ফেব্রুয়ারি ১৮, ২০২৪ ১১:০৩ পূর্বাহ্ণ
শহর কিংবা গ্রাম, সবখানেই দিন দিন বাড়ছে মাদকের বিস্তার। সর্বনাশা এই মাদকেই আসক্তি বেশি তরুণদের। এতে সমাজে দেখা দিচ্ছে মানবিক অবক্ষয়, জন্ম দিচ্ছে অপরাধ। শারীরিকভাবে ধ্বংস করে মাদক তরুণদের ফেলছে বিপর্যয়ে। সরকারের মাদকের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি, গ্রেফতার ও শাস্তি প্রদান অব্যাহত রয়েছে। তারপরও বাড়ছে এর চাহিদা। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মাদকের বিরুদ্ধে দলমত নির্বিশেষে সর্বস্তরের মানুষের সমন্বয়ে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে।
বদমেজাজ, চরম অবসাদ, আত্মহত্যার প্রবণতা, অসংলগ্ন ব্যবহার, হ্যালুসিনেশন, ভুলে যাওয়া, দুর্বলচিত্ততা, হতাশা ইত্যাদি মানসিক বিকারের শিকার হয় মাদকাসক্ত ব্যক্তি। স্ট্রোকে মৃত্যুবরণকারীদের মধ্যে মাদকাসক্তের সংখ্যা সর্বাধিক।
বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিকেল কলেজ, স্কুল-কলেজের ছাত্রছাত্রীরা বেশি মাদকাসক্ত। এছাড়া বাংলাদেশে এমন কোনো পেশা নেই, যে পেশায় মাদকসক্ত ব্যক্তি নেই।
মাদক ডেকে আনে অসুস্থতা—
কিডনি ও স্নায়ুর বিভিন্ন জটিলতা নিয়ে যখন রোগীরা ডাক্তার কিংবা মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞদের কাছে যান, তখন রোগীদের অতীত ইতিহাস জানতে পেরে তারা বুঝতে পারেন ঐ সব রোগী মাদকাসক্ত ছিলেন। মাদকাসক্ত বেশির ভাগ রোগী মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞদের কাছে যান।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ব্যাপক হারে মাদক ঢুকছে। মাদকাসক্ত তরুণদের মধ্যে শিক্ষিতের হারই বেশি। অল্প বয়সে তারা জটিল রোগে আক্রান্ত হচ্ছে, অনেকে শিক্ষাজীবন থেকে ঝরে যাচ্ছে। অনেক অভিভাবক এসে কান্নাকাটি করেন। তাদের করুণ কাহিনী শুনে হতবাক হয়ে যান বিশেষজ্ঞরা।
যখন সহজলভ্য মাদক—
দেশের সর্বত্র মাদক এখন সহজলভ্য। শহর-নগর, গ্রামসহ মফস্বল এলাকায়ও হাত বাড়ালেই পাওয়া যায় মাদক। ইয়াবা, হেরোইন, ফেনসিডিল, গাঁজা, আফিম, চরশ, বাংলা মদ, গুল, মরফিন, কোকেন, হেরোইন, প্যাথেলিন, মারিজুয়ানা, ডেক্রপরটেন, প্যাথেড্রিন, কোকেন, ইকসটামি, এলএসডি, ইলিকসার, চোলাইমদসহ রকমারি মাদকের সঙ্গে তরুণদের সংশ্লিষ্টতা বৃদ্ধি পাচ্ছে।
ধ্বংস হয় পরিবার—
এক জন মাদকাসক্ত সন্তানের কারণে একটি পরিবার ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। সেই সন্তানকে নিয়ে পরিবারগুলো দিশেহারা হয়ে পড়ছে। সর্বস্বান্ত হন তারা। মাদকাসক্ত সন্তানরা প্রায়ই মা-বাবার সঙ্গে খারাপ আচরণ করে, এমনকি চাহিদা অনুযায়ী অর্থ না দিলে মারধরও করে। খুনখারাবির মতো জঘন্য অপরাধের মূলেও মাদক।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর একাধিক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, রাজনীতি নিয়ে দলগত বিরোধ থাকলেও মাদক ব্যবসায় জড়িত রাজনৈতিক নেতাকর্মীরা তাদের এই অবৈধ ব্যবসার ক্ষেত্রে ঐক্যবদ্ধ। বর্তমানে ক্ষমতাসীনদের একশ্রেণির নেতাকর্মীর পৃষ্ঠপোষকতা পাচ্ছে মাদক ব্যবসায়ীরা। এ কারণে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ইচ্ছা করলেও মাদকের প্রসার নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না। প্রধানমন্ত্রী মাদকের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি ঘোষণা করেছেন। ধর্মীয় সংগঠনের নেতৃবৃন্দ, জনপ্রতিনিধি, সব দলের রাজনৈতিক নেতাকর্মীসহ সব পেশার মানুষকে মাদক নির্মূলে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন গড়ে না তুললে এটি নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়।
আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন বলেন, প্রধানমন্ত্রী মাদকের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি ঘোষণা করেছেন। জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহণ করে মাদকের বিরুদ্ধে পুলিশের অভিযান অব্যাহত আছে। প্রতি মাসে মাদকসংক্রান্ত অপরাধে গ্রেফতারকৃতদের সংখ্যাই সর্বাধিক, উদ্ধারও হচ্ছে বিপুল পরিমাণ মাদকদ্রব্য। তারপরও মাদকব্যবসা বন্ধ হচ্ছে না। পুলিশের একার পক্ষে মাদক নিয়ন্ত্রণ সম্ভব নয়। মাদক নির্মূল করতে সবার সহযোগিতা প্রয়োজন।
র্যাবের মহাপরিচালক এম খুরশীদ হোসেন বলেন, মাদক আমাদের জন্য হুমকি। এটা কারো একার পক্ষে নিয়ন্ত্রণ সম্ভব নয়। সবাই মিলে অলআউট খেলতে হবে, সাধারণ মানুষকে সচেতন করতে হবে। মাদক সেবন ও বিক্রি যারা করবে, তাদের ধরিয়ে দিতে সর্বস্তরের মানুষের এগিয়ে আসা প্রয়োজন। তরুণ সমাজ, দেশকে রক্ষা করতে হলে মাদকের বিরুদ্ধে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। এর কোনো বিকল্প নেই।
বিশিষ্ট মনোরোগ বিজ্ঞানী অধ্যাপক ড. মোহিত কামাল বলেন, মাদকে আসক্ত করতে তরুণদের টার্গেট করা হয়। প্রথমে ছলেবলে, আলাপের ছলে বিনামূল্যে মাদক দেওয়া হয়। পরে তারা মাদকে আসক্ত হয়ে পড়ে। বিভিন্ন মার্কেটের ব্যবসায়ীদেরও একইভাবে টার্গেট করা হচ্ছে। এই কায়দায় মাদক বিক্রির জন্য আসক্তের সংখ্যা বাড়ানো হয়। এই ধরনের অনেক রোগী তার কাছে চিকিৎসার জন্য এসে আসক্ত হওয়ার তথ্য এই চিকিৎসককে জানান। মাদকাসক্তদের মধ্যে সব পেশার মানুষই রয়েছে। তবে বেশি আসক্ত তরুণরা। তাদের মেজাজ খিটখিটে থাকে, ঘুম হয় না। সব ধরনের রোগে তারা আক্রান্ত হয়। স্থায়ীভাবে যৌন ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে।
তিনি বলেন, মাদকের কারণে মানবিক বিপর্যয় ঘটছে। দেশের তরুণ সমাজকে রক্ষা করতে হলে মাদকের বিরুদ্ধে দলমত নির্বিশেষে সব শ্রেণি-পেশার মানুষের সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে।
ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্সেস ও হাসপাতালের যুগ্ম-পরিচালক অধ্যাপক ডা. বদরুল আলম বলেন, স্কুল-কলেজপড়ুয়া অনেক রোগী নিউরো জটিলতা নিয়ে আসছে। তারা মূলত মাদকাসক্ত। বিভিন্ন মানসিক জটিলতা নিয়েও শিক্ষার্থীরা আসেন। অনেকে অল্প বয়সে স্ট্রোকে আক্রান্ত হচ্ছেন। কোকেন, ইয়াবা, ফেনসিডিল সেবন করলে দ্রুত স্ট্রোক হওয়ার আশঙ্কা থাকে। মাদকের কারণে রোগী যেমন বাড়ছে, তেমনি অপরাধও বাড়ছে।
তিনি বলেন, সর্বগ্রাসী মাদক কারো একার পক্ষে নিয়ন্ত্রণ সম্ভব নয়। এর বিরুদ্ধে সামাজিক আন্দোলনের মাধ্যমে জনসচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে। নইলে দেশ পরিচালনায় মেধাবীদের মারাত্মক সংকট দেখা দেবে। তরুণ সমাজকে রক্ষা করতে না পারলে দেশ রক্ষা হবে না।
অধ্যাপক ডা. বদরুল আলম একটি উদাহরণ তুলে ধরে বলেন, বাংলাদেশে বংশোদ্ভূত এক জন আমেরিকান নাগরিক স্ট্রোকে আক্রান্ত হয়ে তিন দফা তার কাছে চিকিৎসা নেন। ওষুধে তিনি সুস্থ হন না। তাকে পূর্বের ইতিহাস সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলে রোগী জানান, তিনি মাদক সেবন করতেন। এটা মাদকেরই কুফল। তার পরিবারের মতো অনেক পরিবার মাদকাসক্তদের চিকিৎসা করাতে গিয়ে আজ সর্বান্ত।
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের অতিরিক্ত পরিচালক মুজিবুর রহমান পাটোয়ারি বলেন, মাদক নির্মূল করতে হলে সব পেশার মানুষকে এগিয়ে আসতে হবে।
সম্প্রতি মাদক নিয়ে সরকারের শীর্ষ পর্যায়ে বৈঠক হয়। বৈঠকে মাদক ব্যবসায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর একশ্রেণির সদস্যের পৃষ্ঠপোষকতাসহ এই অবৈধ ব্যবসায় যারা জড়িত, তাদের তথ্য তুলে ধরা হয়। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর শীর্ষ কর্মকর্তারা ঐ বৈঠকে বলেন, মাদক নির্মূলে সব রাজনৈতিক নেতা, প্রশাসনসহ সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলা ছাড়া এটি নির্মূল সম্ভব নয়।