এপ্রিল ১৯, ২০২৪ ৭:১৯ পূর্বাহ্ণ
ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী লর্ড ক্যামেরনকে বলেছেন, ইরানের হামলার জবাব কিভাবে দেওয়া হবে ইসরাইল নিজেই তার সেই সিদ্ধান্ত নেবে। ইসরাইলের সরকার আত্মরক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় সবকিছুই করবে।
নেতানিয়াহুর সঙ্গে বৈঠকের পর জেরুজালেমে সাংবাদিকদের ক্যামেরন বলেন, ইরানের দুঃখজনক হামলার পর তিনি ‘সংহতি প্রকাশের জন্য’ ইসরাইলে এসেছেন।
লর্ড ক্যামেরন বলেন, ইসরাইলের জবাব হতে হবে ‘স্মার্ট’ এবং সীমিত। আমরা আশা করি ইসরাইল যেটাই করুক তা হবে সীমিত এবং সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য অনুযায়ী এবং যতটা সম্ভব স্মার্ট। কেউই উত্তেজনা দেখতে চায় না এবং এটাই ইসরাইলে সবার সঙ্গে আলোচনায় আমরা পরিষ্কারভাবে বলেছি।
তিনি ওই অঞ্চলে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ার আশংকা কমিয়ে আনতে সাহায্য করার উদ্দেশ্য নিয়ে ইসরাইল সফরকালে নেতানিয়াহুকে এ পরামর্শ দেন।
বৈঠকের পর ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমি এটা পরিষ্কার করতে চাই- আমরা নিজেরাই আমাদের সিদ্ধান্ত নেব এবং ইসরাইল রাষ্ট্র নিজের সুরক্ষায় যা দরকার তার সবই করবে।
নেতানিয়াহুর মন্তব্য এখন পশ্চিমাদের মধ্যে এ বিশ্বাসই আরও জোরদার করবে যে ইসরাইল ইরানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে যাচ্ছে এবং সংযমের জন্য পশ্চিমাদের ঘন ঘন পরামর্শ সম্পর্কেও তাদের একটি বার্তা দিচ্ছে ইসরাইল। ওই অঞ্চলে যুদ্ধের উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ার বিষয়ে ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্রের উদ্বেগ নিয়ে যথেষ্টই ওয়াকিবহাল ইসরাইল।
অন্যদিকে পশ্চিমা নেতারাও এটা ভেবে স্বস্তি পেতে পারেন যে ইরানের হামলার পর পাওয়া কূটনৈতিক সমর্থনকে ইসরাইলি নেতারা কাজে লাগাতে চান, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় যে ঘটনার নিন্দা জানিয়েছে এবং ইরানের ওপর নতুন নিষেধাজ্ঞার অঙ্গীকার করেছে।
আর একটি প্রতিশোধমূলক জবাব দিয়ে ওই অঞ্চলে একটি পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধ শুরুর মাধ্যমে সেই সমর্থন হয়ত নেতানিয়াহু হারাতে চাইবেন না- তেমন সম্ভাবনাও রয়েছে।
লর্ড ক্যামেরন পশ্চিমা কয়েকজন পররাষ্ট্রমন্ত্রীর একজন যারা একটি পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধ শুরুর আশংকা ঠেকানোর কূটনৈতিক প্রচেষ্টার অংশ হিসেবে ইসরাইল সফর করবেন বলে আশা করা হচ্ছে।
জার্মানির পররাষ্ট্রমন্ত্রী আন্নালেনা বেয়ারবকও আলোচনার জন্য বুধবার জেরুজালেমে এসেছেন।
নেতানিয়াহুর সঙ্গে বৈঠকের আগে লর্ড ক্যামেরন ইসরাইলের প্রেসিডেন্ট আইজ্যাক হেরজোগ এবং দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইসরাইল কাৎজের সঙ্গে আলোচনায় মিলিত হন।
এর আগে ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী দখলিকৃত ফিলিস্তিনি অঞ্চলে গিয়ে ফিলিস্তিনের প্রধানমন্ত্রী মোহাম্মদ মুস্তাফার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন।
এদিকে জি-সেভেন মন্ত্রীরা ইতালিতে সমবেত হচ্ছেন যেখানে লর্ড ক্যামেরন ইরানের বিরুদ্ধে একটি সমন্বিত নিষেধাজ্ঞা আরোপের জন্য চেষ্টা চালাবেন বলে ধারণা করা হচ্ছে।
এর আগে তিনি মধ্যপ্রাচ্যে ‘অতিমাত্রায় ক্ষতিকর কার্যকলাপের পেছনে’থাকার জন্য ইরানকে দায়ী করেছিলেন এবং ওই অঞ্চলে ইরানে প্রভাবে রাশ টেনে ধরার জন্য অন্য দেশগুলোর প্রতি দরকারি পদক্ষেপ নেওয়ার আহবান জানান।
যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন আরও নিষেধাজ্ঞা দেওয়ার বিষয়টি বিবেচনা করছে।
আর ইসরাইল চাইছে তার মিত্র রাষ্ট্রসমূহ ইরানের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সামরিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক শক্তি ইসলামিক রেভলিউশনারি গার্ডকে সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে ঘোষণা করুক।
গত শনিবার ইরান ইসরাইলের ভূখণ্ড লক্ষ্য করে তিনশোর বেশি ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপের পর থেকে ইসরাইলের সরকার ইরানের বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নেওয়ার কথা বলে আসছে।
তবে ইসরাইল জানিয়েছে যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স এবং জর্ডানের সহায়তায় ইসরাইলের আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা এসব ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্রের প্রায় সব ভূপাতিত করেছে।
ইরান গত পহেলা এপ্রিল সিরিয়ায় তাদের কয়েকজন সামরিক কর্মকর্তার ওপর হামলার জবাবে ইসরাইলে এ হামলা চালিয়েছে। ইসরাইল ওই হামলার বিষয়টি প্রকাশ্যে স্বীকার করেনি তবে হামলাটি তারাই চালিয়েছে বলে ব্যাপকভাবে ধারণা করা হয়।
এর আগে মঙ্গলবার সন্ধ্যায় যুক্তরাজ্যর প্রধানমন্ত্রী ঋষি সুনাক নেতানিয়াহুর সাথে কথা বলেন এবং সতর্ক করেন যে অতিমাত্রায় উত্তেজনা ওই অঞ্চলের অস্থিতিশীলতাকেই কেবল গভীর করবে। তিনি বলেন, এখন শান্তির দিকে যাওয়ার সময় এসেছে।
লর্ড ক্যামেরন তার সফরে সুনাকের আহ্বানই পুনর্ব্যক্ত করেন এবং গাজায় আরও মানবিক সহায়তার সুযোগ দিতে ইসরাইলের নেতাদের ওপর চাপ প্রয়োগ করবেন। তবে তিনি সুনির্দিষ্ট কূটনৈতিক পথে ধরেই এগুবেন বলে আশা করা হচ্ছে। তবে ক্যামেরন নিজের মাটিতে নজিরবিহীন হামলার শিকার হওয়া মিত্র দেশ ইসরাইলকে বিশেষ কোনো চাপ দেবেন না বলেই মনে করা হচ্ছে।
সেজন্যই তিনি হামাসের হাতে থাকা জিম্মিদের বিষয়ে এবং ইরানের ওপর আরও নিষেধাজ্ঞার গুরুত্ব নিয়ে কথা বলবেন।
এখন জেরুজালেমে তার উপস্থিতি ইসরাইলের প্রতি দেশটির সমর্থন ও সংহতির প্রকাশ। তবে একই সঙ্গে এটা আঞ্চলিক উত্তেজনার বিষয়ে ইসরাইলি নেতাদের সতর্ক করারও একটি বার্তা এটি- যে কোন ধরনের উত্তেজনাকর পরিস্থিতি বিশ্ব ও তাদের নিজেদের স্বার্থের বিরুদ্ধেই যেতে পারে।
‘তেল আবিব হবে যুদ্ধক্ষেত্র’
এদিকে বিবিসি পার্সিয়ান সার্ভিসের জিয়ার গলের এক রিপোর্ট অনুযায়ী ইসরাইলে হামলার পর উত্তেজনা বিরাজ করছে তেহরানেও।
উদ্বেগের কারণ হলো দেশটির সংকটাপন্ন অর্থনীতির মধ্যেই একটি যুদ্ধ ও তার প্রতিক্রিয়া কেমন হবে তা নিয়ে। দেশটির অনেকেই ইসরাইলে ইসলামিক রেভলিউশন গার্ডের ওই হামলার বিরোধিতা করেছেন।
বিবিসি পার্সিয়ানে ইরানের ভেতরে ও বাইরে থেকে কাজ করেন এমন অধিকারকর্মীরা একটি চিঠি পাঠিয়েছেন, যেখানে ইসলামিক রেভলিউশন গার্ডের সমালোচনা করে আর কোনো যুদ্ধের সম্ভাবনাকে নাকচ করার আহ্বান জানানো হয়েছে।
বহু ইরানি মনে করেন প্রক্সি যুদ্ধ থেকে বেরিয়ে ইরান-ইসরাইল সরাসরি সংঘাতের এই পরিস্থিতি দেশটির সাধারণ মানুষের দৃষ্টিভঙ্গিকে প্রতিফলিত করছে না। এর মধ্যে তেহরানের রাস্তায় পুলিশি উপস্থিতি বাড়ানো হয়েছে এবং অনেকে মনে করেন এটি করা হয়েছে মূলত কোনো সম্ভাব্য প্রতিবাদ মোকাবেলার জন্য। দেশটির নীতি নির্ধারকদের অনেকের মধ্যে এই ভয় আছে যে ইসরাইলের সঙ্গে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়লে ২০২২ সালের মতো আরেকটি গণবিক্ষোভের সূচনা হতে পারে।
ওই রিপোর্টে বলা হয়েছে, ইরানের বিভিন্ন শহরের দেয়ালে নানা ধরনের গ্রাফিতি দেখা যাচ্ছে; যার মধ্যে রয়েছে- ইসরাইল সর্বোচ্চ নেতার (আয়াতুল্লাহ আলি খামেনি) বাড়িতে আঘাত করো।
আরেকটি গ্রাফিতি ছিল এমন- ইসরাইল তাদের আঘাত করো, পাল্টা জবাব দেওয়ার সাহস তাদের নেই। তবে সরকারেরও আবার নিজস্ব বার্তা সংবলিত বিলবোর্ড আছে বিভিন্ন জায়গায়, যার একটিতে লেখা হয়েছে- ‘তেল আবিব আমাদের যুদ্ধক্ষেত্র, তেহরান নয়।’