অক্টোবর ২৫, ২০২৩ ১১:২৩ পূর্বাহ্ণ
চলমান রাজনৈতিক সংকট সমাধানে আওয়ামী লীগ এবং বিএনপির ওপর সংলাপে বসার তাগিদ থাকলেও কার্যকর কোনো উদ্যোগ নেই। যার যার অবস্থানে অনড় থেকে রাজপথেই নিজেদের শক্তি পরীক্ষায় অবতীর্ণ হচ্ছে দল দুটি। এতে পরিস্থিতি সংঘাতময় হয়ে ওঠার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। মাঠের প্রধান বিরোধী দল বিএনপি বলছে, আলোচনার এজেন্ডা হতে হবে নির্বাচনকালীন নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকার নিয়ে। অন্যদিকে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ চাইছে, ভোটগ্রহণ সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচিত দলীয় সরকারের অধীনেই হতে হবে। আগামী দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের জন্য আর ২ মাস যখন বাকি, তখন এই দুই বড় দলের মধ্যে বিদ্যমান অচলাবস্থা ভাঙার জন্য আবারও আলোচনায় বসার কথা সামনে এসেছে। কিন্তু এ ক্ষেত্রে কার্যকর উদ্যোগ নেই কোনো পক্ষ থেকেই। আওয়ামী লীগ ও বিএনপি সংলাপের পথ একেবারে বন্ধ, তা বলছে না। তবে তারা নিজেরা সংলাপের দায়িত্ব নিতে রাজি নয়। বরং ২৮ অক্টোবর রাজধানী ঢাকায় পালটাপালটি সমাবেশের মধ্য দিয়ে নিজেদের শক্তিমত্তার বিষয়টি জানান দিতে চায় দল দুটি। বিদ্যমান পরিস্থিতিতে সবার প্রশ্ন-তা হলে কী রাজপথেই ফয়সালা হবে।
কিছু দিন আগে রাজধানীর সিরডাপ মিলনায়তনে দ্য হাঙ্গার প্রজেক্টের উদ্যোগে সুশাসনের জন্য নাগরিক-সুজন’র সহযোগিতায় অনুষ্ঠিত এক আলোচনা সভায় বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাসহ বিশিষ্টজনরাও বলেছেন, জাতীয় নির্বাচন ঘিরে সৃষ্ট সংকট সমাধানে সংলাপের বিকল্প নেই। নিজেদের সমস্যা নিজেদেরই সমাধান করতে হবে। সংলাপ হলে পারস্পরিক আস্থা রাখতে হবে, ছাড় দেওয়ার মানসিকতা রাখতে হবে। সেখানে সুনির্দিষ্ট কিছু এজেন্ডা নির্ধারণ করতে হবে, যাতে আমরা ভবিষ্যতে সংকট এড়াতে পারি। আলোচনার টেবিলে বসেই সমস্যার সমাধান হওয়া দরকার বলেও এ সময় মতামত ব্যক্ত করেন তারা। বিভিন্ন সময় ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ, মাঠের বিরোধী দল বিএনপি, জাতীয় সংসদের প্রধান বিরোধী দল জাতীয় পার্টিসহ নিবন্ধিত ও অনিবন্ধিত বিভিন্ন রাজনৈতিক দলও সংকট সমাধানে সংলাপে বসার তাগিদ দিয়েছে। নির্বাচন কমিশনও দুই বড় দলকে আলোচনার টেবিলে বসার অনুরোধ জানিয়েছে। কেউ শর্ত জুড়ে দিয়ে আবার কেউ শর্ত ছাড়াই এক টেবিলে বসার পরামর্শ দিয়েছে আওয়ামী লীগ এবং বিএনপিকে। পাশাপাশি প্রভাবশালী বিভিন্ন দেশ, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যসহ ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলোর প্রতিনিধিরাও নির্বাচন সামনে রেখে চলমান সংকট আরও প্রকট হওয়ার আগেই সংলাপের মাধ্যমে সমাধানের পথে হাঁটার জন্য রাজনৈতিক দলগুলোকে এক টেবিলে বসতে বলেছে। তবে বাস্তবতা হচ্ছে-দুই বড় দলই চলছে উলটো পথে। তারা যার যার অবস্থানে অনড়, কেউ কাউকে ছাড় দিতেও নারাজ।
এ প্রসঙ্গে বিশিষ্ট আইনজীবী, সংবিধান বিশেষজ্ঞ ও গণফোরাম সভাপতি ড. কামাল হোসেন বলেন, পরিস্থিতি ক্রমেই যেদিকে যাচ্ছে, তাতে মনে হচ্ছে সমাধান না হলে দেশের পরিস্থিতি সংঘাতময় হয়ে উঠবে। এক দল গায়ের জোরে নির্বাচন করিয়ে নিতে চাইবে, আরেক দল যে কোনো মূল্যে তা প্রতিহত করতে চাইবে। ফলে নির্বাচনের আগে সহিংস হয়ে উঠবে দেশের রাজনৈতিক অঙ্গন। এ অবস্থা থেকে উত্তরণে সংলাপই একমাত্র সমাধান। তিনি আরও বলেন, যারা সরকারে রয়েছে, তাদের দায়িত্ব বেশি। তাই সরকারি দলকেই এক্ষেত্রে এগিয়ে আসতে হবে। আন্তরিকতা নিয়ে এক টেবিলে আলোচনার জন্য বসলে যে কোনো সমস্যার সমাধান সম্ভব।
বড় দুদলের এই বিপরীতমুখী অবস্থান সত্ত্বেও আলোচনার টেবিলে বসে রাজনৈতিক সমস্যার সমাধান চায় জাতীয় সংসদের প্রধান বিরোধী দল জাতীয় পার্টি। দলটির চেয়ারম্যান ও জাতীয় সংসদের বিরোধীদলীয় উপনেতা জিএম কাদের এমপি এ প্রসঙ্গে বলেন, আমরা সব সময় বলেছি, বহুবার বলেছি-আলোচনায় বসে সংকটের সমাধান বের করা জরুরি। আমরা মনে করি, অবশ্যই সংলাপের প্রয়োজন আছে। তবে দুই প্রধান দল যেভাবে যার যার অবস্থানে অনড় তাতে আমার মনে হয়, সংলাপে বসলেও কোনো সুফল মিলবে না।
সাবেক আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ বলেন, পালটাপালটি কর্মসূচিতে কি হচ্ছে বলা যাচ্ছে না। তবে আলোচনার পথে আসা উচিত। আলোচনার বিকল্প নেই। শর্ত দিয়ে সংলাপ হয় না-এমন মন্তব্য করে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য কর্নেল (অব.) ফারুক খান বলেন, আলোচনায় বসার আগেই যদি আপনি শর্ত জুড়ে দেন, তাহলে কি নিয়ে আলোচনা হবে। তিনি আরও বলেন, সংবিধান অনুযায়ী দলীয় সরকারের অধীনে একটি অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ এবং গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের আয়োজন করতে আওয়ামী লীগ প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। কিন্তু বিএনপি প্রথম থেকেই এই নির্বাচন বানচাল করতে চেষ্টা করছে। তারা নির্বাচন বানচালের নামে সংবিধানিক এবং গণতান্ত্রিক ধারা ব্যাহত করতে চায়। এটা দেশবাসীর কাছে পরিষ্কার হয়ে গেছে।
কর্নেল (অব.) ফারুক খানের এই বক্তব্যের বিরোধিতা করে বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব মো. হারুনুর রশীদ বলেন, আওয়ামী লীগ বারবার প্রমাণ করেছে তাদের অধীনে অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ এবং গ্রহণযোগ্য নির্বাচন সম্ভব নয়। তাই আমরা বর্তমান সরকারের পদত্যাগসহ নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন চাই। যে নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ এবং গ্রহণযোগ্য হবে। মানুষ শান্তিতে, নির্বিঘ্নে, পছন্দের ব্যক্তিকে ভোট দিতে পারবে-এমন একটা নির্বাচন আমরা চাই। তিনি আরও বলেন, আওয়ামী লীগ নিজেদের অধীনে ভোট দিয়ে গায়ের জোরে ক্ষমতায় থাকতে চায়। দেশের মানুষ তা হতে দেবে না।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বিএনপির সঙ্গে যুগপৎ আন্দোলনে থাকা নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না বলেন, ২০১৮ সালের নির্বাচনের আগে অনুষ্ঠিত সংলাপে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছিলেন, আমার ওপর আস্থা রাখুন, নির্বাচন সুষ্ঠু, অবাধ ও নিরপেক্ষ হবে। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী তার সেই প্রতিশ্রুতি রক্ষা করেননি। আমি মনে করি, এখন আর সংলাপের পরিবেশ নেই। তাছাড়া সংলাপের লক্ষণও নেই। মানুষের মধ্যে ভয়ের সংস্কৃতি বিরাজ করছে। সরকারি দল আস্থা ও বিশ্বাসের পরিবেশ নষ্ট করছে।
গণফোরামের একাংশের সাধারণ সম্পাদ অ্যাডভোকেট সুব্রত চৌধুরী বলেন, শেখ হাসিনার অধীনে নির্বাচনে যাওয়া আর না যাওয়া একই কথা। তিনি আরও বলেন, প্রধানমন্ত্রী যদি গো ধরে থাকেন, তাহলে রাজনৈতিক সংকট আরও তীব্র হবে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেলে এর দায় তাকেই নিতে হবে।
এ প্রসঙ্গে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন ১৪ দলীয় জোটের অন্যতম শরিক সাম্যবাদী দলের সাধারণ সম্পাদক দিলীয় বড়ুয়া বলেন, শর্ত ছাড়া সংলাপে বসতে হবে বিএনপিকে। তারা শর্ত জুড়ে দিয়েছে এ কারণেই যে, তারা জানে এটা আওয়ামী লীগের পক্ষে মেনে নেওয়া সম্ভব নয়। আওয়ামী লীগও মানবে না, সংলাপও হবে না। আর তখন তারা নির্বাচন বানচালের চেষ্টা করবে। আওয়ামী লীগও এটা মোকাবিলার চেষ্টা করবে।
সুশাসনের জন্য নাগরিক-সুজন সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার এ প্রসঙ্গে বলেন, স্বাধীনতার পর ৫২ বছর পেরিয়ে গেছে। এ সময়ের মধ্যেও আমরা আমাদের গণতান্ত্রিক ও নির্বাচনি ব্যবস্থাকে কার্যকর করতে পারিনি। আমরা আশা করি, আমাদের রাজনীতিবিদরা আলোচনায় বসে এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেবেন। তিনি আরও বলেন, বড় দুটো দলের মধ্যে যে সংলাপ হতে হবে সে বিষয়ে কোনো বিতর্ক নেই। কিন্তু সংলাপের ব্যাপারে ঐকমত্য নেই। বিদ্যমান রাজনৈতিক সংকট নিরসনের জন্য রাজনৈতিক ও আইনি সংস্কার দরকার। কিন্তু শুধু আইনি সংস্কার করেই সমস্যার সমাধান হবে না। একই সঙ্গে দরকার রাজনৈতিক সংস্কৃতিরও ইতিবাচক উন্নয়ন। নির্বাচনে পরাজিত দলের নেতাকর্মীদের জীবন-জীবিকা যাতে ক্ষতিগ্রস্ত না হয়, সে ব্যাপারেও রাজনৈতিক দলগুলোর ঐকমত্য থাকা দরকার।
মূলত নির্বাচনকালীন সরকারব্যবস্থা নিয়েই চলমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি দিন দিন উত্তপ্ত হয়ে উঠছে। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দিনক্ষণ ঘনিয়ে এসেছে। সংবিধান অনুযায়ী, ১ নভেম্বর থেকে ২৯ জানুয়ারির মধ্যে সংসদ নির্বাচন করার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। ২২ অক্টোবর একাদশ জাতীয় সংসদের শেষ অধিবেশন বসে। ২ নভেম্বর পর্যন্ত এই অধিবেশন চলার কথা। এরপর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে গঠন করা হবে নির্বাচনকালীন সরকার।
এ বিষয়ে স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ ড. তোফায়েল আহমেদ বলেন, সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা ও সদিচ্ছা থাকা দরকার। আর বৃহত্তর সমঝোতার লক্ষ্যে সংলাপের বিকল্প নেই। খোলামন নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোকে এটি করতে হবে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, আওয়ামী লীগ ও বিএনপি নেতারা প্রকাশ্যে এড়িয়ে গেলেও সংকট নিরসনে আলোচনায় বসতে রাজি। কিন্তু কোনো পক্ষই ছাড় দিতে রাজি নয়। সংলাপে বসতে জুড়ে দেওয়া হচ্ছে শর্ত। বিপত্তি এখানেই। আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারকদের কেউ কেউ মনে করছেন, নির্বাচনের আগে বিরোধীদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনার প্রয়োজন হতে পারে। এমন একটি তাগিদ হয়তো একপর্যায়ে আসতে পারে। কিন্তু শেখ হাসিনার পদত্যাগ এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন-এ দুটি বিষয়ে আওয়ামী লীগ সংলাপ করতে রাজি নয়। কারণ সংলাপে এ দুটি বিষয় এলেই রাজনৈতিকভাবে আওয়ামী লীগের এক ধরনের পরাজয় হয়ে যাবে। এমনকি ক্ষমতাসীন দলের কারও কারও মতে, শেখ হাসিনা ক্ষমতা ছেড়ে দেবেন-এমন বিন্দুমাত্র সম্ভাবনা নিয়ে সংলাপ করা হলে ভোটের আগেই হেরে যাবে আওয়ামী লীগ। ফলে এ দুটি বিষয় নিয়ে দলটি কোনো সংলাপে রাজি নয়। অন্যদিকে বিএনপিও তার অবস্থানে অনড়, তারা শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনে যাবে না। তারা রাজপথেই দাবি আদায় করতে চায়। আওয়ামী লীগও বিএনপিকে মোকাবিলায় মাঠে থাকবে, একই সঙ্গে নির্বাচনের প্রস্তুতি নেবে বলে ঘোষণা দিয়েছে।