এপ্রিল ৫, ২০২৪ ১০:৫৭ পূর্বাহ্ণ
সংকটের আবহে ঘুরপাক খাচ্ছে অর্থনীতি। রাজস্ব আহরণের লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে রয়েছে সংশয়। ধীরগতি কাটেনি উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে। ডলারের সরবরাহ কিছুটা বাড়লেও কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় বাড়ছে না বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ।
অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী তার প্রথম বাজেট দিতে যাচ্ছেন ৭ লাখ ৯৬ হাজার ৯০০ কোটি টাকার। এটি চলতি বাজেটের তুলনায় চার দশমিক ৬০ শতাংশ বেশি, টাকার অঙ্কে বাড়ছে ৩৫ হাজার ১১৫ কোটি টাকা। রাজস্ব আহরণের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে পাঁচ লাখ ৩১ হাজার ৯০০ কোটি টাকা। আসন্ন বাজেটে সামগ্রিক ঘাটতি (অনুদান ছাড়া) হবে দুলাখ ৬৫ হাজার কোটি টাকা।
বৃহস্পতিবার আর্থিক মুদ্রা ও মুদ্রা বিনিময় হার সংক্রান্ত কো-অর্ডিনেশন কাউন্সিল এবং বাজেট ব্যবস্থাপনা ও সম্পদ কমিটির বৈঠকে এসব সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। ওই দুটি বৈঠকে সভাপতিত্ব করেন অর্থমন্ত্রী। ভার্চুয়ালি অনুষ্ঠিত বৈঠকে কঠোর গোপনীয়তা অবলম্বন করা হয়।
অর্থনীতি খাতের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের এ দুটি বৈঠকে আমদানি, রপ্তানি পরিস্থিতি, পণ্যের মূল্য, জিডিপির প্রবৃদ্ধি অর্জনের অগ্রগতি, এডিপিসহ চলতি বাজেট বাস্তবায়ন হার নিয়ে আলোচনা হয়। এছাড়া ভর্তুকি পরিস্থিতি, সুদহার, ব্যাংক ঋণ পরিস্থিতি, পুঁজিবাজার, রাজস্ব খাত, সঞ্চয়পত্র, মূল্যস্ফীতি, প্রবৃদ্ধির বিষয়ও আলোচনায় উঠে আসে।
সূত্র জানায়, বৈঠকে আগামী অর্থবছরের সম্ভাব্য বাজেটের আকার এবং চলতি সংশোধিত বাজেটের তথ্য তুলে ধরা হয়। এ প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত অর্থ বিভাগের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা জানান, প্রতিবছর বাজেটের প্রবৃদ্ধি সংকোচনমূলক ধরেই প্রাক্কলন করা হয়েছে। ফলে বাজেটের আকার খুব বেশি বাড়ছে না।
জানতে চাইলে অর্থ প্রতিমন্ত্রী ওয়াসিকা আয়শা খান বলেন, অর্থনীতি ভালোর দিকে যাচ্ছে। ডলার সরবরাহ বাড়ছে। আগামী বাজেটে রাজস্ব আহরণ প্রধান চ্যালেঞ্জ বলে মনে করছেন তিনি। তবে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। তার মতে, ঈদকে ঘিরে টাকার প্রবাহ বাড়বে-এতে মৌসুমি মূল্যস্ফীতি হতে পারে। কিন্তু খাদ্য মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের দিকে নজর বেশি রয়েছে।
তিনি আরও বলেন, তুরস্কে মূল্যস্ফীতি এখন ৬২ শতাংশ। বাংলাদেশে এখনো ১০ শতাংশের নিচে রয়েছে। বাজেটের অর্থ ব্যয় গতিশীল করতে নানা উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে।
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম জানান, বিদ্যমান পরিস্থিতিতে বাজেট সংকোচনমূলক করা দরকার। এরপরও যে প্রাক্কলন করা হচ্ছে, সেটি কতটুকু বাস্তবায়ন হয়, সেটি দেখার বিষয়। বর্তমানে বিনিয়োগ হচ্ছে না। বেসিরকারি খাতে ঋণপ্রবাহ কম। এক্ষেত্রে ৭ শতাংশ জিডিপির প্রবৃদ্ধি অর্জন কঠিন হবে। মূল্যস্ফীতি কমিয়ে আনতে নতুন বাজেটে পদক্ষেপ থাকতে হবে বলে মনে করেন এই অর্থনীতিবিদ।
বড় অঙ্কের রাজস্ব আহরণ বড় চ্যালেঞ্জ হিসাবে থাকছে আগামী বাজেটে। যদিও অর্থ বিভাগের পূর্ভাবাসে বলা হয় আগামী ছয় মাসের মধ্যে দেশের সামগ্রিক অর্থনীতির অবস্থা ভালোর দিকে যাবে। এমন পরিস্থিতি ধরে নিয়ে পাঁচ লাখ ৩১ হাজার ৯০০ কোটি টাকা মোট আয়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। এটি মোট জিডিপির ৯ দশমিক ৪ শতাংশ। যদিও চলতি অর্থবছর পাঁচ লাখ কোটি টাকার রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে। ফলে নতুন বাজেটে রাজস্ব আহরণের লক্ষ্যমাত্রা বাড়ছে প্রায় ৩২ হাজার কোটি টাকা।
বড় অঙ্কের রাজস্ব আহরণের জন্য ঢাকা ও চট্টগ্রামে ভ্যাট জাল সম্প্রসারণ করা হবে। বিশেষ করে ইএফডি মেশিন স্থাপনের জন্য বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তি করা হয়েছে। এছাড়া শনাক্ত করা হবে নতুন করদাতাও। নতুন করদাতাদের করজালে আনতে বিআরটিএ, সিটি করপোরেশন, ডিপিডিসির সঙ্গে সমন্বয় করে কাজ করার পরিকল্পনা নিয়েছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)।
এছাড়া ২০ লাখ টাকা বা তার ঊর্ধ্বে মূসক পরিশোধে ই-চালান বাধ্যতামূলক করা হচ্ছে। আগে সেটি ৫০ লাখ টাকার ক্ষেত্রে বাধ্যতামূলক ছিল। এছাড়া আয়কর আইন-২০২৩ প্রয়োগের মাধ্যমে রাজস্ব ব্যবস্থাপনার দক্ষতা বাড়ানো, আদায় বৃদ্ধি ও সেবার মান উন্নয়ন করা হবে।
সূত্রমতে, আসন্ন বাজেটে অগ্রাধিকার দেওয়া হচ্ছে ১০টি খাতকে। এর মধ্যে রয়েছে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ। ‘সবার জন্য খাদ্য’, সরবরাহ ব্যবস্থা উন্নয়ন, প্রবৃদ্ধি অর্জন, সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতা বৃদ্ধি, প্রতিটি গ্রামকে আধুনিকায়নকরণ, জিডিটাল স্বাস্থ্য ও শিক্ষাব্যবস্থা নিশ্চিতকরণ, ফাস্ট ট্র্যাক অবকাঠামো প্রকল্প গুরুত্ব দেওয়া, জলবায়ু অভিঘাত মোকাবিলা এবং বৈশ্বিক সংকট মোকাবিলায় পদক্ষেপ গ্রহণ।
সেখানে আরও বলা হয়, বাজেটের ঘাটতি ধারণযোগ্য পর্যায়ে রেখে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। পাশাপাশি মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে মুদ্রানীতির সফল বাস্তবায়ন জরুরি। এছাড়া কৃষি, কৃষক, কিষানি ও গ্রামীণ অর্থনীতিকে গুরুত্ব দিয়ে সবার জন্য খাদ্য নিশ্চিত করতে হবে।
সূত্রমতে, ‘আর্থিক মুদ্রা ও মুদ্রা বিনিময় হার সংক্রান্ত কো-অর্ডিনেশন কাউন্সিল সভায় আগামী অর্থবছরের জন্য জিডিপির প্রবৃদ্ধির হার ৬ দশমিক ৭৫ শতাংশ নির্ধারণ করা হয়। অর্থমন্ত্রী প্রবৃদ্ধির হার চলতি অর্থবছরের তুলনায় কিছুটা নামিয়ে আনেন। চলতি অর্থবছরে প্রবৃদ্ধির হার ৭ দশমিক ৫ শতাংশ ধরা হয়। যদিও বিশ্বব্যাংকের সর্বশেষ পূর্বাভাসে বলা হয়, বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি ৫ দশমিক ৬ শতাংশের ঘরে থাকবে।
বৈঠকে এ মুহূর্তে অর্থনীতির চ্যালেঞ্জ হিসাবে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণকেই ধরে নেওয়া হয়েছে। সেখানে বলা হয়, মূল্যস্ফীতি না কমাতে পারলে প্রবৃদ্ধি অর্জনে কোনো ধরনের লাভ হবে না। ফলে সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে বেশি নজর দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়।
বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন অর্থ বিভাগের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা জানান, চলতি অর্থবছরে মূল্যস্ফীতি ৬ দশমিক ৫ শতাংশ ধরা হয়। কিন্তু সে লক্ষ্যমাত্রার মধ্যে আনা সম্ভব নয়। সর্বশেষ ফেব্রুয়ারিতে মূল্যস্ফীতি ৯ দশমিক ৬৭ শতাংশে ওঠে। ফলে আগামীতে মূল্যস্ফীতি ৭ দশমিক ৫ শতাংশ লক্ষ্য ধরা হবে। অর্থ বিভাগ মনে করছে, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের জন্য ব্যাংক ঋণের সুদের হার বাড়ছে, আমদানি কমানো হচ্ছে, অযৌক্তিক ব্যয় হ্রাস করা হচ্ছে। এছাড়া অর্থ সরবরাহ কমিয়ে আনা হচ্ছে।
সূত্র আরও জানায়, ওই বৈঠকে ভর্তুকি নিয়ে আলোচনা হয়। সেখানে বলা হয়, জিনিসপত্রের মূল্য ও জ্বালানি তেলের দাম কমতির ফলে আগামীতে ভর্তুকি কিছুটা কমতে পারে। কিন্তু বিগত কয়েক বছরের বকেয়া ভর্তুকি পরিশোধের চাপ বেশি থাকবে। যে কারণে ভর্তুকি খাতে সার্বিক ব্যয় কমছে না।