কখনো সিনেমা, কখনো পণ্য কিংবা কখনো ব্যক্তি; নিজের মনমতো না হলে অনেক সময় বলে থাকি-বয়কট! বিদেশি এই শব্দটি বাংলাদেশেও বেশ জনপ্রিয়। এমনকি দেশে বর্তমানেও বেশ কিছু ‘বয়কট’ আন্দোলন চলছে। এখন যেমন কেউ কেউ ইসরায়েলি পণ্য কিনতে বারণ করছেন, তেমনি ইংরেজ আমলে বিদেশি পণ্যের বিরুদ্ধেও ছিল ‘বয়কট’-এর ডাক। কিন্তু এই ‘বয়কট’ আসলেই কী? কোথা থেকে এলো?
মজার বিষয় হলো, এই শব্দের আবির্ভাব হয়েছিল এক ব্যক্তির নাম থেকেই—চার্লস কানিংহাম বয়কট (Charles Cunningham Boycott)। ১৮৩২ সালে ইংল্যান্ডে তার জন্ম। প্রথমে তার নাম ‘বয়কাট’ রাখা হলেও ৯ বছর বয়সে পরিবার থেকে নাম বদল করে রাখা হয় ‘বয়কট’।
বালক চার্লসের প্রথম ইচ্ছে ছিল সেনাবাহিনীতে যুক্ত হওয়ার। কিন্তু কিছু বিশেষ পরীক্ষায় অকৃতকার্য হওয়ায় সমস্ত উৎসাহ হারিয়ে শুরু করলেন জমি কেনাবেচার কাজ। দুরন্ত ও মেধাবী এই ছেলের পারিবারিকভাবে অর্থেরও অভাব ছিল। ফলে কিছুদিনের মধ্যে কিনে ফেললেন মায়ো কাউন্টির অন্তর্গত আঁচিল দ্বীপের বেশ খানিকটা জমি। পাশাপাশি কাজ করতে লাগলেন আয়ারল্যান্ডের আর্ল অব আর্নের জমি কেনাবেচার মধ্যস্থতাকারী হিসেবে। আর্নের অধীনে তখন প্রায় ৪০০০০ একর জমি।
বয়কটের দায়িত্ব ছিল এই বিশাল পরিমাণ জমি দেখভাল ও সেখানকার কৃষকদের থেকে খাজনা আদায় করা এবং অনাদায়ে তাদের উচ্ছেদ করা। অনেকটা জমিদারের নায়েবের মতো। আর এই কাজে প্রচণ্ড নৃশংস ছিলেন বয়কট। তিনি বিশ্বাস করতেন, জমি ও চাষির জীবনের সমস্ত স্বত্ব মালিকের। ফলে যেভাবেই হোক প্রাপ্য আদায় করতে হবে। তাতে কিছু মানুষের ক্ষতি হলেও, সে দায় তার নয়। এমনকি কাজে আসতে সামান্য দেরি হলে, চাষিদের মাইনে কেটে নিতেন বয়কট।
স্বাভাবিকভাবেই বয়কটের জোর-জুলুমে ক্ষিপ্ত হতে থাকে চাষিরা। ১৮৭৯ নাগাদ মাইকেল ডেভিট নামের এক কৃষকের সন্তান মায়ো প্রদেশে গড়ে তোলেন ‘আইরিশ ন্যাশনাল ল্যান্ড লিগ’। খাজনা কমানো ও উচ্ছেদবিরোধী আন্দোলনে সরগরম হয়ে ওঠে সমগ্র আয়ারল্যান্ড। পরের বছর কৃষকরা দাবি জানায় ২৫ শতাংশ খাজনা কমানোর। শেষ পর্যন্ত রফা হয় দশ শতাংশে।
সেই অর্থ উদ্ধারে প্রবল অত্যাচার চালান বয়কট। উচ্ছেদও করা হয় বেশ কয়েকটি পরিবারকে। এই ঘটনার পৌঁছায় সংসদ পর্যন্ত। সেই সময়ে সংসদের সদস্য ও ল্যান্ড লিগের পক্ষপাতী চার্লস স্টুয়ার্ট পার্নেল ঘোষণা করেন, এরকম ব্যক্তিকে সব জায়গায় উপেক্ষা করা উচিত। ব্যস, যেন ঘি পড়ল আগুনে! বয়কটের বিরুদ্ধে শুরু হলো সামাজিক ধর্মঘট। কোনো অনুষ্ঠানে তাকে ডাকা হয় না, কেউ কথা বলে না তার সঙ্গে। জমি কেনা-বেচা বন্ধ। শুকিয়ে যেতে লাগল জমির ফসল। এমনকি পিয়ন পর্যন্ত তার বাড়িতে চিঠি দিতে আসতে চায় না। এ যেন সম্পূর্ণ একঘরে অবস্থা। ‘দ্য টাইমস’-এর পাতায় নিজের অসহায় অবস্থার কথা জানিয়ে খোলা চিঠি লিখলেন বয়কট।
এগিয়ে এলেন বেলফাস্ট আর ডাবলিনের বন্ধুরা। ফসল কাটার জন্য ৫০ জন লোক পাঠানো হলো মায়োতে। আর তাদের নিরাপত্তার জন্য থাকল ৯০০ সশস্ত্র সৈন্য। তাতে অবশ্য লাভ কিছু হয়নি বয়কটের। ৩৫০ পাউন্ডের ফসলের বদলে সৈন্যবাহিনীর জন্য তার খরচ হয়েছিল ১০ হাজার পাউন্ড। আর এইসব ঘটনার ফলে শুধু আয়ারল্যান্ড নয়, ইংল্যান্ডসহ ইউরোপের বেশ কয়েকটি দেশে ছড়িয়ে পড়ে তার গল্প। খবরের কাগজে জন্ম হয় অসংখ্য কার্টুনের। উনিশ শতকের শেষ দিকে ল্যান্ড লিগ ও পার্নেলের জনপ্রিয়তার ফলে যেখানেই জমিদার শ্রেণিরা অত্যাচার করত, সেখানেই নেওয়া হতে থাকে বয়কটের পদ্ধতি।
তবে আজকের অর্থে ‘বয়কট’ শব্দটির প্রয়োগ ঠিক কবে, কীভাবে শুরু হলো বলা মুশকিল। অনেক গবেষকের মতে মায়োর গির্জার পুরোহিত ফাদার ও ম্যালের মাধ্যমে জনপ্রিয় হয় ‘বয়কটিং’ শব্দটি।