বৈশ্বিক বাণিজ্য নীতিতে সরকারের নতুন মোড়

বৈশ্বিক বাণিজ্য নীতিতে সরকারের নতুন মোড়

অর্থনীতি স্লাইড

অক্টোবর ১৯, ২০২৪ ৫:১৬ পূর্বাহ্ণ

বিশ্বের বৃহত্তম বাণিজ্য জোট চীনের নেতৃত্বাধীন ‘রিজিওনাল কম্প্রেহেনসিভ পার্টনারশিপ অ্যাগ্রিমেন্ট (আরসেপ)’-এ যোগ দিতে আনুষ্ঠানিক প্রস্তাব দিয়েছে ঢাকা। সম্প্রতি সংস্থাটির সদর দপ্তরে আবেদনপত্র পাঠিয়েছে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে। আরসেপ-এর সদস্য হলে আগামী দিনে এর অন্তর্ভুক্ত দেশগুলোর সঙ্গে মুক্তবাণিজ্য চুক্তির (এফটিএ) প্রয়োজন হবে না।

তবে এ সময়ে আরসেপ-এর গুরুত্ব বাড়লেও দীর্ঘদিনের আলোচিত ভারতের সঙ্গে কম্প্রেহেনসিভ ইকোনমিক পার্টনারশিপ অ্যাগ্রিমেন্টে (সেপা) স্বাক্ষরের পথ থেকে সরে আসছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার।

সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, ‘সেপা’ থেকে সরে চীনের নেতৃত্বাধীন জোট ‘আরসেপে’ যুক্ত হওয়ার মধ্য দিয়ে বৈশ্বিক বাণিজ্য নীতিতে নতুন মোড় নিয়েছে বর্তমান সরকার।

জানতে চাইলে বাণিজ্য সচিব মোহাং সেলিম উদ্দিন জানান, ভারতের সঙ্গে সেপা স্বাক্ষরের বিষয়ে আপাতত কোনো উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে না। তবে আরসেপের সদস্য হিসাবে যোগদানের জন্য প্রধান উপদেষ্টা ইতোমধ্যে সম্মতি দিয়েছেন। আর আরসেপে যুক্ত হলে পরবর্তী সময়ে বাণিজ্যের ক্ষেত্রে বাড়তি সুবিধা পাওয়া না গেলে সদস্য দেশগুলোর সঙ্গে মুক্তবাণিজ্য চুক্তি (এফটিএ) করার দরকার হবে না। যদি আরসেপের চেয়ে বাণিজ্যের ক্ষেত্রে বেশি সুবিধা পাওয়া যায় তবেই এফটিএ হবে সংশ্লিষ্ট সদস্য দেশগুলোর সঙ্গে। তিনি আরও বলেন, এখন আমরা একটি অ্যাকশন প্ল্যান তৈরি করব। মন্ত্রণালয় এ নিয়ে কাজ করছে।

সূত্রমতে, আরসেপে যোগদানের জন্য সম্প্রতি সম্মতি দিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। তার অনুমোদনের জন্য একটি সারসংক্ষেপ পাঠানো হয় বাণিজ্য মন্ত্রণালয় থেকে। সেখানে বলা হয়, ‘আওতা ও পরিধি বিবেচনায় আরসেপ একটি উচ্চমানের আধুনিক ও কমপ্রেহেনসিভ প্রকৃতির মুক্তবাণিজ্য চুক্তি, যেখানে পণ্যের বাণিজ্য, সেবার বাণিজ্য, বিনিয়োগ, অর্থনীতি, প্রযুক্তিগত সহায়তা, মেধা স্বত্বাধিকার, অভিযোগ নিষ্পত্তি, ই-বাণিজ্য ও এসএমইসহ অন্যান্য বিষয়ও এ চুক্তির আওতাভুক্ত। বিশ্বের মোট জিডিপি ও জনসংখ্যার ৩০ শতাংশ, প্রত্যক্ষ বৈদেশিক বিনিয়োগের ৩১ শতাংশ এবং মোট পণ্য-সেবা বাণিজ্যের এক-চতুর্থাংশ এ জোটের আওতাভুক্ত।’ জোটটি মূলত শুল্ক বাধা দূর করে এ অঞ্চলে সরবরাহ চেইন তৈরি করছে।

আরসেপে যোগদানের পক্ষে যুক্তি তুলে ধরে প্রধান উপদেষ্টার কাছে পাঠানো সারসংক্ষেপে আরও উল্লেখ করা হয়, বর্তমান প্রেক্ষিত বিবেচনায় বাংলাদেশ আরসেপে যোগদান করলে ৩৬০ কোটি মার্কিন ডলার রপ্তানি এবং ৩৩৬ কোটি ডলার বৈদেশিক বিনিয়োগ বাড়বে। রপ্তানি বৃদ্ধির উল্লেখযোগ্য অংশ আসবে পোশাক খাত থেকে। ফলে এ খাতে শ্রমিকের চাহিদা বাড়বে ১৮ শতাংশ। সামগ্রিকভাবে এ বাণিজ্য জোটে যোগদান করলে বাংলাদেশের জিডিপি বাড়বে শূন্য দশমিক ২৬ শতাংশ।

তবে সক্ষমতা বাড়াতে না পারলে রপ্তানি খাত অপ্রতিদ্বন্দ্বিতার মুখে পড়বে। পাশাপাশি সেবা, ই-কমার্স, বিনিয়োগসহ অন্যান্য ক্ষেত্রে বেশ কিছু চ্যালেঞ্জ সৃষ্টি এবং কর রাজস্ব আদায়ে বিরূপ প্রভাব পড়বে। এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের সহযোগিতায় প্রয়োজনীয় কার্যক্রম গ্রহণের পরিকল্পনা নিয়েছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়।

আরসেপে যুক্ত হওয়ার সুবিধার কথা তুলে ধরে প্রধান উপদেষ্টাকে জানানো হয়, এ জোটে অন্তর্ভুক্ত হলে দক্ষিণ বাংলাদেশ এশিয়ান রিজিওনাল ফোরাম (এআরএফ) সদস্য দেশগুলো থেকে সুবিধা পাবে। বিশেষ করে বাজার সুবিধা পাওয়ার ক্ষেত্রে এ অঞ্চলের দেশগুলোর সঙ্গে আলাদাভাবে নেগোশিয়েশনের প্রয়োজন হবে না। এতে এলডিসি গ্র্যাজুয়েশনের পরও শুল্ক সুবিধা ধরে রাখার মাধ্যমে গ্লোবাল চেইনে যোগ দিয়ে আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে বাণিজ্যিক ও কৌশলগত লাভবান হবে।

ফলে বাণিজ্য সম্প্রসারণ ও কৌশলগত অবস্থান পর্যালোচনায় বাংলাদেশ ‘রিজিওনাল কম্প্রেহেনসিভ পার্টনারশিপ অ্যাগ্রিমেন্ট (আরসেপ)’-এ যোগ দেওয়ার জন্য যথাযথ প্রক্রিয়া শুরুর লক্ষ্যে আনুষ্ঠিক প্রস্তাব পাঠাতে পারে। তবে নেগোশিয়েশন চলাকালে দেশের স্বার্থ সংরক্ষণে সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন করে প্রযোজ্য ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় সংখ্যক নিবিড় গবেষণা কার্যক্রম সম্পাদন করা হবে।

সেপা কতদূর এগিয়েছে : শেখ হাসিনার সরকার প্রথমবার ভুটানের সঙ্গে অগ্রাধিকারমূলক বাণিজ্য চুক্তি বা প্রেফারেন্সিয়াল ট্রেড অ্যাগ্রিমেন্ট (পিটিএ) স্বাক্ষর করে। এর পরপরই ভারতের সঙ্গে মুক্তবাণিজ্য চুক্তির চেয়েও বড় আকারে বিস্তৃত অর্থনৈতিক অংশীদারত্ব চুক্তি কম্প্রেহেনসিভ ইকোনমিক পার্টনারশিপ অ্যাগ্রিমেন্ট (সিইপিএ বা সেপা) স্বাক্ষরের উদ্যোগ নিয়েছিল। যার মধ্যে দ্বিপাক্ষিক শুল্কমুক্ত সুবিধা ছাড়াও আঞ্চলিক সংযোগ, বিনিয়োগসহ সার্ভিস সেক্টরও অন্তর্ভুক্ত ছিল। এজন্য একটি যৌথ সম্ভাব্যতা পরীক্ষা করা হয়। সেখানে বলা হয়, সেপা স্বাক্ষরিত হলে সাত থেকে ১০ বছরে বাংলাদেশের রপ্তানি আয় ৩০০-৫০০ কোটি মার্কিন ডলার বাড়বে। যদিও একই সময়ে ভারতের আয় বাড়বে ৪০০ থেকে এক হাজার কোটি ডলার।

ভারতের সঙ্গে সেপা স্বাক্ষরের উদ্যোগ নেওয়ার পরপরই চীনের পক্ষ থেকে বাংলাদেশের সঙ্গে এফটিএ স্বাক্ষরের প্রস্তাব দেওয়া হয়। দুই দেশের কর্মকর্তাদের বৈঠকে বাংলাদেশ চীনের সঙ্গে এফটিএ স্বাক্ষরের আগ্রহের কথা জানালেও বাস্তবে কোনো উদ্যোগ নেয়নি বিগত সরকার। গত জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে শেখ হাসিনার ভারত সফরকালে দুই দেশের প্রধানমন্ত্রী সেপা স্বাক্ষরের জন্য আলোচনা শুরুর ঘোষণা দেন। তখন আরসেপে যোগদানের জন্য আবেদন করতে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর অনুমোদন চায় বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের তৎকালীন ও বর্তমান একাধিক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, বাংলাদেশকে আরসেপে যোগদান করতে নিষেধ করে ভারত। প্রতিবেশী দেশটি জানায়, বাংলাদেশ আরসেপে যোগদান করলে ভারত সেপা চুক্তি স্বাক্ষর করবে না। এ পরিপ্রেক্ষিতে শেখ হাসিনা আরসেপে যোগদানের আবেদন করার ফাইলে স্বাক্ষর না দিয়ে ফাইলটি আটকে রাখেন। তারা বলেন, গত নির্বাচনের আগে ভারতকে অখুশি করতে চায়নি হাসিনা সরকার। এ কারণেই তখন আরসেপে যোগদানের বিষয়টি বিলম্বিত করা হয়।

আরসেপে যোগদানের সুফল : আরসেপে যোগদান করলে বাংলাদেশ প্রথম ১০ বছরের মধ্যে ৯০ শতাংশ বাণিজ্যের ক্ষেত্রে ট্যারিফ বা শুল্ক কমাতে হবে। বাকি ১০ শতাংশ ট্যারিফ কমানোর ক্ষেত্রে বাড়তি ১৫ বছর পাওয়া যাবে। এছাড়া বাংলাদেশ এখন যেসব দেশের সঙ্গে মুক্তবাণিজ্য চুক্তি (এফটিএ) স্বাক্ষর করার বিষয়ে আলোচনা করছে, তার মধ্যে ছয়টি দেশ জাপান, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, দক্ষিণ কোরিয়া ও চীন বর্তমানে আরসেপের সদস্য।

জানা যায়, ১৫ দেশের বাণিজ্যিক জোট আরসেপ। যাদের মোট জনসংখ্যা প্রায় ২৩০ কোটি (বিশ্বের মোট জনসংখ্যার ৩০ শতাংশ) এবং সবমিলিয়ে এটি ২৬.৩ ট্রিলিয়ন ডলারের বাজার। আরসেপে অন্তর্ভুক্ত দেশের মধ্যে রয়েছে অস্ট্রেলিয়া, ব্রুনাই, চীন, ইন্দোনেশিয়া, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, মালয়েশিয়া, মিয়ানমার, নিউজিল্যান্ড, ফিলিপাইন, সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড ও ভিয়েতনাম। একবিংশ শতাব্দীতে বিশ্ব অর্থনীতির প্রাণকেন্দ্র হবে আসিয়ানসহ পূর্ব এশিয়ার দেশগুলো, যারা আরসেপের অন্তর্ভুক্ত। সংশ্লিষ্টরা মনে করেন, বিশ্ব অর্থনীতির প্রাণকেন্দ্রের সঙ্গে বাংলাদেশের যুক্ত থাকা যৌক্তিক হবে। আরসেপকে চীনের নেতৃত্বাধীন বাণিজ্যিক ব্লক বলা হলেও যুক্তরাষ্ট্রের ঘনিষ্ঠ মিত্র জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া ও অস্ট্রেলিয়াও এই ব্লকের সদস্য। তাছাড়া ভারত যে কোনো সময় প্রতিষ্ঠাকালীন সদস্য হিসাবে আরসেপের সদস্য হতে পারবে। কারণ, ভারত শুরুতে আরসেপ গঠনের প্রক্রিয়ায় যুক্ত ছিল, তবে শেষ মুহূর্তে এসে আর চুক্তিতে স্বাক্ষর করেনি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *