লেবাননের সশস্ত্র গোষ্ঠী হিজবুল্লাহর মহাসচিব সাইয়্যেদ হাসান নাসরুল্লাহ হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেছেন, লেবাননের বিরুদ্ধে যুদ্ধের হুমকি আমাদের ভীত করে না এবং আমাদের ভয় পাওয়া উচিতও নয়। কারণ, শত্রু ভালো করেই জানে যে, আমরা কঠিনতম পরিস্থিতির জন্য নিজেদের প্রস্তুত রেখেছি। সেই সঙ্গে আগ্রাসন চালালে তার কপালে কী আছে- সেটাও সে জানে।
গত বুধবার ইসরাইলি হামলায় নিহত হিজবুল্লাহর ফিল্ড কমান্ডার তালেব সামি আব্দুল্লাহ ওরফে আবু তালেব স্মরণ উপলক্ষে এক টেলিভিশন ভাষণে এ হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেন নাসরুল্লাহ।
হিজবুল্লাহ নেতার ওই হুঁশিয়ারির পর আরব বিশ্বের প্রখ্যাত রাজনৈতিক ভাষ্যকার আব্দুল বারি আতওয়ান বলেছেন, ইসরাইল লেবাননের বিরুদ্ধে কোনো রকম কাপুরুষতা দেখানোর চেষ্টা করলে হিজবুল্লাহ তার দাঁতভাঙা জবাব দেবে।
সম্প্রতি বার্তা সংস্থা রাই আল-ইয়াওমে এক সংবাদ বিশ্লেষণে আতওয়ান লিখেছেন, সাইয়্যেদ হাসান নাসরুল্লাহর ভাষণের গুরুত্ব উপলব্ধি করতে হলে আমাদের ওই ভাষণের ব্যাপারে তিন পক্ষের প্রতিক্রিয়া বিশ্লেষণ করতে হবে।
এই সাংবাদিক তার নিবন্ধে বলেন, সবার আগে প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন সাইপ্রাসের প্রেসিডেন্ট নিকোস ক্রিস্টোডৌলিডিস। তিনি ঘাবড়ে গিয়ে বলেছেন, লেবাননের বিরুদ্ধে কোনো ধরনের যুদ্ধে জড়ানোর ইচ্ছা সাইপ্রাসের নেই।
হিজবুল্লাহর ‘হুদহুদ’ ড্রোন ইসরাইলের জন্য নয়া বিস্ময় উল্লেখ করে আতওয়ান লিখেছেন, ইসরাইলি গণমাধ্যমের পাশাপাশি সামরিক বিশেষজ্ঞরা হিজবুল্লাহর হাতে থাকা লাখ লাখ ক্ষেপণাস্ত্র, ড্রোন ও রকেটের কথা উল্লেখ করে বলেছেন- এসব সমরাস্ত্রের মোকাবিলায় ইসরাইল সামরিক ও নিরাপত্তাগত দিক দিয়ে অত্যন্ত নাজুক অবস্থায় রয়েছে। বিশেষ করে হিজবুল্লাহ উত্তর ইসরাইলে তাদের বিস্ময়কর ‘হুদহুদ’ গোয়েন্দা ড্রোন পাঠানোর পর, ইসরাইলি কর্মকর্তাদের ঘুম হারাম হয়ে গেছে।
তিনি বলেন, গত সপ্তাহে হিজবুল্লাহর পক্ষ থেকে প্রকাশিত ভিডিও ফুটেজে দেখা গেছে, হুদহুদ ড্রোনটি ইসরাইলের কথিত আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ভেদ করে হাইফা বিমান ও নৌঘাঁটিসহ গুরুত্বপূর্ণ সামরিক ও বেসামরিক স্থাপনাগুলোর স্পর্শকাতর ছবি তুলে নির্বিঘ্নে লেবাননে ফিরে গেছে।
ইসরাইল ধ্বংসের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে বলে মার্কিন সাংবাদিক থমাস ফ্রাইডম্যানের স্বীকারোক্তির বিষয়ে আতওয়ান লিখেছেন, নিউইয়র্ক টাইমসের সাংবাদিক থমাস ফ্রাইডম্যান একথা স্বীকার করেছেন যে, ইসরাইলকে এখন গাজা, লেবানন ও পশ্চিম তীর- এই তিন ফ্রন্টে যুদ্ধ করতে হচ্ছে। যে ইসরাইলকে আমরা এতদিন চিনতাম, তা পতনের দিকে ধাবিত হচ্ছে। এই ইসরাইল এখন ইরান নামক একটি বড় শক্তির মুখোমুখি, যে শক্তি মধ্যপ্রাচ্যে তার প্রক্সি ও সামরিক সক্ষমতাগুলো ব্যবহার করে ইসরাইলকে ধ্বংস করে দিতে চায়।
আতওয়ান তার নিবন্ধে সতর্ক করে দিয়ে বলেন, ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু আসলে যুক্তরাষ্ট্রকে মধ্যপ্রাচ্যে একটি বড় ধরনের যুদ্ধে জড়াতে চান। তবে এই যুদ্ধে মূলত লাভের ফসল ঘরে তুলবে রাশিয়া ও চীন।
সাইপ্রাস-ইসরাইল গোপন চুক্তির তথ্য এখন হিজবুল্লাহর হাতে উল্লেখ করে আব্দুল বারি আতওয়ান বলেন, সাইয়্যেদ হাসান নাসরুল্লাহ এই প্রথমবারের মতো ভূমধ্যসাগরে অবস্থিত ইউরোপীয় দ্বীপরাষ্ট্র সাইপ্রাসকে চোখরাঙানি দিয়েছেন। এমনকি দেশটির বিমানবন্দরসহ অন্যান্য স্থাপনায় হামলা চালানোর হুমকিও দিয়েছেন।
এ বিষয়ে আরবের এই রাজনৈতিক বিশ্লেষক আরও বলেন, হিজবুল্লাহ নেতা সংগঠনটির গোয়েন্দা সূত্রে নিখুঁত খবর পাওয়ার পরই ওই হুমকি দিয়েছেন। গোয়েন্দা সূত্রে খবর পাওয়া যায় যে, গত এপ্রিলে সাইপ্রাসের একটি পাহাড়ি এলাকায় ইসরাইল-সাইপ্রাসের একটি যৌথ সামরিক মহড়া অনুষ্ঠিত হয়েছে। যে পাহাড়ি এলাকার সঙ্গে দক্ষিণ লেবাননের পাহাড়ি এলাকার মিল রয়েছে।
নিজেদের গোয়েন্দা সূত্র হিজবুল্লাহ আরও খবর পেয়েছে যে, ইসরাইল ও সাইপ্রাস এমন একটি চুক্তি করেছে, যার ভিত্তিতে হিজবুল্লাহর হামলায় ইসরাইলের বিমানবন্দরগুলো ধ্বংস হয়ে গেলে সাইপ্রাস তার বিমানবন্দরগুলো ইসরাইলের সামরিক ও বেসামরিক বিমানগুলোর জন্য উন্মুক্ত করে দেবে।
হুদহুদ শুধু গোয়েন্দা ড্রোন-ই নয়, এর হামলা চালানোর শক্তি রয়েছে জানিয়ে আতওয়ান লিখেছেন, ইহুদিবাদী ইসরাইলি জেনারেলরা গত ১০ বছর ধরে হিজবুল্লাহর ক্ষেপণাস্ত্র শক্তির ওপর গভীর নজর রেখে আসলেও হিজবুল্লাহর হুদহুদ ড্রোনের সক্ষমতা দেখে তারা হকচকিয়ে গেছেন। তারা একথা উপলব্ধি করেছেন যে, হুদহুদের রয়েছে অসম্ভব দ্রুতগতি এবং রাডার ব্যবস্থা ফাঁকি দিয়ে অত্যন্ত কম উচ্চতায় উড়ে যাওয়ার সক্ষমতা। সেই সঙ্গে এই ড্রোনে উচ্চমাত্রার বিস্ফোরকসমৃদ্ধ ওয়ারহেডও বসানো যায়। অর্থাৎ হিজবুল্লাহ চাইলে এ ধরনের ড্রোন ব্যবহার করে ইসরাইলের স্পর্শকাতর স্থাপনাগুলোতে হামলাও চালাতে পারবে।
সেই সঙ্গে আত্মিক মনোবল ও সামরিক শক্তির দিক দিয়ে হিজবুল্লাহ এখন অতীতের যেকোনো সময়ের চেয়ে শক্তিশালী অবস্থানে রয়েছে বলেও মনে করেন এই রাজনৈতিক বিশ্লেষক। তিনি বলেন, ঠিক এ কারণে সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যপ্রাচ্য বিষয়ক বিশেষ প্রতিনিধি লেবানন সফরে গিয়ে খালি হাতে ওয়াশিংটনে ফিরে গেছেন।
এ অবস্থায় লেবাননে হামলা চালানোর আগেই তেলআবিব বিশ্ব মানচিত্র থেকে মুছে যাবে বলে মন্তব্য করেছেন আব্দুল বারি আতওয়ান। এই আরব বিশ্লেষক তার নিবন্ধে হিজবুল্লাহর বিরুদ্ধে ইসরাইলি যুদ্ধমন্ত্রী ইয়োভ গ্যালান্টের হুমকির প্রতি ইঙ্গিত করে লিখেছেন, গ্যালান্টের মতো কর্মকর্তারা হিজবুল্লাহকে এ পর্যন্ত বেশ কয়েকবার হুমকি দিয়েছেন। কিন্তু তার যদি সেরকম কোনো ক্ষমতা থাকত, তাহলে তিনি হয় তা বাস্তবায়ন করতেন অথবা চুপ থাকতেন; ফাঁকা আওয়াজ দিতেন না।
আতওয়ান বলেন, তিনি এ বিষয়ে নিশ্চিত যে, ‘লেবানন ভূখণ্ডে ইসরাইলের প্রথম ক্ষেপণাস্ত্র আঘাত হানার আগেই তেলআবিব বিশ্বের মানচিত্র থেকে মুছে যাবে’।