জানুয়ারি ১৫, ২০২৪ ১০:৪০ পূর্বাহ্ণ
দায়িত্ব নেওয়ার প্রথম দিনে নিজ নিজ সেক্টর নিয়ে কঠোর বার্তা দিলেন কয়েকজন মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী। অনিয়ম-দুর্নীতি, সিন্ডিকেট, মজুতদারির বিরুদ্ধে সোচ্চার থাকার ঘোষণা দেন তারা। একই সঙ্গে আওয়ামী লীগের নির্বাচনি ইশতেহার বাস্তবায়ন করার ওপর গুরুত্বারোপ করেন তারা। আসন্ন রমজানে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে রাখতে উচ্চ অগ্রাধিকার দেওয়ার কথা জানিয়েছেন অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী। উন্নয়ন প্রকল্প শেষে পরিবহণ পুলে গাড়ি জমা না দিলে আগামী দিনে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া হবে বলে জানিয়েছেন জনপ্রশাসনমন্ত্রী ফরহাদ হোসেন। তিনি জানান, ক্যাডার বৈষম্য নিরসনে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া হবে।
বাণিজ্য প্রতিমন্ত্রী আহসানুল ইসলাম (টিটু) বলেছেন, দেশে নিত্যপণ্যের বাজারে কোনো সিন্ডিকেট থাকতে পারবে না। পণ্যের মজুতদারদের শক্ত হাতে দমন করা হবে।
সেবামূলক প্রতিষ্ঠান রেলওয়ের দুর্নীতি বন্ধের ঘোষণা দিয়েছেন রেলপথমন্ত্রী মো. জিল্লুল হাকিম। প্রায় একই ধরনের বক্তব্য দিয়েছেন কৃষিমন্ত্রী মো. আব্দুস শহীদ। তিনি ফসলের উৎপাদন বৃদ্ধি ও সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেবেন বলে জানান। আর ভূমি মন্ত্রণালয় ও অধীনস্থ সংস্থা ও দপ্তরের কর্মকর্তাদের পরিচ্ছন্নতার সঙ্গে দায়িত্ব পালনের আহ্বান জানিয়েছেন ভূমিমন্ত্রী নারায়ণ চন্দ্র চন্দ। শপথ নেওয়ার পর রোববার প্রথম কর্মদিবসে সচিবালয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীরা এসব কথা বলেন। ১১ জানুয়ারি নতুন মন্ত্রিসভার সদস্যরা শপথ নেন। শুক্র ও শনিবার সাপ্তাহিক ছুটির পর রোববার ছিল সচিবালয়ে তাদের প্রথম কর্মদিবস। কুয়াশাচ্ছন্ন শীতের সকালে একে একে সচিবালয়ে প্রবেশ করেন মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীরা। সচিবালয়ে পৌঁছালে নিজ মন্ত্রণালয়ের সচিবের নেতৃত্বে তাদের ফুল দিয়ে স্বাগত জানান কর্মকর্তারা। নতুন মন্ত্রীর সঙ্গে পরিচিত হন মন্ত্রণালয় এবং অধীনস্থ সংস্থা ও দপ্তরের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা। বিভিন্ন সংস্থা ও দপ্তরের কর্মকর্তারা সচিবালয়ে প্রবেশ করায় সেখানে গাড়ির জটও তৈরি হয়। অনেক মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী ওই যানজটে আটকা পড়েন।
প্রথম কর্মদিবসে প্রায় সবাই দুর্নীতির বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়ার কথা জানান। একই সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী তাদের যে দায়িত্ব ও সম্মান দিয়েছেন তার মর্যাদা রাখার প্রত্যয় ব্যক্ত করেন। এ সময় গণমাধ্যমের সহায়তা চান বেশ কয়েকজন মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী।
অর্থমন্ত্রী : অর্থ মন্ত্রণালয়ের সম্মেলন কক্ষে রোববার সাংবাদিকদের সঙ্গে মতবিনিময় করেন অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী। অর্থনীতিতে যেসব চ্যালেঞ্জ রয়েছে, তা মোকাবিলায় সবাইকে সঙ্গে নিয়ে কাজ করার কথা বলেন। তিনি আরও বলেন, কোনো সমস্যা রাতারাতি সমাধান হবে না। এজন্য সময় দিতে হবে। অর্থমন্ত্রী বলেন, সামনে রমজান মাস। দ্রব্যমূল্য যেন নিয়ন্ত্রণে থাকে, সেদিকে উচ্চ অগ্রাধিকার থাকবে। এ ব্যাপারে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে সঙ্গে নিয়ে কাজ করারও প্রতিশ্রুতি দেন তিনি। মন্ত্রী বলেন, প্রধানমন্ত্রী আমার ওপর আস্থা রেখে দায়িত্ব দিয়েছেন। সেই দায়িত্ব পালনে সচেষ্ট থাকব। আমি বসে থাকার লোক নই। আমার প্রথম কাজ-রোজায় জিনিসপত্রের দাম যেন না বাড়ে সেটি দেখা।
জনপ্রশাসনমন্ত্রী : প্রকল্প শেষ হওয়ার পর গাড়ি সরকারি পরিবহণ পুলে জমা না দিলে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া হবে বলে জানিয়েছেন জনপ্রশাসনমন্ত্রী ফরহাদ হোসেন। তিনি বলেন, আমরা ১৫ বছরের পুরোনো গাড়িগুলো পরিবর্তন করতে চাচ্ছি। আরেকটি চ্যালেঞ্জ, যেটি আমি করতে পারিনি, সেটি হচ্ছে প্রকল্পের আওতায় কেনা গাড়ি পরিবহণ পুলে জমা করা। বিভিন্ন কারণে যেসব গাড়ি পরিবহণ পুলে এসে জমা হয়নি, সেগুলোর বিষয়ে আইএমইডি থেকে আমরা তথ্য নেব। পরিবহণ পুলে গাড়ি জমা না দিলে বিষয়টি আমরা খুব শক্তভাবে দেখার চেষ্টা করব। ক্যাডার বৈষম্য প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ক্যাডার বৈষম্যের বিষয়গুলো আমরা এরই মধ্যে যথার্থভাবে দেখার চেষ্টা করেছি। সামনের দিনে এগুলো নিয়ে আমাদের কাজ করার সুযোগ থাকবে। আমরা চাইব বৈষম্য যাতে শূন্যে আসে। এ বিষয়ে আমরা কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করব।
রেলপথমন্ত্রী : রেলভবনে রেলপথমন্ত্রী মো. জিল্লুল হাকিম বলেন, আমরা রেলের দুর্নীতি বন্ধ করতে চাই। আমরা সবাই মিলে রেলের নিরাপত্তা, রেলের জমিগুলো বেদখল যেন না থাকে, সেসব বিষয় নিয়ে কাজ করব। সার্বিকভাবে রেলের উন্নয়ন করব। রেলের উন্নয়ন জনগণের জন্য।
পরিকল্পনামন্ত্রী : রাজধানীর শেরেবাংলা নগরে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের নিজ কার্যালয়ে পরিকল্পনামন্ত্রী মেজর জেনারেল (অব.) আব্দুস সালাম বলেন, দুর্নীতির বিষয়ে কোনো ছাড় নয়। যদিও এটি জাতীয় ইস্যু। এখানে হাত দেওয়া কঠিন। কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে দুর্নীতি নিরসনে সংগ্রাম চলছে, যুদ্ধ চলছে এবং জিহাদ চলছে। এই যুদ্ধকে এগিয়ে নেব। দুর্নীতির প্রশ্নে কোনো আপস নেই।
ভূমিমন্ত্রী : অনিয়ম-দুর্নীতি থেকে নিজে পরিচ্ছন্ন থাকবেন এবং তার মন্ত্রণালয় ও অধীন কর্মকর্তা-কর্মচারীদের পরিচ্ছন্ন থাকার আহ্বান জানিয়েছেন ভূমিমন্ত্রী নারায়ণ চন্দ্র চন্দ। সাংবাদিকদের তিনি বলেন, আমি একজন শিক্ষক ছিলাম। এছাড়া বিগত সময়ে একটি মন্ত্রণালয়ে আমি কাজ করেছি। আমি নিজে পরিচ্ছন্ন থাকব, সবাইকে পরিচ্ছন্ন থাকার জন্য আহ্বান জানাব। যদি কেউ না থাকেন, তবে সেখানে আইন স্বাভাবিক গতিতে চলবে, আইন তার পথ ধরে যাবে। ভূমি অফিসের হয়রানি-দুর্নীতির বিষয়ে তিনি বলেন, এ বিষয়ে তো অবশ্যই শক্ত অবস্থান হবে। আমরা যদি সবকিছু ডিজিটালাইজড করতে পারি, তবে দুর্নীতির সেই সুযোগটা তারা পাবে না। আমরা যদি একটি পর্যায়ে আইডির সঙ্গে একজন ব্যক্তির জমির হিসাবনিকাশ, খতিয়ান সবকিছু ঢুকাতে পারি, সেক্ষেত্রে তার ক্ষেত্রেও একটা সিকিউর পজিশন আসবে। প্রধানমন্ত্রী কোনো নির্দেশনা দিয়েছেন কি না জানতে চাইলে ভূমিমন্ত্রী বলেন, হ্যাঁ, নির্দেশনা দিয়েছেন। বলেছেন লক্ষ্যপূরণে যার যার মন্ত্রণালয়ের কাজ করতে হবে, গতি মন্থর যাতে না হয়। এরপরও কাজ করতে গেলে হিসাবনিকাশ করে কাজ করতে হবে। যে কাজটি করব সেটা কতটা ফলপ্রসূ হবে, নেতিবাচক প্রভাব আসবে কি না, বিবেচনা করে কাজ করতে হবে।
কৃষিমন্ত্রী : ফসলের উৎপাদন বৃদ্ধি ও সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়া হবে বলে জানিয়েছেন নতুন কৃষিমন্ত্রী মো. আব্দুস শহীদ। কৃষকদের উন্নতির জন্য সাধ্যের মধ্যে যা যা করার, তা করা হবে বলেও জানান তিনি। সিন্ডিকেট প্রসঙ্গে মন্ত্রী বলেন, সিন্ডিকেট সব জায়গায় থাকে। তাদের কীভাবে ক্র্যাশ করতে হবে, সেটার পদ্ধতি বের করতে হবে। কাউকে গলা টিপে মারার সুযোগ নেই আমাদের। কর্মের মাধ্যমে এগুলোকে কন্ট্রোল করতে হবে। সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণে গুরুত্বারোপ করা হবে। সিন্ডিকেট অবশ্যই দুর্বল হয়ে যাবে।
খাদ্যমন্ত্রী : খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার বলেছেন, ধান-চালের অবৈধ মজুতবিরোধী অভিযান জোরদার করবে সরকার। তিনি বলেন, দেশে ধান উৎপাদন ভালো হয়েছে। আমাদের খাদ্য মজুতও ভালো। বাজারে প্রচুর সরবরাহ আছে। তবে মিলাররা প্রতিযোগিতা করে ধান কেনায় প্রতিনিয়ত চালের দাম বাড়ছে। এ অশুভ প্রতিযোগিতা বন্ধ করতে খাদ্য মন্ত্রণালয় দ্রুত পদক্ষেপ নেবে। তিনি আরও বলেন, মজুতবিরোধী আইন ইতোমধ্যে পাশ হয়েছে। দ্রুত বিধি প্রণয়ন করে তা মাঠ পর্যায়ে বাস্তবায়ন করা হবে।
স্বাস্থ্যমন্ত্রী : প্রান্তিক পর্যায়ে মানসম্মত চিকিৎসা নিশ্চিত করাই স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের প্রধান লক্ষ্য হবে বলে মন্তব্য করেছেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী ডা. সামন্ত লাল সেন। তিনি বলেন, স্থানীয় পর্যায়ে ডাক্তার কেন থাকে না, তা খতিয়ে দেখা হবে। উপযুক্ত পরিবেশ তৈরিরও উদ্যোগ নেওয়া হবে। দুর্নীতির ব্যাপারে জিরো টলারেন্স নীতিতে থাকব। স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেন, প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকে চিকিৎসা সেবা পৌঁছে দেওয়ার জন্য আমি চেষ্টা করব। এটা করতে পারলে ঢাকা শহরে শুয়ে (ফ্লোরে) চিকিৎসা নিতে হবে না। আমি প্রতিটি হাসপাতালে যাব। কী কী সমস্যা আছে, জানব। তারপর আমি একটা কর্মপরিকল্পনা করব।
তথ্য ও সম্প্রচার প্রতিমন্ত্রী : তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে মতবিনিময় করেন তথ্য ও সম্প্রচার প্রতিমন্ত্রী মোহাম্মদ এ. আরাফাত। তিনি বলেন, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, তথ্যের অবাধ প্রবাহ এবং গণমাধ্যমের স্বাধীনতার অপব্যবহার করে যদি কোনো গোষ্ঠী অপপ্রচার ও মিথ্যাচার করে, সেটি গণতন্ত্র ও সাধারণ মানুষের জন্য ক্ষতিকর। এ ধরনের অপতৎপরতা জবাবদিহির আওতায় আনা নিশ্চিত করা হবে। প্রতিমন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশের বিপক্ষে বিশ্বব্যাপী যে মিস ইনফরমেশন ক্যাম্পেইন বা অপপ্রচার হচ্ছে, সেই ষড়যন্ত্র মোকাবিলাকে চ্যালেঞ্জ হিসাবে নিয়ে এগুলোকে জবাবদিহির আওতায় এনে তথ্যের অবাধ প্রবাহ কীভাবে আরও সুন্দর করা যায়, সে বিষয়গুলো নিয়ে আমি আপনাদের সঙ্গে আগামী দিনে কাজ করতে চাই।
বাণিজ্য প্রতিমন্ত্রী : সুষ্ঠু বাজার ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ এবং মজুতদারদের শক্ত হাতে দমন করা হবে বলে মন্তব্য করেছেন বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী আহসানুল ইসলাম (টিটু)। সিন্ডিকেট ভাঙার বিষয়ে তিনি বলেন, সিন্ডিকেট বলে কিছু নেই। কিছু লোক এ ধরনের কাজ করে থাকে। বড় বড় করপোরেট প্রতিষ্ঠানকে নিয়ন্ত্রণ করার যথেষ্ট টুলস রয়েছে। কোনো গোষ্ঠীর স্বার্থ রক্ষায় কাজ করব না, জনগণের স্বার্থ রক্ষায় কাজ করব।