ডিসেম্বর ২, ২০২৩ ১০:৩৭ পূর্বাহ্ণ
শীতকালে সাধারণত আমাদের সবারই ঠান্ডা, সর্দি, কাশি, জ্বর বেশি হয়ে থাকে। শিশু এবং একটু বেশি বয়স্কদেরই এ সমস্যায় আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা থাকে সবচেয়ে বেশি। কারণ শিশু এবং বয়স্কদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম থাকে। কারও সর্দি, হাঁচি, কাশি এবং গলা বসে যাওয়া বা গলাব্যথা হলে, সেটি সাধারণ ঠান্ডা, মৌসুমি ফ্লু বা কোল্ড অ্যালার্জি কিনা, এগুলো আলাদা করে বলা সবসময় খুব একটা সহজ নয়। পার্থক্যগুলো বুঝতে চেষ্টা করলে, সুস্থ থাকাটা সহজ হয়। তাই, শীতকালীন কিছু সাধারণ রোগবালাই নিয়ে আলোচনা করেছেন শিশুস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. মনজুর হোসেন
সাধারণ ঠান্ডা (Common Cold)
এ অবস্থায় আক্রান্ত শিশুর নাক দিয়ে অনবরত পানি পড়া, শরীরের তাপমাত্রা সামান্য বৃদ্ধি পাওয়া বা হালকা জ্বরজ্বর ভাব, অরুচি বা খেতে অনিচ্ছা এবং সামান্য গলাব্যথা থাকতে পারে। নাক বন্ধ থাকলে শিশুর নাকে ড্রপ ব্যবহার করতে হবে। ছোট শিশুদের ক্ষেত্রে সাধারণত লবণ পানির ড্রপ (০.৯ শতাংশ নরমাল স্যালাইন) ব্যবহার নিরাপদ। বাল্বসাকার বা পাম্প দিয়ে নাক পরিষ্কার রাখতে হবে। জ্বর থাকলে প্যারাসিটামল খাওয়াতে হবে। মধু মিশ্রিত কুসুম গরম পানি ও স্যুপ খাওয়ালে কিছুটা উপশম হবে। অ্যান্টিহিস্টামিন সিরাপ ব্যবহার করা যেতে পারে।
ঠান্ডায় অ্যালার্জি (Cold Allergy)
বেশি সংবেদনশীল শিশুদের, শীত এলেই বারবার ঠান্ডার উপসর্গ দেখা দেয় অথবা প্রায় সম্পূর্ণ শীতকাল জুড়েই ঠান্ডা লেগে থাকে। যাকে কোল্ড অ্যালার্জি বা শীতকালীন সংবেদনশীলতা বলা যেতে পারে। অনেক বয়স্ক ব্যক্তিও হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েন বা শীতজুড়ে অসুস্থ থাকেন। এর বেশিরভাগ হয়ে থাকে কোল্ড অ্যালার্জির কারণে। শীতকালে আর্দ্রতা কম থাকে, আবহাওয়া শুষ্ক ও বাতাস ঠান্ডা থাকে। এসবই সংবেদনশীলতার উদ্রেক করে তাই ঠান্ডা লেগে যায়। একারণে হাঁচি, কাশি, সর্দি ইত্যাদি দেখা দেয়। প্রচণ্ড শীতে ঠান্ডা বাতাস অনেকের জন্য এলার্জেন হিসাবে কাজ করে এবং এ কারণে সৃষ্ট উপসর্গকে কোল্ড অ্যালার্জি বলা হয়। তাই এসব অ্যালার্জি পরিহার করে চলা উচিত। ঠান্ডা বাতাস থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার জন্য মাস্ক বা মুখবন্ধনি ব্যবহার করা যেতে পারে, যেটা করোনার জন্য আমরা সবাই ব্যবহার করছি। সালবিউটামল ইনহেলার নেওয়া যেতে পারে, কারণ এ ওষুধ শ্বাসকষ্টের উপসর্গ নিরসনে কার্যকর। দীর্ঘমেয়াদে ভাল থাকার জন্য মন্টিলুকাস ট্যাবলেট খেতে হয়।
অ্যালার্জিক রাইনাইটিস (Allergic Rhinitis or Hay Fever)
শিশুবয়সে তো বটেই, বড়দের মধ্যেও এটা বেশ প্রকট। অ্যালার্জিক রাইনাইটিসে আক্রান্ত শিশুর প্রায় ৩০ শতাংশ পরবর্তীকালে অ্যাজমায় আক্রান্ত হয়। এটা মৌসুমি রোগ। অ্যালার্জিক রাইনাইটিসে আক্রান্তদের সঙ্গে কোল্ড অ্যালার্জি বা শীতকালীন সংবেদনশীলতার খুব বড় পার্থক্য করা সহজ নয়। তবে অ্যালার্জিক রাইনাইটিসের লক্ষণ শীতকাল ছাড়াও বসন্ত, গ্রীষ্ম এবং শরতের প্রথম দিকে হতে পারে। যদি কারও প্রতি বছর একই সময়ে ‘সর্দি’ হয় তবে সম্ভবত তার মৌসুমি অ্যালার্জি থাকতে পারে। যদিও সর্দি এবং মৌসুমি অ্যালার্জি একই লক্ষণগুলোর কিছু ভাগ করতে পারে তবে এগুলো আলাদা রোগ। সাধারণ সর্দি ভাইরাসজনিত কারণে হয়, তবে মৌসুমি হল অ্যালার্জি। ফুল, গাছ বা ঘাসের পরাগের মতো অ্যালার্জেনের সংস্পর্শে প্রতিক্রিয়া হয়। এগুলো সাধারণত বায়ুবাহিত ছত্রাকের স্পোরগুলোতে বা খড়, ঘাস এবং আগাছা থেকে অ্যালার্জি সংবেদনশীলতার কারণে হয়ে থাকে। অনেক অ্যালার্জিক রাইনাইটিস রোগীরা সারা বছর ধরেই ভুগতে পারেন।
এ রোগে সাধারণত নাক চুলকানো ও সর্দি, চোখ, মুখ বা ত্বকের চুলকানি, হাঁচি, নাক বন্ধ (ঘুমের ব্যাঘাত ঘটে) ও ক্লান্তি বা অবসাদ বোধ হয়। অ্যালার্জির কারণে অ্যাজমা, কনজানটিভাইটিস, গলাব্যথা, সাইনোসাইটিস, অ্যাকজিমা, কানপাকা অসুখ, গ্রন্থি ফুলে যেতে পারে।
অ্যাজমা বা হাঁপানি (Ashtma)
হাঁপানি শিশুদের মধ্যে সবচেয়ে দীর্ঘস্থায়ী শ্বাসযন্ত্রের রোগ। দীর্ঘদিন ধরে অতি সংবেদনশীলতা ও শ্বাসতন্ত্রের প্রদাহজনিত কারণে ঘনঘন হাঁচি, কাশি এবং স্বাভাবিকভাবে নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হওয়াকে হাঁপানি বা অ্যাজমা বলে। শীতকালে অ্যাজমা বা হাঁপানি রোগীদের আক্রান্তের হার অনেক বৃদ্ধি পায়।
যে কারণে এ অ্যালার্জি, তার উৎস থেকে শিশুর সংস্পর্শ বাদ দেওয়াই রোগ প্রতিরোধের মূল উপায়। যেমন: ধুলাবালি, পোলেন, অ্যানিমেল ডেনডার, তেলাপোকা, ঠান্ডা বাতাস, সিগারেটের ধোঁয়া।
ব্রংকিওলাইটিস (Bronchiolitis)
ব্রংকিওলাইটিস শীতকালে বেশি হয়। এ রোগে শিশুরা শ্বাসকষ্ট ও সর্দি-কাশির মতো সমস্যায় বেশি ভোগে। সাধারণত দুইমাস থেকে দুইবছর পর্যন্ত বাচ্চাদের ক্ষেত্রে এ রোগ হয়। তবে তিন থেকে নয় মাসের বাচ্চাদের বেশি হয়। ‘রেসপিরেটরি সিনথেটিয়াল’ নামক একটি ভাইরাসের সংক্রমণে এ রোগ হয়। রেস্পিরেটরি সিনসাইটিয়াল ভাইরাস ছাড়াও রাইনো ভাইরাস, ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাসের সংক্রমণে এ রোগ হতে পারে। এতে প্রান্তিক শ্বাসনালিগুলোতে প্রদাহের সৃষ্টি হয়ে ফুলে যায় এবং মিউকাস নামক পদার্থ দ্বারা পরিপূর্ণ হয়ে শিশুর স্বাভাবিক শ্বাস-প্রশ্বাসে বাধার সৃষ্টি হয়। প্রথমে আক্রান্ত শিশুর নাক দিয়ে পানি পড়ে, তারপরে আস্তে আস্তে কাশি শুরু হয় এবং সঙ্গে সঙ্গে শ্বাসকষ্ট দেখা দেয়। শ্বাসকষ্ট হলে বুকের খাঁচা বা পাজড় শ্বাস নেওয়ার সময় ডেবে যায় এবং শিশু ঘনঘন শ্বাস-প্রশ্বাস গ্রহণ করে। শ্বাস নেওয়ার সময় বুকে সাইসাই শব্দ বা বাঁশির আওয়াজের মতো শোনা যায়। দুধ টানতে বা খেতে শিশুর কষ্ট হয়। ব্রংকিওলাইটিস হলে শিশু ঠান্ডা-কাশি আর অল্প শ্বাসকষ্টে ভুগলেও সে অর্থে অসুস্থ মনে হয় না। এতে আক্রান্ত শিশুর সাধারণত তেমন জ্বর থাকে না, হলেও কম তাপমাত্রা থাকে।
সাধারণ চিকিৎসা
-নাক-গলা পরিষ্কার রাখুন (বাল্বসাকার বা বাল্ব সিরিঞ্জ ব্যবহার করতে পারেন)।
-জ্বরের জন্য প্যারাসিটামল ওষুধ খাওয়াতে পারেন।
-পর্যাপ্ত পানি ও খাদ্য খাওয়ান।
-শ্বাসকষ্টের জন্য নেবুলাইজার( ইপ্রাটোপিয়াম, সালবটালিন) অথবা ব্রঙ্কোডাইলেটর সিরাপ ( ব্রডিল বা সালমলিন সিরাপ) খাওয়ানো দরকার পরে।
মনে রাখবেন, অ্যান্টিবায়টিকের কোনই প্রয়োজন নেই।
প্রতিরোধ ও সতর্কতা
-শিশুকে পর্যাপ্ত পুষ্টিকর খাবার খাওয়াতে হবে।
-শিশুকে স্যাঁতসেঁতে, অন্ধকারাচ্ছন্ন পরিবেশে রাখা যাবে না। উষ্ণ আবহাওয়ায় স্বাভাবিক আলো-বাতাস চলাচল করে এমন ঘরে রাখতে হবে।
-শীতের তীব্রতা অনুযায়ি হালকা ও নরম কাপড় পড়াতে হবে।
-ধুলা-বালি, ধোঁয়া থেকে শিশুকে দুরে রাখতে হবে, বড়দের শিশুর ঘরে বা সামনে ধুমপান করা যাবে না।
মৌসুমি ফ্লু (Seasonal Influenza)
মৌসুমি ফ্লু বা ইনফ্লুয়েঞ্জা হলো, ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাসের একধরনের তীব্র শ্বাসপ্রশ্বাসের সংক্রমণ। ৪ ধরণের ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাস রয়েছে-এ, বি, সি এবং ডি। এর মধ্যে ইনফ্লুয়েঞ্জা এ এবং বি ভাইরাস দুটিই মৌসুমি মহামারি রোগের কারণ। ইনফ্লুয়েঞ্জাতে হঠাৎ জ্বর, কাশি (সাধারণত শুকনো), মাথাব্যথা, পেশি এবং অস্থিগ্রন্থিতে ব্যথা, অসুস্থতাবোধ, গলাব্যথা এবং নাক দিয়ে সর্দি পড়া, কাশি হতে পারে এবং ২ বা আরও অধিক সপ্তাহ ধরে তা চলতে পারে। মাথাব্যথা, শরীর ম্যাজম্যাজ ও ব্যথা, দুর্বলতা বা ক্লান্তি, কাশি, বুকে অস্বস্তি বোধও হয়। লক্ষণগুলো সাধারণত ১০ দিন থেকে ২ সপ্তাহ স্থায়ী হয়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই চিকিৎসার কোনোও প্রয়োজন হয় না এবং এক সপ্তাহের মধ্যেই প্রায় সবাই সুস্থ হয়ে যায়। তবে কখনো কখনো বিশেষত উচ্চ ঝুঁকিতে থাকা ব্যক্তিদের মধ্যে ইনফ্লুয়েঞ্জা গুরুতর অসুস্থতা বা মৃত্যুর কারণ হতে পারে। গুরুতর রোগ বা জটিলতার ঝুঁকিতে থাকা ব্যক্তিরা হলেন-গর্ভবতী মহিলা, ৫ বছর বা ৫৯ মাসের কম বয়সি শিশু, বয়স্ক ব্যক্তি, দীর্ঘস্থায়ী রোগসহ ব্যক্তিরা (ডায়াবেটিস, উচ্চরক্তচাপ, দীর্ঘমেয়াদি ফুসফুসের রোগ, কিডনি, লিভাররোগ বা ইমিউনোসাপ্রেসিভ অর্থাৎ রোগ প্রতিরোধ অবস্থার সঙ্গে সম্পৃক্ত ব্যক্তি (যেমন এইচআইভি/এইডস, কেমোথেরাপি বা স্টেরয়েড গ্রহণ, বা ক্যানসার)।
প্রতিরোধ
-রোগ প্রতিরোধের সবচেয়ে কার্যকর উপায় হলো টিকা। নিরাপদ এবং কার্যকর ভ্যাকসিনগুলো দেশে পাওয়া যায়। – ইনফ্লুয়েঞ্জা থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য বার্ষিক টিকা দেওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়। ইনজেক্টেড অ্যাক্টিভেটেড ইনফ্লুয়েঞ্জা ভ্যাকসিনগুলো সারা বিশ্বে ব্যবহৃত হয়।
-ইনফ্লুয়েঞ্জা জটিলতার উচ্চ ঝুঁকিতে থাকা লোকেদের এবং যারা ঝুঁকি নিয়ে সঙ্গে থাকেন বা তাদের যত্ন – নেন তাদের জন্য টিকা দেওয়া গুরুত্বপূর্ণ।
-গর্ভাবস্থার যে কোনোও পর্যায়ে গর্ভবতী মহিলা।
-৬ মাস থেকে ৫ বছর বয়সি শিশু ও ৬৫ বছরের বেশি বয়সি ব্যক্তি।
-দীর্ঘস্থায়ী রোগাক্রান্ত ব্যক্তি এবং স্বাস্থ্যকর্মী।
লেখক : সাবেক অধ্যাপক ও পরিচালক, ঢাকা শিশু হাসপাতাল। সাবেক সভাপতি. বাংলাদেশ শিশু চিকিৎসক সমিতি, ডা: মনজূর,স চাইল্ড কেয়ার সেন্টার।