সারাদেশে ৩৬১টিতে কার্যক্রম শুরু; থানায় পুলিশের নিরাপত্তায় সেনা ও আনসার

সারাদেশে ৩৬১টিতে কার্যক্রম শুরু; থানায় পুলিশের নিরাপত্তায় সেনা ও আনসার

জাতীয় স্লাইড

আগস্ট ১০, ২০২৪ ৮:৩০ পূর্বাহ্ণ

রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি হচ্ছে। পুলিশ সদস্যদের নিরাপত্তায় থানায় থানায় মোতায়েন করা হয়েছে সেনা ও আনসার সদস্য। এতে আতঙ্ক কাটতে শুরু করছে পুলিশ সদস্যদের।

এই অবস্থায় নজিরবিহীন নিরাপত্তাহীনতায় পড়ে যায় গোটা দেশ। অবস্থার উন্নতিতে পুলিশের আইজি, ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (ডিএমপি) কমিশনার এবং র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‌্যাব) মহাপরিচালকসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর গুরুত্বপূর্ণ পদে আনা হয় পরিবর্তন। মাঠপর্যায়ের সদস্যদের মধ্যে আস্থা ফেরাতে নেওয়া হয় নানা উদ্যোগ। যা এখনো অব্যাহত।

এরই মধ্যে বৃহস্পতিবার রাতে শপথ গ্রহণ করেন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস ও অন্যান্য উপদেষ্টারা। এরপর থেকেই স্বাভাবিক হতে শুরু করেছে দেশের সামগ্রিক আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি। তবে পুরোপুরি স্বাভাবিক হতে আরও সময় লাগবে। বিভিন্ন এলাকায় সরেজমিন ঘুরে এবং সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে।

জানা যায়, সব থানার কার্যক্রম এখনো শুরু হয়নি। রাজধানীর ৫১টি থানার মধ্যে শুক্রবার ২৯টি থানার কার্যক্রম চালু হয়। পুলিশ সদর দপ্তর এবং ডিএমপি সদর দপ্তরসহ পুলিশের বিভিন্ন স্থাপনায় এদিন কম-বেশি পুলিশ সদস্য উপস্থিত ছিলেন। শুক্রবার রাতে এক বিজ্ঞপ্তিতে পুলিশ সদর দপ্তর জানিয়েছে, ১১০টি মেট্রোপলিটন থানার মধ্যে ৭০টি এবং রেঞ্জের ৫২৯টি থানার মধ্যে ২৯১টি- সর্বমোট ৩৬১টি থানার কার্যক্রম চালু হয়েছে।

থানাগুলোতে সেনা সদস্যরা থাকায় থানায় কর্মরতদের মধ্যে নিরাপত্তাহীনতা কমেছে। তবে আতঙ্ক একেবারে কমেনি। থানা পুলিশকে শুক্রবার বাইরে কোনো অপারেশনে যেতে দেখা যায়নি। ছাত্র-জনতা বিভিন্ন স্থান থেকে অপতৎপরতাকারীদের ধরে থানায় সোপর্দ করার পর পুলিশকে যথাযথ ব্যবস্থা নিতে দেখা গেছে।
কোনো কোনো এলাকায় স্থানীয়দের সহযোগিতায় আনসার সদস্যদের অভিযান পরিচালনা করতে দেখা গেছে। শুক্রবারও রাস্তায় ট্রাফিক পুলিশের কোনো সদস্য চোখে পড়েনি। এদিন শিক্ষার্থীদের ট্রাফিক পুলিশের দায়িত্ব পালন করতে দেখা গেছে। ঝাড়ু দিয়ে রাস্তা পরিষ্কার করতে দেখা গেছে তাদের। সড়কে চোখে পড়েছে সুশৃঙ্খল অবস্থা।

শুক্রবার বেলা আড়াইটার দিকে সচিবালয়ের গেটে গিয়ে দেখা যায়, সেখানে সেনা সদস্যরা দায়িত্ব পালন করছেন। এ সময় প্রতিবেদক ভেতরে প্রবেশ করতে চাইলে সেনা সদস্যরা কারণ জানতে চান।
পেশাগত কাজে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে যাওয়ার কথা জানালে সেনা সদস্যরা বলেন, কয়েকজন উপদেষ্টা ও সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা সচিবালয়ে প্রবেশ করেছিলেন। কাজ শেষে তারা ইতোমধ্যেই বের হয়ে গেছেন। আজ শুক্রবার। তাই আজ যেন আর কেউ সচিবালয়ে প্রবেশ করতে না পারে সে ব্যাপারে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। তাই আপাতত কাউকে ভেতরে ঢুকতে দিচ্ছি না।

বেলা ৩টার দিকে রমনা থানায় গিয়ে সেনা সদস্যদের চোখে পড়ে। পরিচয় দিয়ে আইডি কার্ড দেখিয়ে ভেতরে যাওয়ার পর দেখা যায় থানার ডিউটি অফিসারসহ অন্য সদস্যরা রুটিনওয়ার্ক করছেন। থানার ওসি উৎপল কুমার বলেন, আমাদের থানা অনেকটা অরক্ষিত তারপরও এখানে কোনো হামলা হয়নি।

কারণ, সাম্প্রতিক আন্দোলনের সময় আমরা কাউকে গুলি করিনি। সবার সঙ্গে মিলেমিশে থাকার চেষ্টা করেছি। ওই থানার পরিদর্শক (তদন্ত) আব্দুল হাই বলেন, যেসব থানার প্রতি মানুষের দীর্ঘদিনের ক্ষোভ ছিল সেসব থানাতেই হামলা হয়েছে। বেলা সাড়ে ৩টার দিকে পল্টন থানায় গিয়ে দেখা যায়, থানার গেটে তালা ঝুলছে।

হাতিরঝিল থানায় গিয়ে দেখা যায়, বাইরে পাহারায় নিয়োজিত আছেন সেনা সদস্যরা। ভেতরে দায়িত্ব পালন করছেন পুলিশ সদস্যরা। ওসির রুমে প্রবেশ করে দেখা যায়, ওসির চেয়ারে বসে থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে ব্রিফ করছেন অতিরিক্ত উপকমিশনার (এডিসি) হাফিজ আল ফারুক।

তিনি বলেন, ৫ আগস্ট থানা আক্রান্ত হওয়ার পর মাঠপর্যায়ের পুলিশ কর্মকর্তাদের মনোবল ভেঙে গেছে। তাদের মনোবল ফেরানোর চেষ্টা করছি। তিনি বলেন, হামলার সময় আমি তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল থানায় অবস্থান করছিলাম। হঠাৎ হাজার হাজার মানুষ থানায় এসে আক্রমণ করে। পুলিশ সদস্যরা কী করবেন তা বুঝতে পারছিলেন না।

আমার নির্দেশনা চাওয়ার পর তাদের বলি, যে যেভাবে পারো আত্মরক্ষা কর। জীবন বাঁচাতে আমিসহ সব পুলিশ সদস্য থানা থেকে চলে গেলে হামলাকারীরা পুরো থানা পুড়িয়ে দেয়। থানায় এখন কিছু নেই। শিগগরিই চেয়ার-টেবিল বসিয়ে ওই থানার কার্যক্রম শুরু করব। তিনি বলেন, এমন আকস্মিকভাবে ঘটনাগুলো ঘটেছে যে, ঊর্ধ্বতন অফিসাররা কোনো নির্দেশনা দিতে পারেননি। এ কারণে পুলিশের অনেক সদস্য হতাহত হয়েছেন। আমি নিজেও আহত হয়েছি।

হাতিরঝিল থানা থেকে বের হওয়ার সময় দেখা যায়, ছাত্র-জনতা একজনকে ধরে নিয়ে থানায় প্রবেশ করছেন। পরে জানা যায়, ধৃত ব্যক্তির নাম মিজান (২৫)। তার গ্রামের বাড়ি মাদারীপুর। হাতিরঝিলের সোনালীবাগ এলাকায় থাকেন। সেখানে মিজানসহ কয়েকজন একটি টিনশেড বাড়িতে গিয়ে চাঁদা দাবি করেন। চাঁদা না দেওয়ায় সেই বাড়িতে হামলা চালান। খবর পেয়ে রাস্তায় দায়িত্বরত ছাত্ররা সেখানে গেলে অন্যরা পালিয়ে যান। মিজানকে তারা একটি ভারী হাতুড়িসহ আটক করে।

আটকের পর থানার ওসি রুমে নেওয়া হলে ওসি তাকে থানা হাজতে পাঠানোর নির্দেশ দেন। স্থানীয় অকমাম আহসান গজনবী বলেন, চাঁদা না পেয়ে মিজান ওই বাড়িটি দখল করতে চেয়েছিল। তাই আমরা তাকে আটক করে পুলিশে দিয়েছি।

শুক্রবার সকালে তেজগাঁও থানায় আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে সেনাবাহিনী ও পুলিশের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, সেনাবাহিনীর সদস্যদের সহায়তায় ডিএমপির ২৯টি থানার কার্যক্রম শুরু করা হয়েছে। এসব থানায় অনেক পুলিশ সদস্য কাজে যোগ দিয়েছেন এবং বাকিরাও আসতে শুরু করেছেন বলে জানিয়েছে পুলিশ।

সেনাবাহিনীর ২৫ ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্ট কোম্পানির অধিনায়ক শাখাওয়াত খন্দকার বলেন, সেদিন (৫ আগস্ট) প্রচণ্ড জনমানুষের স্রোত ছিল। তাদের নিয়ন্ত্রণ করা যখন কঠিন হয়ে যাচ্ছিল। সাধারণ মানুষের সঙ্গে দুর্বৃত্তরা পুলিশসহ মানুষ হত্যা করছে। তখন আমরা ডিসিশন নিয়েছি থানা একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা। পুলিশ সদস্যদের বাঁচাতে হবে।

তারা জনগণের সেবক। তাদের আবার রিফর্ম করার সুযোগ করতে হবে। এছাড়াও তেজগাঁও থানায় কয়েকশ পরিবার আছে, পুলিশ সদস্যরা আছেন। থানায় অনেক অস্ত্র আছে। সেগুলো দুর্বৃত্তদের কাছে গেলে দেশ চরম ঝুঁকির মধ্যে পড়বে। তখন আমরা থানার নিরাপত্তা জোরদারের ব্যবস্থা করেছি। অধিনায়ক শাখাওয়াত আরও বলেন, আমরা এ এলাকায় ছাত্র-শিক্ষক, ব্যবসায়ী, স্কাউট, বিএনসিসি ও আনসার বাহিনীসহ গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের সঙ্গে সমন্বয় সভা করেছি। পুলিশ বাহিনীকে রিফর্ম করতে তারা মতামত দিয়েছেন।

ডিএমপির তেজগাঁও বিভাগের ডিসি এএইচএম আজিমুল হক বলেন, সামরিক বাহিনীর সহায়তায় আমরা পুলিশের সব কার্যক্রম শুরু করেছি। সব নাগরিকের কাছে অনুরোধ, আপনারা থানায় আসুন। আপনাদের সেবা দিতে আমরা প্রস্তুত। তিনি বলেন, তেজগাঁও বিভাগে ৬টি থানার মধ্যে ৩টি থানার কার্যক্রম পুরোপুরি চালু হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত থানায় স্বল্প পরিসরে কাজ চলছে। এরই মধ্যে থানাগুলোতে অনেক পুলিশ সদস্য কাজে যোগ দিয়েছেন। বাকিরাও আসতে শুরু করেছেন। আমরা আশা করছি দুপুরের মধ্যে আমাদের সব পুলিশ সদস্য কর্মস্থলে যোগ দেবেন।

তেজগাঁও থানার ওসি মোহাম্মদ মহসীন বলেন, কিছুদিন আগেও আমরা সবাই একসঙ্গে কাজ করেছি। আজ অনেক পুলিশ সদস্য আমাদের কাছে নেই। অনেকে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। আমাদের কিছু ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার জন্য আমরা অনেক ভুল করেছি। মানুষের সঙ্গে আমাদের ভুল বোঝাবুঝি হয়েছে। আসলে আমরা জনগণের সেবক। জনগণই আমাদের মূল। আপনারা থানায় আসুন। আপনাদের সেবায় আমরা প্রস্তুত রয়েছি।

শুক্রবার দুপুরে খিলক্ষেত থানায় গিয়ে দেখা যায়, সেনা সদস্যদের সঙ্গে আনসার সদস্যরাও দায়িত্ব পালন করছেন। তবে এই থানায় কোনো পুলিশ সদস্য কাজে যোগ দেননি। থানার ভেতরে আসবাবপত্র ভাঙাচুরা অবস্থায় পড়ে ছিল।

পুলিশ জানিয়েছে, রমনা বিভাগের ৬টি থানারই কার্যক্রম শুরু হয়েছে এবং অধিকাংশ সদস্য কাজে যোগ দিয়েছেন। মতিঝিল বিভাগের ৭ থানার ৬টির কার্যক্রম শুরু হয়েছে। অর্ধেকের বেশি সদস্য ফিরেছেন। এছাড়া তেজগাঁও বিভাগের ৬ থানারই কার্যক্রম শুরু হয়েছে এবং অধিকাংশ সদস্যরা কাজে ফিরেছেন। ওয়ারী বিভাগের ৪ থানার কার্যক্রম শুরু হয়েছে।

মিরপুর প্রতিনিধি জানিয়েছেন, রাজধানীর মিরপুরের দারুসসালাম এলাকায় স্থানীয়দের সহযোগিতায় অস্ত্র উদ্ধার করছেন আনসার ব্যাটালিয়নের সদস্যরা। ৭ ও ৮ আগস্ট দারুসসালামের বিভিন্ন এলাকা থেকে ২টি পিস্তল ও ৩টি শটগান উদ্ধার করা হয়েছে।

উত্তরা (পূর্ব থানা) প্রতিনিধি জানান, রাজধানীর উত্তরায় গত কয়েক রাত ধরে উত্তরা পূর্ব থানা এলাকাসহ বিভিন্ন এলাকায় ডাকাতের উৎপাত দেখা দিয়েছে। উত্তরা পূর্ব, উত্তরা পশ্চিম, তুরাগ, তুরাগ, বিমানবন্দর, দক্ষিণখান, উত্তরখান ও খিলক্ষেতসহ বিভিন্ন এলাকায় নিজস্ব টিম গঠন করে পাহারা দিচ্ছেন স্থানীয় বাসিন্দারা।

স্থানীয় প্রশাসনের পক্ষ থেকে নাশকতামূলক কর্মকাণ্ড, হানাহানি এবং যে কোনো ধরনের অপ্রীতিকর ঘটনায় নিকটস্থ সেনাবাহিনী ক্যাম্পে যোগাযোগ করার জন্য অনুরোধ করা হয়েছে। পাশাপাশি মিথ্যা তথ্য প্রদান ও গুজবে আতঙ্কিত হয়ে সেনাবাহিনীকে বিভ্রান্ত করা থেকে বিরত থাকতেও বলা হয়েছে।

এদিকে আইএসপিআর এক বিজ্ঞপ্তিতে জানিয়েছে, সম্প্রতি দেশের বিভিন্ন থানা ও কারাগার থেকে অস্ত্র ও গোলাবারুদ লুটপাটের কিছু ঘটনা ঘটেছে। এক্ষেত্রে কারও কাছে রক্ষিত এ ধরনের অস্ত্র ও গোলাবারুদ বা এ সংক্রান্ত কোনো তথ্য থাকলে অতি দ্রুত নিকটস্থ সেনাক্যাম্পে জমা বা যোগাযোগ করার জন্য অনুরোধ করা হলো।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *