অক্টোবর ১৬, ২০২৩ ৯:৫০ পূর্বাহ্ণ
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ চাপে রয়েছে। যদিও দলটির শীর্ষ নেতারা বিষয়টি প্রকাশ্যে স্বীকার করছেন না। তবে এ নির্বাচন নিয়ে দেশের ভেতর ও বাইরের চাপের বিষয়টি নেতাদের বিভিন্ন বক্তব্যে ফুটে উঠছে। তারা ঘরোয়া আলোচনায় বলছেন, আন্তর্জাতিক চাপ মোকাবিলা করে সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজন, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি রোধ, বিএনপির আন্দোলন মোকাবিলা, দলীয় কোন্দল নিরসনসহ বেশ কয়েকটি চ্যালেঞ্জ রয়েছে, যা গত নির্বাচনে ছিল না। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আওয়ামী লীগের একাধিক নীতিনির্ধারকের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে।
আওয়ামী লীগ ২০০৮ সালের নির্বাচনে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে ক্ষমতায় আসে। এরপর ২০১৪ সালে প্রধান রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ বিএনপির অনুপস্থিতিতে অনুষ্ঠিত একতরফা নির্বাচনে পুনরায় জয় পায় দলটি। বিএনপিসহ তাদের রাজনৈতিক মিত্ররা ২০১৮ সালের নির্বাচনে অংশ নিলেও জয় ছিনিয়ে নেয় আওয়ামী লীগ। এই নির্বাচন নিয়ে দেশে-বিদেশে তুমুল বিতর্ক তৈরি হয়। যার ফলে বিএনপি ও তাদের মিত্ররা এখন সরকার পতনের একদফা দাবিতে আন্দোলন করছে। বিরোধী নেতারা বলছেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়া তারা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অধীনে কোনো নির্বাচনে অংশ নেবে না।
ফলে আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচন ঘিরে পুরোপুরি স্বস্তির নিশ্বাস ফেলতে পারছে না আওয়ামী লীগ। বেশ কিছু চ্যালেঞ্জ তাদের সামনে চলে এসেছে। ইতোমধ্যে নির্বাচন ঘিরে ভিসানীতি ঘোষণা করেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। এর আগে র্যাবের ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছিল দেশটি। ইউরোপীয় ইউনিয়ন আগামীতে সুষ্ঠু নির্বাচন নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছে। তারা জানিয়েছে, এই সংশয়ের কারণে ইইউ নির্বাচনি পর্যবেক্ষক পাঠাবে না। অন্য মার্কিন মিত্ররাও সংশয় প্রকাশ করেছে বাংলাদেশে আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নিরপেক্ষ ভোটগ্রহণ নিয়ে। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে ক্ষমতাসীনদের সামনে এসেছে এসব চ্যালেঞ্জ।
আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য কাজী জাফর উল্লাহ বলেন, বড় দল হিসাবে আওয়ামী লীগে নেতৃত্বের প্রতিযোগিতা রয়েছে। সেখান থেকেই কিছু অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার জন্ম হয়। আমরা কেন্দ্রীয় ও স্থানীয়ভাবে বিরোধ নিরসন করে দিই। এটা একটা নিয়মিত কাজ। বিএনপির আন্দোলন প্রসঙ্গে তিনি বলেন, তাদের একদফা আন্দোলন বা আন্দোলনের নামে যদি পরিস্থিতি অস্থিতিশীল করার চেষ্টা হয়, সেটা মানা হবে না। তখন বিএনপিকে রাজনৈতিকভাবেই মোকাবিলা করা হবে।
আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর আরেক সদস্য আবদুর রহমান বলেন, মুক্তিযুদ্ধের সময় আমেরিকা আমাদের বিরুদ্ধে কাজ করেছে। কিন্তু বিজয় ঠেকিয়ে রাখতে পারেনি। এবারও তাদের বিরোধিতা কাজে আসবে না। কারণ আমাদের অঙ্গীকার রয়েছে সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজনের ব্যাপারে। তাই সরকার নির্বাচন কমিশনের কাজে কোনো হস্তক্ষেপ করবে না। ফলে সংসদ নির্বাচন সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হবে। দলীয় কোন্দলের ব্যাপারে তিনি বলেন, নেতৃত্বের প্রতিযোগিতা থেকে নেতাদের মধ্যে মতপার্থক্য হতেই পারে। কিন্তু নির্বাচনে এর কোনো নেতিবাচক প্রভাব পড়বে না। কারণ আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা নৌকার প্রশ্নে সব সময় ঐক্যবদ্ধ।
জানা গেছে, আওয়ামী লীগের সামনে এই মুহূর্তে বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে অবাধ, সুষ্ঠু, গ্রহণযোগ্য ও নিরপেক্ষ করা। নির্বাচন ও গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া নিয়ে প্রশ্ন তোলার পর আমেরিকার ভিসানীতি ঘোষণায় সব মহলে এক ধরনের উদ্বেগ তৈরি হয়েছে। বিশেষ করে সরকারি কর্মকর্তারা এ নিয়ে আতঙ্কে রয়েছেন। এ ধরনের উদ্বেগ আগে কখনো দেখা যায়নি। সুষ্ঠু নির্বাচনে কোনো বাধা সৃষ্টি হলে সংশ্লিষ্টদের জন্য আমেরিকা ভিসা না দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা থেকে শুরু করে আওয়ামী লীগের শীর্ষ পর্যায়ের নেতারা আমেরিকার অব্যাহত চাপ সত্ত্বেও সংবিধানের আলোকে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানে বদ্ধপরিকর। তারা সভা-সমাবেশে বলছেন, দেশি-বিদেশি সব ষড়যন্ত্র মোকাবিলা করেই সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজন করবেন। প্রধান রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ বিএনপি না এলেও নির্বাচন আয়োজনে তারা বদ্ধপরিকর। যদিও ঘরোয়া আলোচনায় বিএনপিবিহীন নির্বাচন আয়োজন নিয়ে খোদ আওয়ামী লীগের নেতাদের মধ্যে সংশয় কাজ করছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আওয়ামী লীগের একজন নীতিনির্ধারক বলেন, এবার বিএনপির অনুপস্থিতিতে জাতীয় সংসদ নির্বাচন আয়োজন সহজ হবে না। যেখানে তাদের সমর্থন দিচ্ছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ তাদের পশ্চিমা ও অন্য মিত্ররা।
আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের, যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক মাহবুবউল আলম হানিফসহ শীর্ষ নেতারা নিয়মিতই অভিযোগ করে বলছেন, নির্বাচন বন্ধ করার জন্য একটা চক্রান্ত হচ্ছে। এজন্য তারা বিরোধী দল বিএনপিকে সরাসরি দায়ী করছেন।
এদিকে দেশে এই মুহূর্তে মানুষের জন্য বড় সংকট হয়ে এসেছে দ্রব্যমূল্যের লাগামহীন ঊর্ধ্বগতি। তাই জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে দ্রব্যমূল্যের এই ব্যাপক ঊর্ধ্বগতি ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ তৈরি করেছে। এটি তাদের মাথাব্যথার অন্যতম প্রধান কারণ। নানা পদক্ষেপ নেওয়া হলেও দ্রব্যমূল্যের এই ঊর্ধ্বগতি রোধ করা সম্ভব হচ্ছে না। গণভবনে অনুষ্ঠিত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সংবাদ সম্মেলনে প্রায়ই দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির বিষয়ে প্রশ্ন উত্থাপিত হয়। যে কারণে বিব্রত আওয়ামী লীগ সরকারের উচ্চ পর্যায়। দলটির রাজনৈতিক মিত্র ১৪ দলের শরিকরাও এ নিয়ে অসন্তুষ্ট। আর আওয়ামী লীগের তৃণমূল নেতাকর্মীরা মনে করেন, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির লাগাম টানতে না পারলে নির্বাচনে তার খেসারত দিতে হবে।
আওয়ামী লীগের আরও একটি বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে দলীয় কোন্দল। টানা ১৫ বছর ক্ষমতায় থাকায় শাসক দলটির নেতাকর্মীদের মধ্যে ভাগবাটোয়ারা, আধিপত্য বিস্তার, নেতৃত্বের প্রতিযোগিতা ও জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দলের মনোনয়ন নিয়ে সারা দেশে কোন্দল ছড়িয়ে পড়েছে। এ নিয়ে প্রায় খুনোখুনিতে লিপ্ত হতে দেখা গেছে দলীয় নেতাকর্মীদের। আওয়ামী লীগের মতাদর্শ ধারণ করে না এমন অনেকে দলটিতে ঢুকে বিভেদ তৈরি করছে বলেও অভিযোগ রয়েছে। আর এই বহিরাগতদের নিজেদের প্রয়োজনে দলে আনছেন মন্ত্রী-এমপি ও প্রভাবশালী নেতারা। তৃণমূল নেতাকর্মীরা মনে করছেন কোন্দল সহনীয় পর্যায়ে আনা না গেলে সংসদ নির্বাচনে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। সব দলের অংশগ্রহণে নির্বাচন হলে প্রতিপক্ষ রাজনৈতিক দল নয়, আওয়ামী লীগের প্রার্থীদের মোকাবিলা করতে হবে নিজ দলের নেতাকর্মীদের বিরোধিতা। এ অবস্থায় যোগ্য প্রার্থী নির্বাচন আওয়ামী লীগের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দেখা দিয়েছে। কারণ সারা দেশে সাংগঠনিকভাবে আওয়ামী লীগ এখন দলীয় কোন্দলে বিপর্যস্ত। এ অবস্থা বিরাজ করছে প্রতিটি নির্বাচনি এলাকায়।
বিএনপি তাদের মিত্রদের সঙ্গে নিয়ে এই মুহূর্তে সরকার পতনের একদফার আন্দোলনে রয়েছে। গত বছরের শেষের দিক থেকে ঢাকা ও ঢাকার বাইরে বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করে আসছে বিএনপি। জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দিন ঘনিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে বিরোধী পক্ষ আন্দোলনের গতি বৃদ্ধির চেষ্টা করছে। এই আন্দোলন মোকাবিলা আওয়ামী লীগের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ। সেজন্য আওয়ামী লীগও পালটা কর্মসূচি দিয়ে যাচ্ছে। নির্বাচনের তফশিল ঘোষণার পর বিএনপির আন্দোলন কোনদিকে মোড় নেয় এখন সেটাই দেখার বিষয়।
বিএনপির আন্দোলন মোকাবিলার পাশাপাশি সামাজিক মাধ্যমে সরকারের বিরুদ্ধে অব্যাহতভাবে চলা অপপ্রচার রোধও আওয়ামী লীগের জন্য একটি চ্যালেঞ্জ। এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে সরকারের উন্নয়ন কর্মকাণ্ড জনগণের কাছে পৌঁছে দিতে পারলে সাফল্য আসবে বলে মনে করছেন আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা। গণভবনে অনুষ্ঠিত একাধিক বৈঠকে কেন্দ্রীয় নেতাদের এ ব্যাপারে কার্যকর ভূমিকা রাখার জন্য নির্দেশ দিয়েছেন আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
বিএনপি সরকার বিদায় নেওয়ার পর সেনা সমর্থিত সরকারকে হটিয়ে ক্ষমতায় আসে আওয়ামী লীগ। এরপর দুই মেয়াদের সরকারে প্রতিনিধিত্ব ছিল ১৪ দলের শরিকদের। কিন্তু বর্তমান সরকারে তাদের কোনো প্রতিনিধি নেই। বিষয়টি নিয়ে শরিকদের মধ্যে অসন্তোষ রয়েছে। এছাড়া গত নির্বাচনের আগে মনোনয়ন না পাওয়ায় ১৪ দলের শীর্ষ নেতাদের কয়েকজন ক্ষুব্ধ। এই দুটি বিষয় এবার আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতৃত্বকে মোকাবিলা করতে হবে। তাই শরিকদের সন্তুষ্ট করাটাও এবার আওয়ামী লীগের জন্য একটি চ্যালেঞ্জ।
সাম্প্রতিক সময়ে সারা দেশে লোডশেডিং ভয়াবহভাবে বেড়েছে। সরকার প্রতিটি বাড়িতে বিদ্যুৎ পৌঁছে দেওয়ার দাবি করলেও এর সুফল ভোগ করা নিয়ে ভিন্ন চিত্র রয়েছে গ্রামে। সংযোগ পেলেও দিনের অধিকাংশ সময় বিদ্যুৎ থাকছে না। ফলে লোডশেডিংয়ে অতিষ্ঠ মানুষ। নির্বাচনের আগে এই লোডশেডিং দূর করাটা আওয়ামী লীগের জন্য বড় এবং কঠিন একটি চ্যালেঞ্জ। কারণ করোনা মহামারি ও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের পর দেশের অর্থনীতি নাজুক অবস্থায় রয়েছে। কমছে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ।