সেপ্টেম্বর ১৭, ২০২৪ ৯:৪৩ পূর্বাহ্ণ
শেখ হাসিনার সরকারের পতনের পর থেকে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যকার সম্পর্ক নিয়ে চলছে নানা আলোচনা। এরমধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে ভারতে আশ্রয় নেয়া হাসিনাকে বিচারের জন্য বাংলাদেশে ফেরত পাঠানো বা তার প্রত্যর্পণের বিষয়টি। কেউ কেউ বলছেন, শেখ হাসিনার ভাগ্যের (দেশে ফেরত পাঠানো কিংবা না পাঠানো) ওপরই অনেকটা নির্ভর করছে ঢাকা-নয়াদিল্লি সম্পর্কের ভবিষ্যৎ।
সম্প্রতি এ নিয়ে এক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে জার্মান সংবাদমাধ্যম ডয়চে ভেলে। এতে বলা হয়েছে, বিচারের মুখোমুখি করার জন্য বাংলাদেশে দিন দিন শেখ হাসিনাকে প্রত্যর্পণের দাবি জোরালো হচ্ছে।
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটর অ্যাডভোকেট মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম সম্প্রতি শেখ হাসিনাকে ভয়াবহ সহিংসতার জন্য দায়ী ‘প্রধান অপরাধী’ হিসেবে অভিহিত করেছেন।
সাংবাদিকদের তিনি বলেছেন, ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের একটি অপরাধী প্রত্যর্পণ চুক্তি রয়েছে, যা ২০১৩ সালে স্বাক্ষরিত হয়েছিল, যখন শেখ হাসিনার সরকার ক্ষমতায় ছিল। যেহেতু তাকে (শেখ হাসিনা) বাংলাদেশে গণহত্যার প্রধান আসামি করা হয়েছে, আমরা তাকে আইনিভাবে দেশে ফিরিয়ে এনে বিচারের মুখোমুখি করার চেষ্টা করব।
ভারত সরকার শেখ হাসিনার অবস্থান সম্পর্কে বিস্তারিত কিছু না জানালেও, তিনি একটি ‘নিরাপদ জায়গায়’ আছেন বলে ধারণা করা হচ্ছে। বাংলাদেশের নতুন অন্তর্বর্তী সরকার এরমধ্যেই হাসিনার কূটনৈতিক পাসপোর্ট বাতিল করেছে।
হাসিনাকে ‘চুপ’ থাকার পরামর্শ
সরকারবিরোধী বিক্ষোভের সময় ‘হত্যা ও ভাঙচুরের সঙ্গে জড়িতদের শনাক্ত করে শাস্তি’ দেয়ার দাবি জানিয়ে ১৩ আগস্ট ভারতে বসে একটি বিবৃতি দিয়েছিলেন শেখ হাসিনা।
যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থানরত তার ছেলের (সজীব ওয়াজেদ জয়) মাধ্যমে প্রকাশিত ওই বিবৃতিতে শেখ হাসিনা ১৫ আগস্টকে জাতীয় শোক দিবস হিসেবে পালনের জন্য বাংলাদেশের জনগণের প্রতি আহ্বান জানান।
তবে ভারতে বসে শেখ হাসিনার এমন কার্যকলাপ নিয়ে প্রতিক্রিয়া জানান অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান ড. মুহাম্মদ ইউনূস। তিনি হাসিনার মন্তব্যকে ‘সমস্যাজনক’ বলে বর্ণনা করেছেন।
ভারতীয় বার্তা সংস্থা পিটিআইকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ভারতে কেউই তার (শেখ হাসিনার) অবস্থানে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করছে না। কারণ আমরা তাকে ফেরাতে চাই। তিনি ভারতে আছেন এবং মাঝে মাঝে তিনি কথা বলছেন, যা সমস্যার। তিনি চুপ থাকলে আমরা ভুলে যেতাম; মানুষ এটাকে ভুলে যেত। কিন্তু ভারতে বসে তিনি কথা বলছেন, নির্দেশ দিচ্ছেন। কেউ এটা পছন্দ করছে না।
পিটিআইকে তিনি আরও বলেন, ‘এটা আমাদের বা ভারতের জন্য ভালো নয়। এ নিয়ে অস্বস্তি রয়েছে।’
‘নিরাপদ’ স্থানান্তরের আশা
সাবেক কূটনীতিক এবং শিক্ষাবিদরা ডয়চে ভেলেকে বলেছেন, ঢাকা শেখ হাসিনাকে ফিরিয়ে দেয়ার আবেদন করলেও তা হয়তো প্রত্যাখ্যান করবে নয়াদিল্লি।
পাকিস্তানে ভারতের সাবেক হাইকমিশনার অজয় বিসারিয়ার মতে, ভারত কোনো পরিস্থিতিতেই শেখ হাসিনাকে বাংলাদেশের কাছে হস্তান্তর করবে না, চাপ যতই থাকুক না কেন। তবে ভারত চাইবে, সে (শেখ হাসিনা) তার পছন্দের কোনো একটি পশ্চিমা দেশে আশ্রয় পাক। এটি এমন উপায়ে করা হতে পারে, যাতে বাংলাদেশের নতুন সরকারের সঙ্গে ভারতের সম্পর্কের টানাপোড়েন সৃষ্টি না হয়।
সাবেক এ কূটনীতিক আরও বলেন, পরিস্থিতি স্থিতিশীল হলে নতুন সরকারের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তোলার জন্য ভারত বাংলাদেশ সফরে উচ্চ পর্যায়ের দূত, সম্ভবত পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে পাঠাতে পারে। কিন্তু শেখ হাসিনা ভারতে থাকা অবস্থায় এই সফর হলে, তা সেতু নির্মাণে (সম্পর্কের) ভারতের প্রচেষ্টাকে বাধাগ্রস্ত করতে পারে।
এদিকে ওয়াশিংটন শেখ হাসিনাকে গ্রহণ করার প্রস্তাব দিচ্ছে না উল্লেখ করে ভারতের সাবেক রাষ্ট্রদূত মীরা শঙ্কর বলেছেন, ‘যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য রাজনৈতিক আশ্রয় না দেয়ায় শেখ হাসিনা ভারতে আশ্রয় নিয়েছেন।’
প্রত্যর্পণের আলোচনা ‘অনুমানমূলক’!
দক্ষিণ এশিয়া বিশেষজ্ঞ শ্রীরাধা দত্ত ভারত এবং শেখ হাসিনার সরকারের মধ্যে দীর্ঘস্থায়ী সংযোগের দিকে ইঙ্গিত করে বলেছেন, ‘নির্বাসনের মাধ্যমে ভারত হাসিনাকে হতাশ করবে- এমন সম্ভাবনা কম’।
জিন্দাল গ্লোবাল ইউনিভার্সিটির আন্তর্জাতিক বিষয়ক অধ্যাপক শ্রীরাধা ডয়চে ভেলেকে বলেন, পরিস্থিতি মোকাবিলায় উভয় সরকারকেই (বাংলাদেশ-ভারত) বাস্তববাদিতা ও পরিপক্কতা দেখাতে হবে। হাসিনাকে থাকার অনুমতি দিলে দুই দেশের ভবিষ্যৎ সম্পর্কের ওপর এর প্রভাব পড়বে, এটা হওয়া উচিত নয়।
আগস্টের শেষের দিকে এক প্রেস ব্রিফিংয়ে ভারতীয় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র রণধীর জয়সওয়াল বলেছিলেন, প্রত্যর্পণ ‘অনুমানমূলক বিষয়ের ক্ষেত্রে’ ছিল।
তিনি সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমরা আগেই বলেছি, বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী নিরাপত্তার কারণে খুব অল্প সময়ের নোটিশে ভারতে এসেছিলেন। এই বিষয়ে আমাদের আর কিছু বলার নেই।’
বাংলাদেশের জন্য নয়াদিল্লির পরিকল্পনা কি অব্যাহত থাকবে?
বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে দ্বিপাক্ষিক প্রকল্পগুলো প্রভাবিত হয়েছে বলেও স্বীকার করেছিলেন জয়সওয়াল।
দক্ষিণ এশিয়ায় ভারতের বৃহত্তম বাণিজ্য অংশীদার বাংলাদেশ। ২০২২-২৩ অর্থবছরে ১৫ দশমিক ৯ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য হয়েছে বলেও অনুমান করা হয়। এছাড়া শেখ হাসিনা ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার আগে উভয় পক্ষেরই একটি মুক্ত বাণিজ্য চুক্তির জন্য আলোচনা শুরু করার কথা ছিল।
ঢাকায় রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর, ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারপ্রধান ড. ইউনূসের সঙ্গে কথা বলেছেন এবং প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, নয়াদিল্লি তার প্রতিবেশী দেশে উন্নয়ন প্রকল্পগুলো বাস্তবায়ন করা অব্যাহত রাখবে।
গণতান্ত্রিক, স্থিতিশীল, শান্তিপূর্ণ এবং প্রগতিশীল বাংলাদেশের প্রতি ভারতের সমর্থন অব্যাহত রাখার বিষয়টিও পুনরায় উল্লেখ করেছিলেন মোদি।
ভারতের ওপর বাংলাদেশের নির্ভরশীলতা
জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টার ফর সাউথ এশিয়ান স্টাডিজের সঞ্জয় ভরদ্বাজ বলেছেন, শেখ হাসিনার ভাগ্য উচ্চ রাজনৈতিক পর্যায়ে কিছুটা অস্বস্তি তৈরি করতে পারে। তবে তা বাংলাদেশ-ভারতের মধ্যে সহযোগিতার গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রগুলোতে প্রভাব ফেলবে না বলেই মনে করেন তিনি।
সঞ্জয় ভরদ্বাজের মতে, সম্পর্কটি অরাজনৈতিক ক্ষেত্রে আন্তঃনির্ভরশীলতার পরিমাণ দিয়ে নির্ধারিত হয়। যার মধ্যে রয়েছে বাণিজ্য, বিনিয়োগ, স্বাস্থ্য, শিক্ষা এবং বাংলাদেশ ও ভারতের জনগণের মধ্যে থাকা সম্পর্ক।
ডয়চে ভেলেকে সঞ্জয় বলেন, ‘বাংলাদেশের নতুন সরকার যদি তার দেশের প্রয়োজনীয়তা বুঝতে পারে, তবে তারা ভারতের সঙ্গে একমত হবে এবং তাদের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক সমস্যা ও উচ্চাকাঙ্ক্ষার কারণে চলমান উন্নয়ন অংশীদারিত্বকে ব্যাহত করবে না।’