অক্টোবর ১১, ২০২৩ ৯:৪৩ পূর্বাহ্ণ
ইসরাইলের বোমারু বিমান অবরুদ্ধ গাজার বিভিন্ন স্থাপনা লক্ষ্য করে বিরতিহীন বোমাবর্ষণ চালিয়ে যাচ্ছে। ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাকামী সশস্ত্রগোষ্ঠী হামাসকে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়ার প্রতিজ্ঞা করার পর মঙ্গলবার সকালে বিমানবাহিনী হামলা আরও জোরদার করেছে। গাজায় ২৩ লাখ মানুষের খাবার, পানি, বিদ্যুৎসহ নিত্যপণ্যের সরবরাহ বন্ধ থাকায় সেখানে দেখা দিয়েছে ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয়। এদিকে, পূর্ব সতর্কতা ছাড়া ফিলিস্তিনিদের ওপর ইসরাইল নতুন করে বোমা হামলা চালালে জিম্মিদের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর শুরু করা হবে বলে হুমকি দিয়েছে হামাসের সশস্ত্র শাখা আল কাশেম ব্রিগেড। আর হামাস নেতা ইসমাইল হানিয়া বলেছেন, যুদ্ধ শেষ না হওয়া পর্যন্ত জিম্মি বিনিময় নিয়ে কোনো আলোচনা হবে না। হামাসের সঙ্গে ইসরাইলের ৪ দিনের এ সহিংসতায় ইতোমধ্যে ১৮০০ জনের বেশি মানুষ হতাহত হয়েছে। এদের মধ্যে ইসরাইলের ১০০৮ জন এবং ফিলিস্তিনের ৮৩০ জন নিহত হয়েছে। খবর, বিবিসি, স্কাই নিউজ, রয়টার্স, আলজাজিরা, ডেইলি মেইলের।
গাজা উপত্যকায় ইসরাইল কোনো বিরতি ছাড়াই বোমা বর্ষণ করে যাচ্ছে। সোমবার রাতের আকাশ বোমার ঝলকানিতে হয়ে উঠেছিল রক্তলাল। বোমার আঘাতে বিভিন্ন আবাসিক ভবনগুলো একের পর এক ধসে পড়েছে। কিছুক্ষণ পরপরই অ্যাম্বুলেন্সে হাসপাতালে আনা হচ্ছিল মরদেহ। তবে এসব মরদেহের কোনোটাই হামাস যোদ্ধাদের নয়। নিহত সবাই বেসামরিক সাধারণ নাগরিক। এদের মধ্যে বেশিরভাগই ছিল শিশু। আহতদের চিকিৎসকার জন্য ডাক্তারও কিছু করতে পারছেন না। কারণ হাসপাতালের সরবরাহ ফুরিয়ে গেছে। নেই কোনো আলোর ব্যবস্থা। ইসরাইলের অব্যাহত বিমান হামলা এবং গাজা অবরুদ্ধ হওয়ায় এখন সেখানে মানবিক বিপর্যয়ের মতো পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। ৪ দিনের এ হামলায় কমপক্ষে ৮৩০ ফিলিস্তিনি নিহত এবং ৪০০০ আহত হয়েছেন বলে গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে। মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র জানিয়েছেন, নিহতের মধ্যে ১৪০টি শিশু এবং ১২০ জন নারী রয়েছেন।
গাজায় অব্যাহত বিমান হামলার জবাবে ইসরাইলের আশকেলনে হামলার হুমকি দিয়েছে হামাস। মঙ্গলবার এক টেলিগ্রাম পোস্টে হামাস গাজা উপত্যকার ঠিক উত্তরের বন্দরনগরী আশকেলন থেকে স্থানীয় সময় বিকাল ৫টার মধ্যে অধিবাসীদের সরে যাওয়ার নির্দেশ দিয়েছে। হামাসের এ ঘোষণার পরপরই ইসরাইল সেখানে সেনা সংখ্যা বাড়াতে শুরু করেছে।
এ অবস্থায় আন্তর্জাতিক রেডক্রস কমিটির (আইসিআরসি) প্রেসিডেন্ট মিরজানা স্পলজারিক সব পক্ষকে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইন মেনে চলার পাশাপাশি বেসামরিক জনগণকে রক্ষায় প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। এক্স হ্যান্ডলে তিনি লিখেছেন, অনতিবিলম্বে এ অবস্থা থেকে বিরত না থাকলে পরিস্থিতি মানবিক বিপর্যয়ের দিকে ধাবিত হবে বলে আশঙ্কা করছি।
এদিকে খাদ্য, পানি সরবরাহ বন্ধসহ গাজায় পুরোপুরি অবরোধ আরোপ করার ইসরাইলের সিদ্ধান্তের নিন্দা জানিয়েছে জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশন। সংস্থার প্রধান ভলকার তুর্ক মঙ্গলবার এক বিবৃতিতে এ পরিস্থিতির অগ্রগতিতে প্রভাবশালী দেশগুলোর সঙ্গে কাজ করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, আন্তর্জাতিক এবং মানবাধিকার আইন অবশ্যই বহাল রাখতে হবে।
ইসরাইলের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে সমর্থন জানাতে শুক্রবার পশ্চিম তীর, জেরুজালেমসহ সারা বিশ্বের মুসলমানদের গণসমাবেশের আহ্বান জানিয়েছে হামাস। সেই সঙ্গে ইসরাইলের বিরুদ্ধে ফিলিস্তিনের সবাইকে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ার আহ্বান জানিয়েছেন হামাসের রাজনৈতিক শাখার প্রধান ইসমাইল হানিয়া। তিনি বলেছেন, ফিলিস্তিনের সবাইকে এ যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে। এক বিবৃতিতে তিনি বলেন, আল কাসেম এবং প্রতিরোধ যোদ্ধারা যে আঘাত করেছে সেটার জবাবেই গাজায় ইসরাইলের সরকার নৃশংসতা আর ধ্বংসলীলা চালাচ্ছে। শত্রুদের এ অপরাধ আর সন্ত্রাসবাদের জন্য চরম মূল্য দিতে হবে।
এদিকে আরেক বিবৃতিতে ইসমাইল হানিয়া বলেছেন, যুদ্ধ শেষ না হওয়া পর্যন্ত বন্দি বিনিময় নিয়ে কোনো আলোচনা হবে না। তিনি বলেন, বন্দিদের মুক্তির মাধ্যমে আটক ইসরাইলিদের মুক্তির ব্যাপারে মধ্যস্থতা করতে অনেকেই আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করছেন। তাদের আমাদের এ সিদ্ধান্ত জানিয়ে দেওয়া হয়েছে।
হানিয়া গাজার অধিবাসীদের ধৈর্য, সাহসিকতা এবং আত্মত্যাগের প্রশংসা করেন। তিনি বলেন পরাজয়ের লজ্জার কারণে ইসরাইলি বাহিনী গাজায় হামলার মাধ্যমে ধ্বংসলীলা চালাচ্ছে।
হামাসের প্রায় ১৫০০ যোদ্ধার লাশ পাওয়া গেছে বলে দাবি করেছে ইসরাইলি সেনাবাহিনী। এছাড়া তারা অবরুদ্ধ গাজা ভূখণ্ডের সঙ্গে থাকা ইসরাইলি সীমান্তের নিয়ন্ত্রণ পুনরুদ্ধারের দাবিও করেছে। ইসরাইলের সামরিক মুখপাত্র রিচার্ড হেচট বলেছেন, নিরাপত্তা বাহিনী অবরুদ্ধ গাজা ভূখণ্ডের ‘সীমান্তে কমবেশি নিয়ন্ত্রণ পুনরুদ্ধার করেছে’। তিনি বলেন, ইসরাইল এবং গাজা উপত্যকার আশপাশে প্রায় দেড় হাজার হামাস যোদ্ধার লাশ পাওয়া গেছে। এছাড়া গাজা উপত্যকার কাছাকাছি এলাকা থেকে সব ইসরাইলিকে সরিয়ে নেওয়ার কাজ প্রায় সম্পূর্ণ হয়েছে বলেও তিনি দাবি করেছেন।
সেনা পাঠাবে না যুক্তরাষ্ট্র : মধ্যপ্রাচ্যের সংকটে যুক্তরাষ্ট্র ইসরাইলে সেনা পাঠাবে না বলে স্পষ্ট জানিয়েছেন হোয়াইট হাউজের জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদের মুখপাত্র জন কিরবি। তিনি বলেছেন, সেখানে কোনো সেনা পাঠানোর ইচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের নেই। তবে ওই অঞ্চলে মার্কিন স্বার্থ যুক্তরাষ্ট্র রক্ষা করবে। কিরবি বলেন, ইসরাইলের পক্ষ থেকে আরও নিরাপত্তা সহযোগিতা চাওয়া হতে পারে। যুক্তরাষ্ট্র যত দ্রুত সম্ভব সেটা পূরণ করবে। এদিকে ইরাকের এক প্রভাবশালী রাজনীতিবিদ ইসরাইলকে ওয়াশিংটন সরাসরি সমর্থন দিলে মার্কিন স্বার্থে আঘাত হানার হুমকি দিয়েছেন। ইরাক সরকারকে সমর্থনকারী জোটের প্রভাবশালী সদস্য হাদি আল আমিরি বলেছেন, ইসরাইলকে সমর্থন করলে আমেরিকার সবকিছুই বৈধ লক্ষ্যবস্তু হিসাবে গণ্য হবে।
মধ্যপ্রাচ্য মার্কিন নীতি ব্যর্থ : রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন ওয়াশিংটনের মধ্যপ্রাচ্য নীতিকে ব্যর্থ বলে অভিহিত করে স্বাধীন সার্বভৌম ফিলিস্তিন রাষ্ট্রগঠন জরুরি বলে মন্তব্য করেছেন। মঙ্গলবার মস্কোতে ইরাকের প্রধানমন্ত্রী মোহাম্মদ শিয়া আল সুদানির সঙ্গে বৈঠকের পর পুতিন বলেন, ইসরাইল-গাজা সংকট মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন নীতিরই ব্যর্থতার প্রমাণ।
ইসরাইলকে খামেনির কড়া হুঁশিয়ারি : গাজায় বিরতিহীন বিমান হামলার কারণে এবার ইসরাইলের বিরুদ্ধে কড়া হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছেন ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ খামেনি। তিনি বলেছেন, অবরুদ্ধ গাজায় চালানো হামলার জন্য ইসরাইলকে বড় আঘাত সইতে হবে। খামেনি বলেন, ইহুদিবাদীদের জানা উচিত গাজার জনগণকে হত্যার জন্য বড় আঘাত পেতে হবে। তিনি বলেন, গাজায় চালানো ধ্বংসযজ্ঞ ইহুদিবাদীদের জন্য বিপর্যয় নিয়ে আসবে।
দীর্ঘ যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হামাস : হামাস ইসরাইলের সঙ্গে দীর্ঘমেয়াদি যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত বলে জানিয়েছেন হামাসের নির্বাসিত নেতা আলী বারাকেহ। অ্যাসোসিয়েট প্রেসকে (এপি) দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি একথা জানান। তিনি বলেন, হামাসের কাছে বিপুল পরিমাণ রকেটের সংগ্রহ রয়েছে, যা দিয়ে লম্বা সময়ের জন্য যুদ্ধ চালানো যাবে। আমরা এই যুদ্ধের জন্য ও যে কোনো পরিস্থিতি মোকাবিলা করার জন্য ভালোভাবে প্রস্তুত রয়েছি। এদিকে, সোমবার (৯ অক্টোবর) হামাস হুমকি দিয়েছে যে, ইসরাইল যদি গাজা উপত্যকায় পূর্ব সতর্কতা ছাড়াই বিমান হামলা চালায়, তাহলে তাদের জিম্মিদের মেরে ফেলা হবে।
ফিলিস্তিনিদের পাশে থাকবে সৌদি : হামাস-ইসরাইল সংঘাতের মধ্যে ফিলিস্তিনি প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাসের সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলেছেন সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান। এ সময় তিনি বলেছেন, ইসরাইল-ফিলিস্তিন চলমান উত্তেজনা প্রশমনে সম্ভাব্য সব ধরনের চেষ্টা করছে সৌদি আরব। মোহাম্মদ বিন সালমানের অফিস থেকে দেওয়া এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ফিলিস্তিনি জনগণের ন্যায্য অধিকার আদায়, একটি মর্যাদাপূর্ণ জীবন প্রতিষ্ঠা, তাদের আশা-আকাঙ্ক্ষা উপলব্ধি করা এবং একটি ন্যায্য ও স্থায়ী শান্তি অর্জনে ফিলিস্তিনিদের পাশে দাঁড়ানো অব্যাহত রাখবে সৌদি আরব।