অক্টোবর ২৮, ২০২৪ ৬:০৫ পূর্বাহ্ণ
কারাবন্দি সাবেক ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক আইসিটি খাতে হাজার কোটি টাকা লুটপাট করেছেন। আইসিটি খাতে মেগা প্রকল্প বাস্তবায়ন, নিয়োগ বাণিজ্য আর বিশেষ বরাদ্দ টি-আর, কাবিখা-কাবিটা প্রকল্পের নামে অর্থ লুটেছেন। ওই অর্থে নিজ এলাকা নাটোরের সিংড়ায় নামে-বেনামে গড়েছেন বিপুল সম্পত্তি। স্ত্রী, শ্যালকসহ স্বজনদের নামেও গড়েছেন সম্পদের পাহাড়। এছাড়া রাজধানী ঢাকা এবং দেশের বাইরেও রয়েছে তার বিপুল সম্পদ।
শুধু তাই নয়, একক ক্ষমতা পাকাপোক্ত করতে দলের যোগ্য নেতাকর্মীদের পদবঞ্চিত করে অযোগ্য ব্যক্তি ও আত্মীয়স্বজন, এমনকি বিরোধী পক্ষকে দলে এনে বিতর্কেরও সৃষ্টি করেন সাবেক এই প্রতিমন্ত্রী। ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পরপরই এলাকায় ফাইভ স্টার বাহিনী গড়ে তুলেও সমালোচনার মুখে পড়েন পলক। আবার সরকারের বিদায়ঘণ্টার আগমুহূর্তে শ্যালক লুৎফুল হাবিব রুবেলকে উপজেলা পরিষদের একক চেয়ারম্যান প্রার্থী করতে নানা নাটকের জন্ম দেন তিনি। তবে শেষ পর্যন্ত প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী দেলোয়ার হোসেন ওরফে পাশাকে অপহরণের ভিডিও ফুটেজ ভাইরাল হলে জনগণের তোপের মুখে পড়েন। শেষ পর্যন্ত শ্যালক লুৎফুল হাবিব রুবেলকে প্রার্থিতা প্রত্যাহার করে দেশের বাইরে পালাতে সহযোগিতা করেন।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সরব উপস্থিতি এবং মুখে মিষ্টি কথার ফাঁকে ছিল পলকের নানা ছলনা। তার পিএস, এপিএস ও পিএ (ব্যক্তিগত সহকারী) পর্যন্ত রাতারাতি আঙুল ফুলে কলাগাছে পরিণত হয়েছেন। তারাও গড়েছেন বিপুল সম্পদ ও অট্টালিকা। এর মধ্যে রয়েছেন উপজেলা আওয়ামী লীগের যুগ্মসাধারণ সম্পাদক মাওলানা রুহুল আমিন। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর তিনি মাদ্রাসার শিক্ষকতা ছেড়ে পলকের ব্যক্তিগত সহকারী নিযুক্ত হন। স্কুল-কলেজের নিয়োগ বাণিজ্য ও সরকারি বিভিন্ন দপ্তরে তার ছিল একক আধিপত্য। আরেক ব্যক্তিগত সহকারী রাকিবুল ইসলাম। পলকের আইসিটি দপ্তরের সব কার্যক্রম তার নিয়ন্ত্রণে ছিল। দপ্তরের সব প্রকল্পে অনিয়ম-দুর্নীতি, নিয়োগ বাণিজ্য ও সাধারণ মানুষকে প্রতারণার অভিযোগ তার বিরুদ্ধে। ২০২৩ সালে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি অধিদপ্তর কর্তৃক বাস্তবায়নাধীন ডিজিটাল সংযোগ স্থাপন (ইডিসি) প্রকল্পে সারা দেশে পাঁচ শতাধিক কর্মী নিয়োগে ব্যাপক বাণিজ্য করেন তিনি। আরও দুই ব্যক্তিগত সহকারীর মধ্যে রণজিত কুমার ও সাদ্দাম হোসেন একইভাবে সম্পদের পাহাড় গড়েছেন। সরকার পতনের পর জনরোষে সবাই গা ঢাকা দিয়েছেন।
বাবার রাজনীতির সূত্র ধরে পলকের ছাত্রলীগের রাজনীতিতে প্রবেশ। পরে একসময় উপজেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক পদ বাগিয়ে নেন। ২০০৮ সালে নাটোর-৩ (সিংড়া) আসনে দেশের সর্বকনিষ্ঠ সংসদ-সদস্য নির্বাচিত হন। হলফনামা অনুযায়ী প্রথম নির্বাচনে তিনি প্রায় সব টাকা ব্যয় করেন ধারদেনা করে। তখন তার মাত্র এক বিঘা কৃষিজমি আর ১৮ শতাংশ ভিটা জমি ছিল। ২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও সিংড়ার এই আসন থেকে সংসদ-সদস্য হন। তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পেয়েই ভাগ্যের চাকা ঘুরে যায় পলকের। ২০২৪ সালে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনি হলফনামায় পলক ও তার স্ত্রীর নামে অনেক টাকা, বাড়ি, গাড়ি ও বৈধ অস্ত্রের তথ্য উঠে আসে। স্ত্রী আরিফা জেসমিন কনিকা শুধু শিক্ষকতা করেই কোটি কোটি টাকা ও অঢেল সম্পদের মালিক বনে যান, যা পুরোপুরি ‘অবাস্তব’ বলছেন এলাকার লোকজন।
দৃশ্যমান সম্পদ : পলক নিজ এলাকা সিংড়া উপজেলাতেই দৃশ্যমান অনেক সম্পদ গড়েছেন। এর মধ্যে বড় ছেলে অপূর্ব জুনাইদের নামে জামতলী-বামিহাল রাস্তাসংলগ্ন চওড়া গ্রামে লিটন নামের এক ব্যক্তির কাছ থেকে ৪২ বিঘা পুকুর ও আমবাগান কিনেছেন, যা চওড়া মৌজার দাগ নম্বর ১৯০, ১৯১, ১৯২, ১৯৩, ১৯৮, ১৯৯, ২০০, ২০১, ২০২, ২১১, ২১৪, ২১৫, ২৯৩, ৩০৮, ৩০৯, ৩৪৪, ৫৬২। মা জামিলার নামে সুকাশ ইউনিয়নে আগমুরশন গ্রামে হেদায়েতুল্যা প্রামাণিকের কাছ থেকে ৩৬ বিঘা পুকুরসহ বাগান কিনেছেন (খতিয়ান নম্বর ২০৮, জেএল নম্বর ১১৩, আগমুরশন মৌজার দাগ নম্বর ৭০২, ৭৯৬, ৭৯৭, ৭৯৮, ৭৯৯, ৮০০ ও ৮০১। এর সাতটি দাগে ১২ একর ২৯ শতক জায়গার মধ্যে ১২ একরই জামিলার নামে কেনা)। সিংড়া পৌরসভার উপশহর এলাকায় স্ত্রী আরিফা জেসমিন কনিকা ও শ্যালক লুৎফুল হাবীবের নামে রয়েছে দুই কোটি টাকা মূল্যের দুটি পৃথক বিল্ডিং বাড়ি। শহরের মাদারীপুর ও চাঁদপুর রাস্তাসংলগ্ন এলাকায় স্ত্রীর নামে প্রায় ৫ কোটি টাকা মূল্যের ১৫ শতক মার্কেটের জায়গা কিনেছেন (কাটাপুকুরিয়া মৌজার দাগ নম্বর ৩৫১)।
থানা মোড় ও জোড়মল্লিকা এলাকায় শ্যালক রুবেলের নামে গড়েছেন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। স্ত্রী কনিকা ও শ্যালকের নামে ইটভাটা ও গরুর খামার। তাছাড়া নিজের নামে কিনেছেন ভাই জুবায়ের আহমেদ নয়ন ও বোন ফাহমিদা আহমেদের বিল্ডিং বাড়ি এবং জয়বাংলা মোড়ের সিংড়া মৌজায় উপজেলা আওয়ামী লীগের কার্যালয়। জেলা সদরে নাটোর জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের সামনে প্রায় ৫ কোটি টাকা মূল্যের জায়গাসহ মা জামিলা বেওয়া, স্ত্রী কনিকা ও স্বজনদের নামে-বেনামে চলনবিলের বিভিন্ন মাঠে ৫০০ থেকে ৭০০ বিঘা সম্পদের তথ্য পাওয়া যায়।
সূত্রমতে, এছাড়া ঢাকা শহরেও বিভিন্ন নামে কোটি কোটি টাকার ফ্ল্যাট-বাড়ি, গাড়ি ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান কিনেছেন। দেশের বাইরে সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, যুক্তরাষ্ট্রসহ বিভিন্ন দেশে পলক দম্পতির ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও বাড়ি-গাড়ি রয়েছে বলে তার নিকটাত্মীয়রা জানিয়েছেন। নিজ এলাকা শেরকোল ইউনিয়নে উন্নয়ন প্রকল্পের নামে কয়েক কোটি টাকা লোপাট করেছেন পলক ও তার শ্যালক শেরকোল ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান লুৎফুল হাবীব রুবেল।
চওড়া গ্রামে ৪২ বিঘা পুকুর ও আমবাগান দেখাশোনার দায়িত্বে নিয়োজিত রেজাউল করিম বলেন, ‘এখানে পুকুর, আমবাগান, যা কিছু দেখছেন সব প্রতিমন্ত্রী পলকের বলে এলাকাবাসী জানে। পুকুর লিজ নিয়ে মাছচাষ করছেন বাঁশবাড়িয়া গ্রামের ফরিদ উদ্দিন। আমি এখানে দেখাশোনার দায়িত্বে রয়েছি।’ চওড়া গ্রামের গৃহিণী নাছিমা বেগম বলেন, একসময় পলককে এলাকায় ঠিকাদারি করতে দেখেছি।
পলককে গ্রেফতারের আগেই স্ত্রী কনিকা, তিন সন্তান ও শ্যালক দেশের বাইরে পাড়ি জমান। বিদেশে আত্মগোপনে থাকা অবস্থায় পলকের স্ত্রী ফেসবুকে সংক্ষিপ্ত একটি ভিডিও ছেড়েছেন। সেখানে তিনি দাবি করেন, হাজার হাজার কোটি টাকার সম্পদ অর্জনের তথ্য সঠিক নয়। বরং তিন ছেলে, শাশুড়ি ও প্রতিবন্ধী ননদকে নিয়ে তিনি মানবেতর জীবনযাপন করছেন। তার এ ভিডিওবার্তার সমালোচনা করেছেন সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরাও।