বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে ভারতের দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তনের কারণ কী?

বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে ভারতের দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তনের কারণ কী?

জাতীয় স্লাইড

সেপ্টেম্বর ৫, ২০২৩ ২:২৩ অপরাহ্ণ

বৈদেশিক নীতির ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অভ্যন্তরের নানান পরিবর্তনশীল বিষয় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে ভারত। অতীতে সেটি দেখা গেছে। ভারতীয় সংসদ ভবনের একটি ম্যুরালকে ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) এক মন্ত্রী বাংলাদেশকে অখণ্ড ভারত (অবিভক্ত ভারত) বলে আখ্যা দিয়েছিলেন। যার ফলে বাংলাদেশ সরকার ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের (এমইএ) কাছে ব্যাখ্যা চেয়েছিল- কারণ ওই ম্যুরালটি আপাতদৃষ্টিতে একটি রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের অস্তিত্বকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছিল।

বাংলাদেশ সরকারের তরফে এখন পর্যন্ত মোদির ওই মন্তব্যের প্রতি কোনো প্রতিক্রিয়া কিংবা নিরাপত্তাহীনতার কোনো লক্ষণ দেখতে পাওয়া যায়নি। সরকারের হয়তো সে ফুরসতও নেই। সর্বোপরি, হাসিনা সরকার এখন ২০২৪ সালের জানুয়ারির নির্বাচনের দিকে এগিয়ে যাওয়ার প্রেক্ষাপটে জটিল এক পরিস্থিতির মধ্যে রয়েছে।

এ বছর বিজেপি নেতৃত্বাধীন ভারত সরকার বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) এবং জাতীয় পার্টির সঙ্গে বৈঠকে বসেছে। গত মার্চে বিএনপির একটি প্রতিনিধি দল বাংলাদেশে নিযুক্ত ভারতীয় হাইকমিশনার প্রণয় ভার্মার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছে। জাতীয় পার্টির একটি প্রতিনিধি দল সম্প্রতি ভারত সফর করেছে। প্রণয় ভার্মার সঙ্গে বিএনপির বৈঠকটিকে সমস্ত অংশীদারদের সঙ্গে নিয়মিত আলাপ হিসেবে আখ্যা দেওয়া হলেও সেটি ছিল এক দশকেরও বেশি সময় পর ভারত এবং বাংলাদেশের বিরোধী দলের মধ্যে এ ধরনের প্রথম কোনো বৈঠক।

এমনকি যদি ভারত কেবল তার নিয়মিত কর্মকাণ্ডের অংশ হিসেবেও বিএনপি এবং জাতীয় পার্টির সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে থাকে, তবুও তা ২০১৮ সালে বাংলাদেশের জাতীয় নির্বাচনের তুলনায় ভারতের আচরণের পরিবর্তন।

ওই সময় এমন ধরনের কোনো কিছু বৈঠক হয়নি এবং ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় তখন বলেছিল নয়াদিল্লির প্রতি বিএনপির নীতিতে কোনো স্পষ্ট পরিবর্তন এসেছে, ভারত এমন কোনো ‘বিশ্বাসযোগ্য প্রমাণ’ দেখতে পাচ্ছে না।

উপরন্তু, জুলাই মাসে ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) নির্বাচন অনুসন্ধানী মিশন ভারত বিরোধী জামায়াত ইসলামীর সঙ্গে সংলাপ শুরু করলেও কৌতূহল উদ্দীপকভাবে ভারতের প্রতিক্রিয়া ছিল সংযত। যদিও এই সম্পৃক্ততা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের লোকজন ভালোভাবে নেননি, তবুও মন্ত্রণালয় উক্ত বৈঠক সম্পর্কিত কোনো বিবৃতি দেয়নি। একইভাবে, বাংলাদেশের প্রতিবেশী ভারতীয় রাজ্যগুলোর অনেক আঞ্চলিক পত্রপত্রিকা জামায়াতের সঙ্গে ইইউর বৈঠকের সমালোচনা করে নিবন্ধ প্রকাশ করলেও, নেতৃস্থানীয় কোনো জাতীয় পর্যায়ের গণমাধ্যম ঘটনাটি প্রকাশ করেনি। সুতরাং, এটা অনুমান করা ভুল হবে না যে, ইইউ-জামায়াত মিথস্ক্রিয়া নিয়ে মন্তব্য করা থেকে বিরত থাকা নিয়ে ভারত উদ্বিগ্ন ছিল না।

ওপরে উল্লিখিত ঘটনাগুলোর মতো অন্যান্য উদাহরণগুলো এই ইঙ্গিত দেয় যে, ভারত অতীতের মতো নিজের সব ডিম আওয়ামী লীগের ঝুড়িতে রাখার বদলে বাংলাদেশের জাতীয় নির্বাচনকে কেন্দ্র করে অনেক বেশি অন্তর্ভুক্তিমূলক পথ বেছে নিচ্ছে। যা কিনা আওয়ামী লীগ সরকারের মধ্যে নিরাপত্তাহীনতার কারণ হতে পারে। বৃহত্তর প্রেক্ষাপটে, আওয়ামী লীগ সিদ্ধান্ত নিয়েছে যে পরিবারতান্ত্রিক রাজনীতি সম্পর্কে মোদির মন্তব্য নিয়ে প্রশ্ন তোলাটা বুদ্ধিমানের কাজ হবে না। যদিও শেখ হাসিনা একটি পরিবারতান্ত্রিক দলের নেতৃত্ব দেওয়ার পাশাপাশি ভারতের বিরোধী দল কংগ্রেসের সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে। নিজের ভারত সফরের সময় তিনি দলটির সদস্যদের সঙ্গে দেখা করেন।

বাংলাদেশের জাতীয় নির্বাচন যেনো সহিংসতামুক্ত হয় এবং যথাযথ গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া অনুসরণ করে অনুষ্ঠিত হয়- তা নিশ্চিত করতে নিজের আগ্রহও দেখিয়েছে ভারত। গত ৩ আগস্ট পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সাপ্তাহিক মিডিয়া ব্রিফিংয়ে মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র অরিন্দম বাগচী এটি জোর দিয়ে বলেছেন। বাংলাদেশের নির্বাচন বিষয়ে ভারতের এই দৃষ্টিভঙ্গি যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থানের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ। তাই বলা যায়, ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের সিকিউরিটি এস্টাবলিশমেন্ট নির্বাচনের বিষয়ে বৃহত্তর ঐকমত্য তৈরির জন্য একসঙ্গে মিটিং করেছে বলে দ্য টেলিগ্রাফের একটি প্রতিবেদনের ভিত্তি থাকতে পারে।

এটিও ২০১৮ সালের নির্বাচনের তুলনায় ভারতের আচরণের পরিবর্তনকে প্রতিনিধিত্ব করবে। ওই সময় নির্বাচন নিয়ে ভারত এবং যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থানে বড় ধরনের পার্থক্য ছিল। ২০১৮ সালে, ওয়াশিংটন নির্বাচনের আগে হয়রানি, ভয়ভীতি প্রদর্শন এবং সহিংসতার বিশ্বাসযোগ্য প্রতিবেদন এবং নির্বাচন-দিনের অনিয়ম… যা নির্বাচনী প্রক্রিয়ার প্রতি বিশ্বাসকে ক্ষুন্ন করেছে এই নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছিল। যাই হোক, ওই নির্বাচনে জয়ী হওয়ার পর হাসিনাকে দ্রুত অভিনন্দন জানানোর বিষয়ে মোদির সিদ্ধান্ত মোড় ঘুরিয়ে দিতে সাহায্য করেছিল। আওয়ামী লীগকে কোনো গুরুতর আন্তর্জাতিক চাপের সম্মুখীন না হতেও সেটি সাহায্য করেছিল।

এতে কোনো সন্দেহ নেই, মোদি-হাসিনার বন্ধুত্ব এবং আস্থার কারণেই বলা হয় যে, ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক সোনালী অধ্যায় রয়েছে। হাসিনার শাসনামলে ভারত এমন একটি সরকার পায় যেটি সন্ত্রাসবিরোধী, ভারত বিরোধী নয় এবং ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের উন্নতির জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

কিন্তু একই সময়ে, হাসিনা সরকারের আমলে হিন্দুদের ওপর হামলা হয়েছে, বিশেষ করে হিন্দুদের বিরুদ্ধে ২০২১ সালের সহিংসতা। উপরন্তু, যদিও বাংলাদেশ ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সঙ্গে সংযোগের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে, সেটির আবার নেতিবাচক প্রভাবও থাকতে পারে। মণিপুরে (ভারতীয় রাজ্য) চলমান সংঘাতের পটভূমিতে, মেইতি (সংখ্যাগরিষ্ঠ) সম্প্রদায় বাংলাদেশ থেকে অবৈধ অভিবাসীদের অনুপ্রবেশের বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে।

সুতরাং, হাসিনা সরকারের মাধ্যমে যে সুবিধাগুলো এসেছে সেগুলো নিরঙ্কুশ নয়। ২০১৮ সালের তুলনায় বিজেপি নেতৃত্বাধীন ভারত সরকারের আচরণে কেন পরিবর্তন এসেছে, তার একটা ব্যাখ্যা এটাও হতে পারে।

বাংলাদেশের জাতীয় নির্বাচনের প্রতি ভারতের আচরণের পরিবর্তনকে প্রতিষ্ঠিত করা এসব দৃষ্টান্ত এবং ভাবভঙ্গি কেবল ২০২৪ সালের নির্বাচনের ক্ষেত্রেই নয়, ভবিষ্যতের নির্বাচনের ক্ষেত্রেও হাসিনা সরকারের জন্য নিরাপত্তাহীনতা তৈরিতে ভূমিকা রাখতে পারে।

সূত্র: দ্য ডিপ্লোম্যাট

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *