দলীয় সিদ্ধান্ত অমান্য করে উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে যাওয়া বিএনপি নেতাদের তালিকা আরও দীর্ঘ হচ্ছে। প্রথম ধাপের ভোটে অংশ নেওয়া ইতোমধ্যে ৮০ নেতাকে বহিষ্কার করেছে দলটি। দ্বিতীয় ধাপের ভোটেও অনেক নেতা চেয়ারম্যান ও ভাইস চেয়ারম্যান (পুরুষ ও মহিলা) পদে মনোনয়পত্র জমা দিয়েছেন। এসব নেতার তালিকা করা হচ্ছে।
দ্বিতীয় ধাপে ১৫৯ উপজেলা পরিষদে নির্বাচন হবে ২১ মে। মঙ্গলবার ছিল মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারের শেষ দিন। এ ধাপেও ভোটে অংশ নেওয়া বিএনপি নেতাদের প্রথমে শোকজ করা হবে। এরপর সাংগঠনিক ব্যবস্থা, অর্থাৎ বহিষ্কার করবে। তবে দ্বিতীয় ধাপেও এতসংখ্যক নেতার ভোটে অংশগ্রহণের কারণ খুঁজছেন দলটির নীতিনির্ধারকরা। এক্ষেত্রে দায়িত্বশীল নেতাদের কোনো ব্যর্থতা আছে কিনা-তাও খতিয়ে দেখা হচ্ছে। একাধিক নেতা জানান, নির্বাচন বর্জনে কঠোর নির্দেশ সত্ত্বেও যারা দ্বিতীয় ধাপের নির্বাচন মনোনয়নপত্র দাখিল করেছেন, তাদের ব্যাপারে দলের শীর্ষ নেতৃত্ব খুবই বিরক্ত। কারণ, প্রথম ধাপের নির্বাচনে যারা মনোনয়নপত্র দাখিল করেছেন, ততক্ষণ পর্যন্ত নির্বাচনের ব্যাপারে সিদ্ধান্তহীনতায় ছিল দলটি। এ কারণে প্রথম ধাপের প্রার্থীদের ব্যাপারে দল কিছুটা সময় নিয়েছে, সাংগঠনিক প্রক্রিয়ায় তাদের বুঝিয়ে নির্বাচন থেকে ফেরানোর চেষ্টা করেছে। শেষ পর্যন্ত একযোগে ৭৩ জনসহ দলীয় নির্দেশ অমান্য করে প্রার্থী হওয়া ৮০ জনকে বহিষ্কার করা হয়। সর্বশেষ মঙ্গলবারও চারজনকে বহিষ্কার করা হয়, যারা আপিলে প্রার্থিতা ফিরে পান।
জানতে চাইলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য বেগম সেলিমা রহমান বলেন, ‘দেশে ভোটের কোনো অধিকার নেই। জনগণ ভোট দিতে পারে না, একদলীয় ভোট হয়। সেখানে অংশগ্রহণ করব না, তাই ভোট বর্জনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। সবার সঙ্গে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে আমাদের সিদ্ধান্ত ভোট বর্জনের। কাজেই সিদ্ধান্তের ভালো দিকও আছে, খারাপ দিকও আছে। এখন কোন দিকটা কি হবে, না হবে সেটা আমরা বিবেচনা করছি, দেখছি। কিন্তু বর্জনের সিদ্ধান্ত ঠিকই আছে।’
জানা গেছে, প্রথম ধাপের চেয়ে দ্বিতীয় ধাপের নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদে বিএনপির প্রার্থীর সংখ্যা বেশি। প্রথম ধাপে চেয়ারম্যান পদে প্রার্থী হন ২৮ জন। দলটির দপ্তর সূত্র জানিয়েছে, দ্বিতীয় ধাপে ৩৫ জনের বেশি নেতা চেয়ারম্যান পদে মনোনয়নপত্র দাখিল করেছেন। একইভাবে ভাইস চেয়ারম্যান ও মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান পদে প্রার্থীর সংখ্যাও অনেক। তবে এখনো তালিকা চূড়ান্ত করতে পারেনি কেন্দ্রীয় দপ্তর। দু-এক দিনের মধ্যে তালিকা চূড়ান্ত করে শোকজ করা হবে বলে জানা গেছে।
৭ জানুয়ারির জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর উপজেলা নির্বাচনও বর্জন করছে বিএনপি। তবে দলের অবস্থানের বাইরে গিয়ে যারা ভোটের মাঠে নেমেছেন, তাদের ঠেকাতে দায়িত্বশীল নেতাদের চেষ্টাও ব্যর্থ হয়েছে। প্রথম দফায় নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ায় ৮০ জনকে দল থেকে বহিষ্কার করেছে বিএনপি। চার দফায় উপজেলা নির্বাচনে এ বহিষ্কারের তালিকা আরও দীর্ঘ হবে।
এদিকে তৃণমূলের বাস্তবতা আসলে কতটা বিবেচনায় নিয়েছে বিএনপির নেতৃত্ব, সেই আলোচনাও রয়েছে দলটিতে। কারণ, দীর্ঘ আন্দোলনে মামলায় জর্জরিত দলের নেতাকর্মীদের এখন আদালতে যাতায়াত দৈনন্দিন নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে। আর মামলা লড়তে অর্থের জোগানের বিষয় তো আছেই। একদিকে মামলার বোঝা, অন্যদিকে আন্দোলনে ব্যর্থতার হতাশা তৃণমূল নেতাকর্মীদের বড় অংশকে নিষ্ক্রিয় করে ফেলেছে। কিন্তু জনসমর্থন আছে, মাঠের এমন নেতাদের নিজ নিজ এলাকায় ঘুরে দাঁড়ানোর বা একটা অবস্থান তৈরির একটা সুযোগ এসেছিল উপজেলা নির্বাচনে।
বিএনপি ২০২১ সাল থেকে স্থানীয় সরকারের কোনো নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে না। স্থানীয় সরকারের কোনো কাঠামোতেই দলগত অবস্থান নেই ১৭ বছর ধরে ক্ষমতার বাইরে থাকা দলটির। তৃণমূলে দলটির সাংগঠনিক দুর্বলতার ক্ষেত্রে এরও একটা প্রভাব রয়েছে। সরকারবিরোধী আন্দোলন ব্যর্থ হওয়ার পেছনে এ সাংগঠনিক দুর্বলতাকেও একটি কারণ হিসাবে দেখা হয়। পরিস্থিতিটাকে দলের নেতাদের কেউ কেউ স্বীকার করেন। তবে উপজেলা নির্বাচনে অংশ নেওয়ায় দলীয় নেতাদের বহিষ্কারের তালিকা দীর্ঘ হলে সেটি তৃণমূলের সংগঠনকে আরও দুর্বল করবে-এমন পর্যালোচনা বিএনপির ভেতরেও আছে। এরপরও কঠোর অবস্থানেই রয়েছে বিএনপির শীর্ষ নেতৃত্ব।
যদিও বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা জয়নুল আবদিন ফারুক মনে করেন, ‘বিএনপি সিদ্ধান্তটা ২০১৪ সাল থেকে এখন পর্যন্ত বহাল রেখেছে। মাঝে তো ২০১৮ সালের জাতীয় নির্বাচনে ভোটে গিয়ে একটা অগ্নিপরীক্ষা দিয়েছিলাম। সেই পরীক্ষায় আমরা উত্তীর্ণ হতে চেয়েছিলাম, কিন্তু উত্তীর্ণ হওয়ার পথে বাধা হলো আওয়ামী লীগ। তারা দিনের ভোট রাতে করেছে। যখন উত্তীর্ণ হতে দেয়নি, তখন আমাদের পূর্বের সিদ্ধান্তই বহাল রাখল দল। এখন উপজেলা, ইউনিয়ন, স্কুল ও কলেজের নির্বাচনেও দখল। যে কারণে যারা অংশগ্রহণ করছেন তারা বহিষ্কার হবেন। বাকি ধাপেও আরও বহিষ্কার হবে-সেটা বিএনপির জন্য বিষয় না। কারণ বিএনপি এসব পরীক্ষায় আগেই উত্তীর্ণ। সুতরাং দলীয় সিদ্ধান্ত যদি কেউ না মানেন, পদে থেকে যদি ভোটে অংশ নেন-সে বহিষ্কার হবে। তাতে যতই সংখ্যা বাড়ুক না কেন। এটা থেকে আমাদের কোনো হতাশ হওয়ার কিছু নেই বলে আমি মনে করি।’