ফেব্রুয়ারি ২৯, ২০২৪ ১২:১৪ অপরাহ্ণ
রেলের টিকিট যেন সোনার হরিণ। কাউন্টারে তো বটেই, বাংলাদেশ রেলওয়ের অনলাইনের মাধ্যমে ছাড়া টিকিটও শেষ হয়ে যাচ্ছে নিমিষেই। এদিকে ট্রেনের টিকিট ঘিরে স্টেশনগুলোসহ অনলাইনে কালোবাজারিদের দৌরাত্ম্য প্রায় ওপেন সিক্রেট। যার প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে টিকিট কালোবাজারিদের বিরুদ্ধে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নিয়মিত অভিযানে।
সামাজিক মাধ্যমে ক্ষোভ উগড়ে দিচ্ছেন ভুক্তভোগীরা
দিন দুয়েক আগে একটি আইডি থেকে ঢাকা-কক্সবাজার রুটের ট্রেনের টিকিট কাটা নিয়ে নিজের তিক্ত অভিজ্ঞতা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে তুলে ধরেন এক ভুক্তভোগী। সেখানে বলা হয়, ‘ঢাকা টু কক্সবাজার রুটে ৬ মার্চের (১০দিন আগে) ট্রেনের টিকিট কাটার জন্য সকাল ৭.৫০ মিনিটে সার্ভারে ঢুকে বসে ছিলাম। কারণ ৮টায় সার্ভার খুলবে। ৮টায় সার্ভার খুলল বটে, কিন্তু ৩০ সেকেন্ডের মধ্যে আর কোনো সিট খালি নেই! ৩০ সেকেন্ডে সিট খালি হওয়া কীভাবে সম্ভব! টিকিট কাটার জন্য তো কিছুটা সময় লাগে! জানি না ভূতেরা ট্রেনে করে সমুদ্র দেখতে যায় কিনা!’
এই ভূতেদের খোঁজ পাওয়া যায় ফেসবুকে নিচে তুলে ধরা একটি কমেন্টে। যেখানে তিন দিন আগে একটি আইডি থেকে বলা হয়, ‘ট্রেনে করে কক্সবাজার যাবার সেই দিনটি আমাদের আজ। এই টিকিট যদিও আমার, এখানে দেখবেন নামের জায়গায় আমার নয় বরং শামসুন্নাহার নামে একজনের নাম লেখা। কারণ এই টিকিটটি আমি কালোবাজারে পেয়েছি এবং দাম ছিল টোটাল ৩০০০ টাকা, যদিও এখানে ২৬৫০ টাকা উল্লেখ করা। ঢাকা টু কক্সবাজারে টিকিট এখন সোনার হরিণ। সহজে পাওয়া অসম্ভব ব্যাপার।’
বলাই বাহুল্য পোস্টদাতা টিকিটটি পেয়েছেন কালোবাজারে এবং এর জন্য টিকিটের নির্ধারিত দামের থেকে অতিরিক্ত অর্থ খরচ করতে হয়েছে তাকে। আর এই অতিরিক্ত অর্থ হাতিয়ে নিয়েছে টিকিট কালোবাজারি নামের ভূতেরা। এখন দেখার বিষয় কীভাবে নিমিষেই হাওয়া হয়ে যাচ্ছে স্বপ্নের ট্রেনের টিকিট।
অনলাইন থেকে নিমিষেই হাওয়া হচ্ছে টিকিট
ভুক্তভোগীরা জানাচ্ছেন, রেলওয়ের ওয়েবসাইট টিকিট বিক্রির জন্য উন্মুক্ত করার পর যাত্রীরা সার্ভারে ঢুকতেই তাদের দেখানো হচ্ছে টিকিট নেই। অর্থাৎ কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে হাওয়া হয়ে যাচ্ছে টিকিট। পরবর্তীতে তা দালালদের কাছে পাওয়া যাচ্ছে। বিনিময়ে টিকিট প্রতি গুণতে হচ্ছে বাড়তি অর্থ।
খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, সারা দেশেই স্টেশনগুলো ঘিরে টিকিট কালোবাজারিদের একটি সিন্ডিকেট গড়ে উঠেছে। এই সিন্ডিকেটের সঙ্গে জড়িত রয়েছে রেলওয়েরই এক শ্রেণির অসাধু কর্মচারী। যা বারবার প্রমাণিত হচ্ছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অভিযানে। এ সব অভিযানে টিকিট কালোবাজারি চক্রের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতার অভিযোগে নিয়মিতই আটক হচ্ছেন রেলওয়ের কর্মীরা।
স্টেশনগুলোতে যেভাবে হচ্ছে ট্রেনের টিকিটের কালোবাজারি
টিকিট কালোবাজারিরা স্টেশনের টিকিট বিক্রির কাউন্টারগুলোতে নিজেরা কিংবা তাদের অধীনস্থ সিন্ডিকেটের সদস্যরা কিংবা সামান্য অর্থের বিনিময়ে রিকশা চালক, ভ্যানচালক, কুলি ভিক্ষুকসহ স্টেশনগুলো ঘিরে অবস্থান করা ভাসমান ব্যক্তিরাসহ বিভিন্ন ধরনের লোকদের দাঁড় করিয়ে টিকিট সংগ্রহ করায়। প্রতিজনের নামে চারটি করে টিকিট সংগ্রহ করায়। তাদের এই কাজে সহযোগিতা করে এক শ্রেণির টিকিট বুকিংয়ের দায়িত্বে থাকা অসাধু কর্মচারীরা। তারা নিজের বুকিং আইডি নিয়ে সার্ভারে ঢুকে বিভিন্ন গন্তব্যের ট্রেনের টিকিট কেটে নিজের কাছে রেখে দিতেন। পরে কালোবাজারিদের কাছে লভ্যাংশের বিনিময়ে সরবরাহ করতেন সেই টিকিট।
অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এসব টিকিট কেনায় কালোবাজারি বা দালালদের সরবরাহ করা বিভিন্নজনের জাতীয় পরিচয়পত্র ও মোবাইল নম্বর ব্যবহার করা হত।
আবার এই অসাধু কর্মচারীরা অনেক ক্ষেত্রে টিকিট কাটতে আসা যাত্রীদের থেকে কৌশলে সংগ্রহ করা ন্যাশনাল আইডি কার্ডের নম্বর সংগ্রহ করে তার মাধ্যমে টিকিট কেটে রাখতেন। পরবর্তীতে সেসব টিকিট সরবরাহ করা হতো কালোবাজারিদের হাতে।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে ধরা পড়ছেন রেলওয়ের কর্মীরা
কালোবাজারি প্রতিরোধে পরিচালিত অভিযানে নিয়মিতই ধরা পড়ছেন টিকিট কালোবাজারির সঙ্গে জড়িত রেলওয়ের কর্মীরা। সম্প্রতি ঢাকা ও ময়মনসিংহ থেকে আটক করা হয় তিনজন রেলওয়ের বুকিং সহকারীকে, যারা সরাসরি টিকিট কালোবাজারির সঙ্গে জড়িত। এদের মধ্যে গত ৫ ফেব্রুয়ারি গ্রেফতার হন ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট রেলওয়ে স্টেশনের বুকিং সহকারী নূর আলম মিয়া ও ময়মনসিংহ রেলওয়ে স্টেশনের বুকিং সহকারী রফিকুল ইসলাম। পরবর্তীতে গত ১৪ ফেব্রুয়ারি গ্রেফতার হন বিমানবন্দর রেলওয়ে স্টেশনের বুকিং সহকারী সাথী আক্তার।
তাদের গ্রেফতার করা রেলওয়ে পুলিশ সুপার আনোয়ার হোসেন সংবাদমাধ্যমকে জানান, এই তিনজন বুকিং সহকারীর কাজের ধরন প্রায় অনুরূপ। তারা নিজেদের বুকিং আইডি দিয়ে টিকিট কেটে রেখে পরবর্তীতে সেসব টিকিট সরবরাহ করতেন কালোবাজারিদের হাতে। এছাড়া ময়মনসিংহ রেলওয়ে স্টেশনের বুকিং সহকারী রফিকুল ইসলামের ক্ষেত্রে দেখা গেছে, তিনি স্টেশনের টিকিট কাটতে আসা যাত্রীদের জাতীয় পরিচয়পত্র নম্বর ও মোবাইল নম্বর ডায়েরিতে টুকে রাখতেন। তারপরে সময় সুযোগ মতো সেইসব পরিচয়পত্র নম্বর ও মোবাইল নম্বর দিয়ে টিকিট কেটে কালোবাজারিদের হাতে তুলে দিতেন।
প্রযুক্তির দুর্বলতাকে পুঁজি করছে প্রযুক্তিতে দক্ষ কালোবাজারিরা
এদিকে অনলাইনে টিকিট না পাওয়া যাওয়ার প্রসঙ্গে প্রযুক্তিতে কালোবাজারিদের দক্ষতার কথা উল্লেখ করছেন রেলওয়ের কর্মকর্তারা। তারা বলছেন, দেখা যায় সকাল আটটার সময় যখন রেলওয়ের টিকিট বিক্রির সার্ভার উন্মুক্ত করে দেয়া হয় তখন হাজার হাজার ব্যবহারকারী হুমড়ি খেয়ে পড়েন টিকিটের জন্য। সাধারণ যাত্রীদের বেশিরভাগের ক্ষেত্রে এই সার্ভার ব্যবহার করে টিকিট কাটার ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় দক্ষতার অভাব রয়েছে। অপরদিকে সারা দেশে সব ব্যবহারকারীর ইন্টারনেট সংযোগের গতিও বেশ কম রয়েছে। কেউ ঢুকছেন মোবাইল ইন্টারনেট দিয়ে, কেউ ঢুকছেন কম্পিউটারের ব্রডব্যান্ড দিয়ে। আর অনলাইনে টিকিট কালোবাজারিরা প্রযুক্তিতে অনেক বেশি দক্ষ হন, তারা উন্নতমানের ডিভাইস ও শক্তিশালী ইন্টারনেট সংযোগ নিয়ে মোক্ষম সময়ের অপেক্ষায় বসে থাকেন। পাশাপাশি নিয়মিত এই সার্ভার ব্যবহার করার মাধ্যমে তারা হয়ে ওঠেন টিকিট কাটায় দক্ষ। ফলে সার্ভারে ঢোকার প্রতিযোগিতায় সাধারণ যাত্রীদের থেকে এই টিকিট কালোবাজারিরা এগিয়ে থাকে অনেক বেশি। পরবর্তীতে এই কালোবাজারিরা আবার টিকিট বাতিল করিয়ে, প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই তাদের পূর্বেই ঠিক করে রাখা গ্রাহকের আইডি দিয়ে ওই বাতিল করা টিকিট কাটিয়ে দেন তাদের।
ঢাকা-কক্সবাজার রুটে কেন টিকিটের হাহাকার?
বাংলাদেশ রেলওয়ের (পূর্ব জোন) বিভাগীয় রেলওয়ে ব্যবস্থাপক সাইফুল ইসলাম জানান, রিজার্ভ টিকিট ব্যতীত ঢাকা-কক্সবাজার রুটে একটি ট্রেনের টিকিট থাকে প্রায় ছয়শর মতো। এই রুটের ট্রেনে টিকিটের চাহিদা দেশে সবচেয়ে বেশি। হাজার হাজার মানুষ এই টিকিট কিনতে প্রায় একই সময়ে ঝাঁপিয়ে পড়েন সার্ভারে। তাদের মধ্যে থাকেন টিকিট কালোবাজারিরাও। স্বভাবতই যাদের ইন্টারনেটের গতি শক্তিশালী তারাই আগে ঢুকতে পারেন এই সার্ভারে। আর সাধারণ যাত্রীদের তুলনায় কালোবাজারিরা এই সার্ভার ব্যবহার করে টিকিট কাটার ক্ষেত্রে অনেক বেশি দক্ষ হওয়ায়, টিকিট পাওয়ার ক্ষেত্র এগিয়ে থাকেন তারা। পরবর্তীতে বিভিন্ন ফেসবুক পেজ কিংবা দালাল নেটওয়ার্কের মাধ্যমে বিক্রি করা হয় এসব টিকিট।
তবে টিকিট যার ভ্রমণ তার এই নীতি কঠোরভাবে বাস্তবায়ন করা গেলে টিকিটের কালোবাজারি প্রায় শূন্যের কোটায় নেমে আসবে বলে মত দেন এই রেলওয়ে কর্মকর্তা।
কালোবাজারির সমাধান ‘টিকিট যার ভ্রমণ তার নীতি’
কালোবাজারি প্রতিরোধে গত বছরের ১ মার্চ থেকে জাতীয় পরিচয়পত্র ব্যবহার করে ‘টিকিট যার, ভ্রমণ তার’ নীতিতে টিকিট বিক্রি শুরু করে বাংলাদেশ রেলওয়ে। সে সময় রেলওয়ের পক্ষ থেকে বলা হয়, জাতীয় পরিচয়পত্র দিয়ে টিকিট কেটে ট্রেনে ভ্রমণ করতে হবে। অন্য কারও তথ্য ব্যবহার করে ভ্রমণ করলে জরিমানা করা হবে। যাত্রীর টিকিটের সঙ্গে মেলানো হবে জাতীয় পরিচয়পত্রের তথ্য। না মিললে বিনা টিকিটে যাতায়াত করছেন বলে তাকে অভিযুক্ত করা হবে। এরপর মুখোমুখি হতে হবে জরিমানার।
প্রথম দিকে বেশ জোরেশোরে ট্রেনগুলোতে এই নীতি বাস্তবায়নে মাঠে নামে রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ। ভ্রাম্যমাণ অভিযান পরিচালনার জন্য গঠন করা হয় একাধিক টাস্কফোর্স। এই টাস্কফোর্স টিম জাতীয় পরিচয়পত্র যাচাইয়ের মাধ্যমে বিভিন্ন আন্তঃনগর ট্রেনে এবং স্টেশনে কাজ শুরু করে। তবে ধীরে ধীরে ভাটা পড়ে এই অভিযানে। যার সুযোগ নিচ্ছেন কালোবাজারিরা। মাঝে মাঝে অভিযানের কথা শোনা গেলেও কঠোরভাবে ট্রেনগুলোতে ‘টিকিট যার, ভ্রমণ তার নীতি’ বাস্তবায়ন হচ্ছে না বলে স্বীকার করেন খোদ রেলের কর্মকর্তারাই।
বিশেষ করে মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তারা বলছেন, যাত্রীদের অসচেতনতার কারণে কঠোরভাবে এই নীতি বাস্তবায়ন করা সম্ভব হচ্ছে না। কারণ বাস্তবে দেখা যাচ্ছে একটি ট্রেনে যদি এই নীতি জিরো টলারেন্সে বাস্তবায়ন করা হয়, তাহলে ট্রেনের অর্ধেক যাত্রীকেই ট্রেন থেকে নামিয়ে দিতে হবে, যা মাঠ পর্যায়ে তাদের জন্য বাস্তবায়ন প্রায় অসম্ভব।
এ ব্যাপারে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক রেলওয়ের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, যত কঠিনই হোক না কেন, রেলের কালোবাজারি বন্ধ করতে কঠোরভাবে ‘টিকিট যার, ভ্রমণ তার’ নীতি বাস্তবায়ন করতে হবে। কারণ কালোবাজারিদের বিরুদ্ধে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী অভিযান চালিয়ে সাময়িকভাবে তাদের দমন করতে পারলেও, দেখা যাবে নিত্য নতুন কৌশল বের করে তারা তাদের অপকর্ম চালিয়ে যাবে। অথচ টিকিট যার ভ্রমণ তার নীতি বাস্তবায়ন হলে কালোবাজারিদের টিকিট নিয়ে অপকর্মের সুযোগ প্রায় থাকবে না বললেই চলে। তবে একই সঙ্গে সব ট্রেনে এই নীতি বাস্তবায়নের বদলে ধীরে ধীরে তা বাস্তবায়নের পক্ষে মত দেন তিনি।
তিনি বলেন, যেসব রুটে যাত্রীদের চাহিদা বেশি মূলত সেসব রুটের ট্রেনেই কালোবাজারিদের দৌরাত্ম্য বেশি। এ প্রসঙ্গে ঢাকা-কক্সবাজার রুটের ট্রেনের কথা উল্লেখ করেন তিনি। আর এই ট্রেনগুলোতেই প্রথম কঠোরভাবে প্রয়োগ করতে হবে ‘টিকিট যার, ভ্রমণ তার’ নীতি। সেখানে সাফল্য আসলে ধীরে ধীরে অন্যান্য ট্রেনেও বাস্তবায়ন করতে হবে এই নীতি। এভাবেই থামানো যাবে কালোবাজারিদের দৌরাত্ম্য, বলেন রেলের এই কর্মকর্তা।