নভেম্বর ১৮, ২০২৩ ৯:২৩ পূর্বাহ্ণ
নাক-কানের কিছু সমস্যা শীতকালেই হয় আর কিছু সমস্যা শীতে বাড়ে। শীতের মৌসুমে সর্দি-কাশি-হাঁচি বা নাক বন্ধ হওয়ার সমস্যা হতেই পারে। কারও কারও এমন সমস্যায় পুরো শীতকালটাই ভুগতে হয়। এর কারণ ঠান্ডায় সংবেদনশীলতা বা কোল্ড অ্যালার্জি। আমাদের নাকের চারপাশের অস্থিগুলোর ফাঁকে বাতাসপূর্ণ কুঠুরি থাকে। এগুলোকে বলে সাইনাস। এর কাজ হলো মাথাকে হালকা রাখা, আঘাত থেকে মাথাকে রক্ষা করা, কণ্ঠস্বরকে সুরেলা রাখা, দাঁত ও চোয়াল গঠনে সহায়তা করা। সাইনাসের ভেতরের মিউকাস (তরল) স্বাভাবিক নিয়মে প্রতিদিন নাসিকাগহ্বর দিয়ে বেরিয়ে যায়। নাকের ভেতর দিয়ে সাইনাসে বাতাস চলাচল করে। এ প্রক্রিয়ায় বিঘ্ন ঘটলে বাতাসের পরিবর্তে সেখানে পানি বা তরল পদার্থ জমা হয়ে প্রদাহ হয়। একে সাইনোসাইটিস বলা হয়।
* কেন হয়
নাকে এলার্জির সমস্যা, ভাইরাস সংক্রমণ, মৌসুম পরিবর্তনজনিত সাধারণ ঠান্ডা-সর্দি, নাকের মাঝখানের হাড় বাঁকা হওয়া, নাকের ভেতরে মাংস (টারবিনেট) বৃদ্ধি, পলিপ, টিউমার ইত্যাদি কারণে সাইনোসাইটিস হয়। শীত বা এর শুরুতে অ্যালার্জি, ঠান্ডা ও ইনফ্লুয়েঞ্জা বেশি হয়। যাদের এ সমস্যাগুলো আছে, তাদের ক্ষেত্রে রোগটির প্রকোপ এ সময় বেশি দেখা দেয়।
* লক্ষণ ও উপসর্গ
▶ নাক থেকে ঘন, হলুদ বা সবুজাভ শ্লেষ্মা (সর্দি) বের হয়। সঙ্গে জ্বর হতে পারে।
▶ নাক বন্ধ ও নাক দিয়ে শ্বাস নিতে অসুবিধা হতে পারে।
▶ নাকের চারপাশে ব্যথা, চোখের নিচে অথবা কপালে ফোলাভাব থাকতে পারে। চোখ, গাল, নাক বা কপালের চারপাশে ব্যথাও হতে পারে।
▶ কানের ভেতরে চাপ অথবা বন্ধ বন্ধ ভাব অনুভব হতে পারে।
▶ মাথাব্যথা, এমনকি দাঁতে ব্যথাও হতে পারে।
▶ ঘ্রাণশক্তি বা গন্ধের অনুভূতি কমে যেতে পারে।
* শীতের আগেই সতর্কতা
▶ রাতে বা ভোরে বের হলে কান-মাথা-গলা ঢেকে বের হওয়া উচিত। এক্ষেত্রে আরামদায়ক মাফলার ব্যবহার করতে পারেন। শীত কমাতে পায়ে মোজা পরা ভালো।
▶ শীতে ধুলা থেকে অ্যালার্জি বাড়ে। তাই রাস্তায় বের হলে মাস্ক পরা ভালো।
▶ অ্যালার্জি থাকলে এর নির্দিষ্ট কারণ জেনে নিতে হবে; যাতে সতর্ক হয়ে সেই উপাদান এড়িয়ে চলা যায়।
▶ ধূমায়িত ও দূষিত পরিবেশ এড়িয়ে চলতে হবে।
▶ ঘুমানোর সময় মাথা উঁচু রাখতে হবে; যাতে সাইনাস নিজে থেকেই পরিষ্কার হতে পারে।
▶ দীর্ঘক্ষণ ঠান্ডা পানি ঘাঁটা উচিত না। যাদের সূচিবায়ু সমস্যা আছে তারা সতর্কতা অবলম্বন করবেন।
* করণীয়
কুসুম গরম পানির ভাপ নিয়ে নাক পরিষ্কার করতে পারেন। দিনে অন্তত দুবার ভেপার বা বাষ্প নিতে হবে। গরম পানিতে মেনথলের দানা মিশিয়ে চোখ বন্ধ করে ভেপার বা ইনহেলেশন নাক দিয়ে টেনে নিন। এতে ব্যাকটেরিয়া বা ভাইরাস নাক থেকে সহজেই দূর হবে। এ অসুখে সাধারণত অ্যান্টিহিস্টামিন জাতীয় ওষুধ খুব কার্যকর এবং এর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া নেই। তবে বাজারে চলতি নাকের ড্রপে সাময়িক আরাম মিললেও দীর্ঘদিন ব্যবহারে ঘ্রাণশক্তি কমে যেতে পারে। তাই চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া অযথা নাকের ড্রপ, টানা ব্যবহার করবেন না। সমস্যা বাড়লে নাক-কান-গলা চিকিৎসকের পরামর্শ নিন।
* কানের সমস্যা
শীতে নানা ব্যাকটেরিয়া ও ভাইরাস সক্রিয় হয়ে ওঠে। শুধু শীতকালে ঠান্ডা লেগেই কিন্তু কানে ইনফেকশন হয় না। সারা বছর ধরেই কানে ইনফেকশন হতে পারে। কেন এ ইনফেকশন হয় এবং কীভাবে তা রোধ করা সম্ভব, তা আগে থেকে জেনে রাখা ভালো।
* কানে ইনফেকশন কেন হয়
সাধারণত কানের বাইরের দিকে বা মধ্য কর্ণের ইনফেকশন হয়ে থাকে। ঠান্ডা লাগলে নাকের সর্দি কানের দিকে চলে গিয়ে ইনফেকশন হয়। বয়স্ক থেকে শিশু সবারই কানের ইনফেকশন হতে পারে। বর্তমানে শরীর সুস্থ রাখতে অনেকে সাঁতার কাটেন। সাঁতারের পর কান পরিষ্কার করতে ইয়ার বাড ব্যবহার করা হয়। ফলে খুব সহজেই কানে ব্যাকটেরিয়া প্রবেশ করে ও ইনফেকশন হতে পারে। বহিঃকানে তখন ফাঙ্গাল ইনফেকশন হওয়াটা স্বাভাবিক। এ ছাড়াও খুব ঠান্ডা লেগে উর্ধ্ব শ্বাসতন্ত্রে ইনফেকশন হলে তা কানে পৌঁছে যেতে পারে। শীতকালে আরেকটি বিষয় দেখা যায়, ঠান্ডা সর্দি লাগার পর শিশুরা বলছে তার কান ব্যথা করছে। এ ক্ষেত্রে দ্রুত একজন নাক, কান, গলা বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নেওয়া উচিত। কারণ পরামর্শ না নিলে ঠান্ডা সর্দি মধ্যকর্ণে প্রদাহ তৈরি করে ফেলে এবং অল্প সময়ের মধ্যে এমনকি ২৪ ঘণ্টার মধ্যে কানের পর্দা ফুটো হয়ে যেতে পারে।
* সমস্যা প্রতিরোধে করণীয়
কান পরিষ্কার রাখার জন্য কোন কিছু ব্যবহার করার প্রয়োজন নেই। কান নিজেই নিজেকে পরিষ্কার রাখতে সক্ষম। কান পরিষ্কার করতে বার বার কটনবাড ব্যবহার করলে ইনফেকশন হতে পারে। তারচেয়ে বরং রোজ গোসলের পরে তোয়ালে দিয়ে কানের যতটা অংশ মুছে নিতে পারেন। শীতকাল এলেই যাদেরকে কানের ইনফেকশনে ভুগতে হয় তাদের জন্য পরামর্শ হচ্ছে, নিয়মিত নাক পরিষ্কার করা। এতে ইনফেকশনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট পথ বা নালি স্বাভাবিক থাকে। এক্ষেত্রে প্রয়োজনে বাজারে প্রচলিত নরমাল স্যালাইন নাকের ড্রপ ব্যবহার করতে পারেন। শীতে রাতে বাইরে বেরোলেই কানঢাকা পোশাক পরতে হবে। বাঙালির চিরকালীন মাফলার, মাঙ্কি টুপি থেকে এখনকার বাহারি কানঢাকা, সুবিধা মতো কিছু একটা পরে নিলেই হলো।
লেখক : নাক-কান-গলা রোগ বিশেষজ্ঞ এবং হেড-নেক সার্জন, সিলেট এম এ জি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল।