমূল নেতাদের।
বিএনপির সাংগঠনিক জেলার শীর্ষ পদে রয়েছেন এমন অন্তত দশজন নেতা ক্ষোভ প্রকাশ করে জানান, ঢাকার আন্দোলন জোরদারের জন্য বিভিন্ন বৈঠকে অনেকবার বলা হয়েছে। এবং তা গুরুত্বের সঙ্গেও নিয়েছেন ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান। কিন্তু বাস্তবে তার প্রতিফলন দেখছি না। কর্মসূচির দিন সকালে ও রাতে ঝটিকা মিছিল করা পর্যন্তই সীমাবদ্ধ রয়েছে। এসব মিছিল মাত্র পাঁচ থেকে দশ মিনিটের মধ্যেই শেষ করছে। মনে হয় ছবি তোলার জন্যই এই কর্মসূচি।
তারা আরও জানান, দেশি-বিদেশিরা মূলত রাজধানীতে কী হচ্ছে সেদিকে তাকিয়ে থাকেন। তাই এখনো সময় আছে ঢাকা মহানগরের দিকে বেশি গুরুত্ব দেওয়া উচিত।
দলটির স্থায়ী কমিটির একজন সদস্য বলেন, ঢাকা মহানগরের আন্দোলন নিয়ে তারাও সন্তুষ্ট নয়। এজন্য বেশি গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। নেওয়া হচ্ছে নানা পদক্ষেপ। ইতোমধ্যে কয়েকজন কেন্দ্রীয় নেতাকেও দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। তিনি আশা করেন ১৮ ডিসেম্বরের রাজধানীর আন্দোলনে ভিন্নরূপ পাবে। পরিস্থিতি বদলে যাবে।
ঢাকা মহানগর দক্ষিণ বিএনপির দপ্তরের দায়িত্বে থাকা সাইদুর রহমান মিন্টু বলেন, ‘কর্মসূচির প্রতিদিনই বিএনপির নেতাকর্মীরা বিক্ষোভ করছে। গ্রেফতার করা হচ্ছে। চেষ্টা করা হচ্ছে কর্মসূচি কীভাবে জোরদার করা যায়। ২৪ থানায় কমিটি না থাকলেও এসব থানার সাবেক সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকদের সমন্বয়কের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। তারা কাজ করছেন।’
ঢাকা মহানগর উত্তর বিএনপির দপ্তর সম্পাদক জিয়াউর রহমান বলেন, ‘সরকারি দল ও প্রশাসন তাদের সর্বশক্তি নিয়োগ করে ঢাকাকে দখল রাখতে চায়। এর মধ্যেও অবরোধের পক্ষে মিছিল অব্যাহত আছে। এ কার্যক্রম চালাতে গিয়ে প্রতিদিনই কোনো না কোনো নেতাকর্মী গ্রেফতার হচ্ছেন বা রিমান্ডের শিকার হচ্ছেন। আওয়ামী লীগের গুন্ডাবাহিনীর হাতে নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন। কিন্তু তারপরও কর্মসূচি পালন থেমে নেই। সরকারি দল ও বিভিন্ন সংস্থার লোকজন বাসে আগুন দিয়ে ভীতিকর পরিস্থিতির সৃষ্টি করে। এজন্য আমরা শান্তিপূর্ণভাবেই কর্মসূচি পালন করছি। শান্তিপূর্ণভাবে পালন করার জন্য অনেক ক্ষেত্রে মনে হয় সফল হচ্ছে না, কিন্তু মানুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবেই এই আন্দোলনে সমর্থন দিচ্ছেন।’