বিবিসি বাংলার প্রতিবেদন: শেখ হাসিনাকে নিয়ে ভারতের তিন ‘অপশন’

বিবিসি বাংলার প্রতিবেদন: শেখ হাসিনাকে নিয়ে ভারতের তিন ‘অপশন’

জাতীয় স্লাইড

আগস্ট ৩১, ২০২৪ ৬:৩১ পূর্বাহ্ণ

সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে চরম গোপনীয়তা ও কড়া সুরক্ষার মধ্যে আপাতত ভারত সরকার থাকার ব্যবস্থা করেছে। তবে তার ব্যাপারে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত কী নেওয়া হবে সে বিষয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে সরকার এখনো কিছুই জানায়নি। এরই মধ্যে বাংলাদেশ সরকার শেখ হাসিনার ‘ডিপ্লোম্যাটিক’ পাসপোর্ট প্রত্যাহার করায় ভারতে এখন তার অবস্থানের বৈধ ভিত্তি কী, সেটা নিয়েও প্রশ্নও উঠছে।

এ পরিপ্রেক্ষিতে দিল্লিতে ভারতের শীর্ষ পর্যায়ের কর্মকর্তা ও বিশ্লেষকদের সঙ্গে কথা বলে বিবিসি বাংলা ‘শেখ হাসিনাকে নিয়ে ভারতের সামনে এখন যে রাস্তাগুলো খোলা’ শিরোনামে এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে, এই মুহূর্তে শেখ হাসিনাকে নিয়ে ভারতের সামনে কার্যত তিনটি ‘অপশন’ বা রাস্তা খোলা রয়েছে। প্রথম রাস্তাটা হলো, বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রীর জন্য তৃতীয় কোনো দেশে আশ্রয়ের ব্যবস্থা করা, যেখানে তিনি নিরাপদে ও সুরক্ষিত পরিবেশে থাকার নিশ্চয়তা পাবেন।

দ্বিতীয় অপশন হলো, শেখ হাসিনাকে রাজনৈতিক আশ্রয় (পলিটিক্যাল অ্যাসাইলাম) দিয়ে ভারতেই এখনকার মতো রেখে দেওয়া।

তৃতীয় বিকল্প পথটার হয়তো এখনই বাস্তবায়ন সম্ভব নয়, কিন্তু ভারতে কর্মকর্তা ও পর্যবেক্ষকদের একটি অংশ বিশ্বাস করেন কিছুদিন পরে উপযুক্ত পরিস্থিতি এলে বাংলাদেশে শেখ হাসিনার ‘রাজনৈতিক প্রত্যাবর্তনে’র জন্যও ভারত চেষ্টা করতে পারে। কারণ দল বা রাজনৈতিক শক্তি হিসাবে আওয়ামী লীগ এখনো ফুরিয়ে যায়নি এবং দলের সর্বোচ্চ নেত্রী হিসাবে তিনি দেশে ফিরে সংগঠনের হাল ধরতেই পারেন!

এ তিনটি বিকল্পের মধ্যে ভারতের কাছে অপশন হিসাবে প্রথমটাই যে ‘সেরা’ তা নিয়েও কূটনৈতিক বা থিংকট্যাংক মহলে কোনো সন্দেহ নেই। কারণ, তিনি ভারতেই রয়ে গেলে সেটা আগামী দিনে দিল্লি-ঢাকা সম্পর্কের ক্ষেত্রে বিরূপ প্রভাব ফেলতে পারে বলে তারা মনে করছেন। এর পাশাপাশি ভারত-বাংলাদেশ প্রত্যর্পণ চুক্তির আওতায় শেখ হাসিনাকে হস্তান্তরের জন্য ঢাকার কাছ থেকে অনুরোধ এলে, সেটা যে কোনো না কোনো যুক্তিতে দিল্লি খারিজ করে দেবে তাও একরকম নিশ্চিত।

তাই শেখ হাসিনাকে বিচারের জন্য বাংলাদেশের হাতে তুলে দেওয়াকে ভারতের জন্য কোনো বাস্তবসম্মত ‘অপশন’ বলে পর্যবেক্ষকরা মনে করছেন না। সুতরাং অন্যভাবে বললে শেখ হাসিনাকে নিয়ে স্বল্প বা দীর্ঘমেয়াদে ভারতের সামনে উল্লিখিত তিনটি রাস্তাই খোলা থাকছে।

তৃতীয় কোনো বন্ধু দেশে পাঠানো : পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তা বলেছেন, ‘উই আর হোপিং ফর দ্য বেস্ট, প্রিপেয়ারিং ফর দ্য ওয়র্স্ট!’ অর্থাৎ ভারত এখনো আশা করছে শেখ হাসিনার ক্ষেত্রে সবচেয়ে ভালোটাই ঘটবে (তৃতীয় কোনো বন্ধু দেশে তিনি থাকতে পারবেন), কিন্তু সেটা যদি সম্ভব না হয়, তাহলে সবচেয়ে খারাপটার জন্যও (শেখ হাসিনাকে দীর্ঘ সময়ের জন্য ভারতেই রেখে দিতে হবে) দিল্লি প্রস্তুত থাকবে।

বিবিসি জানতে পেরেছে, শেখ হাসিনার যুক্তরাজ্যে যাওয়ার প্রস্তাব প্রথমেই বাধাপ্রাপ্ত হওয়ার পর ইউএই (সংযুক্ত আরব আমিরাত), সৌদি আরব ও ইউরোপের দু-একটি ছোট দেশের সঙ্গে ভারত এ বিষয়ে কথা বলেছিল। তবে এসব আলোচনায় তেমন অগ্রগতি হয়নি। তবে শেখ হাসিনা নিজে এখনো কোনো দেশে ‘লিখিত আবেদন’ করেননি। তার হয়ে এবং তার মৌখিক সম্মতির ভিত্তিতে যাবতীয় কথাবার্তা ভারত সরকারই চালাচ্ছে। এখন প্রশ্ন হলো, যদি তৃতীয় কোনো দেশ শেখ হাসিনাকে আশ্রয় দিতে রাজিও হয়, তাহলে কোন পাসপোর্টে তিনি দিল্লি থেকে সেখানে যাবেন?

ঢাকায় ভারতের সাবেক হাইকমিশনার রিভা গাঙ্গুলি দাস বলেলেন, ‘এটা কিন্তু বড় কোনো সমস্যা নয়। বাংলাদেশ যদি তার পাসপোর্ট বাতিলও করে দিয়ে থাকে, ভারত সরকারের ইস্যু করা ট্র্যাভেল ডকুমেন্ট বা পারমিট দিয়েই তিনি অনায়াসে তৃতীয় দেশে যেতে পারবেন।’

রাজনৈতিক আশ্রয় প্রদান : একান্ত প্রয়োজন হলে শেখ হাসিনাকে ভারতেই রাজনৈতিক আশ্রয় দিতে যে সরকার দ্বিধা করবে না, সেই ইঙ্গিতও দিল্লিতে এখন পাওয়া যাচ্ছে। তবে এই পদক্ষেপ যদি একান্তই নিতে হয়, তবে ভারত-বাংলাদেশ দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে এর প্রভাব কী পড়বে, সেটাও দিল্লিকে খেয়াল রাখতে হবে। অনেক বিশ্লেষক মনে করেন, শেখ হাসিনাকে ভারত যদি আশ্রয় দেয়, তাহলে বাংলাদেশের নতুন সরকারের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তোলার ক্ষেত্রে সেটা অন্তরায় হয়ে উঠতে পারে।

দিল্লিতে আইডিএসএ-র সিনিয়র ফেলো শ্রুতি পট্টনায়ক বলেছেন, ‘এখন যদি ভারত শেখ হাসিনাকে আশ্রয় দেয় তাহলে বাংলাদেশে তা একটা ভুল বার্তা দেবে এবং সে দেশে ভারতবিরোধী সেন্টিমেন্টকে অবশ্যই আরও উসকে দেবে।’ এই সমস্যার কথা ভারত সরকারও খুব ভালোভাবেই জানে। তার পরও প্রথম ‘অপশন’টা কাজ না করলে এই দ্বিতীয় ‘অপশন’টার দিকে তাদের বাধ্য হয়েই ঝুঁকতে হবে। কারণ দীর্ঘদিনের বন্ধু শেখ হাসিনার বিপদে পাশে না দাঁড়ানো ভারতের পক্ষে কোনোমতেই সম্ভব নয়!

‘রাজনৈতিক কামব্যাকে’ সাহায্য করা : ভারতে সরকারের শীর্ষ নীতি-নির্ধারকদের পর্যায়ে একটা প্রভাবশালী মহল এখনো বিশ্বাস করে, বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে শেখ হাসিনা ‘চিরতরে ফুরিয়ে যাননি’ এবং উপযুক্ত সময় ও পরিবেশ এলে ভারতের উচিত হবে তার ‘রাজনৈতিক পুনর্বাসনে’ সাহায্য করা।

ভারতের একজন কর্মকর্তা বিবিসিকে বলেছেন, ‘মনে রাখতে হবে, বাংলাদেশের রাজনীতিতে শেখ হাসিনা অন্তত তিন-তিনবার দুর্র্ধর্ষ ‘কামব্যাক’ করেছেন- ‘৮১তে, ‘৯৬তে আর ২০০৮-এ! এই তিনবারই অনেকে ভেবেছিলেন, তার পক্ষে হয়তো ঘুরে দাঁড়ানো সম্ভব নয়। কিন্তু প্রতিবারই তিনি তাদের ভুল প্রমাণ করেছেন!’

এখানে আসল কথা হলো, শেখ হাসিনা একদিন বাংলাদেশে ফিরে আবার আওয়ামী লীগের হাল ধরতে পারেন, দিল্লিতে একটি অংশ খুব ‘সিরিয়াসলি’ এ কথাটা বিশ্বাস করে। এর জন্য ভারতকে প্রয়োজন হলে অন্তর্বর্তী সরকারের ওপর এবং প্রয়োজনে সেনাবাহিনীর উপরেও চাপ দিতে হবে বলে তারা যুক্তি দিচ্ছেন। তারা আরও বলছেন, আওয়ামী লীগ বাংলাদেশে কোনো নিষিদ্ধ সংগঠন নয়। সারা দেশে তাদের শক্তিশালী নেটওয়ার্ক আছে, সেই দলের সর্বোচ্চ নেত্রী হিসাবে শেখ হাসিনা আগামী দিনে বাংলাদেশে ফিরতেই পারেন।

তার বিরুদ্ধে দায়ের হওয়া মামলাগুলোতেও তিনি বিচারের সম্মুখীন হতে পারেন, হয়তো পরবর্তী নির্বাচনে তার লড়ার ক্ষেত্রেও বাধা থাকতে পারে। কিন্তু তার দেশে ফেরার রাস্তা এবং রাজনীতিতে নতুন করে প্রবেশ বন্ধ করাটা কঠিন বলেই অনেকে মনে করছেন। কিন্তু বিগত প্রায় পঞ্চাশ বছর ধরে শেখ হাসিনার ওপর ভারত যে পরিমাণ ‘রাজনৈতিক বিনিয়োগ’ করেছে, তাতে দিল্লির একটি প্রভাবশালী অংশ তাকে এখনই খরচের খাতায় ফেলতে কিছুতেই রাজি নন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *