মার্চ ১৭, ২০২৪ ১০:১৫ পূর্বাহ্ণ
শিল্প প্রতিষ্ঠান, সার কারখানা কিংবা বাসাবাড়ি সবখানেই দিনকে দিন গ্যাসের সংকট ঘনীভূত হচ্ছে। দেশে চাহিদার বিপরীতে প্রতিদিন যোগানে ঘাটতি থাকছে ১ হাজার মিলিয়ন ঘনফুট। বিবিয়ানায় গ্যাস উত্তোলন কমে আসা, এ সমস্যায় যোগ করেছে দুশ্চিন্তার বাড়তি মাত্রা।
দেশে ২৯টি গ্যাসক্ষেত্রের মধ্যে বর্তমানে ২০টি গ্যাসক্ষেত্র থেকে নিয়মিত গ্যাস উত্তোলন করা হচ্ছে। তবে এসব গ্যাসক্ষেত্রে সব মিলিয়ে গ্যাস আছে ৮ দশমিক ৪৬ টিসিএফ। বিশ্লেষকরা বলছেন, এই পরিমাণ মজুত দিয়ে এক দশকও চলবে না বাংলাদেশের।
দিনকে দিন গ্যাসের সংকট যে ঘনীভূত হচ্ছে, তার চাক্ষুষ উদহারণ বিবিয়ানা গ্যাস ফিল্ড। দেশের ৬০ শতাংশ গ্যাসের যোগান আসে বিবিয়ানা থেকে। মার্কিন বহুজাতিক প্রতিষ্ঠান শেভরন এতদিন বিবিয়ানা থেকে দৈনিক ১ হাজার ৪০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস উত্তোলন করলেও, এখন তা কমে নেমে এসেছে ১ হাজার ১০০ মিলিয়নে।
যদিও সম্প্রতি বিবিয়ানার গ্যাস উত্তোলন জোরদার করতে বুস্টার বসিয়েছে জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়; তারপরও বিবিয়ানা নিয়ে সংকট থেকেই যাচ্ছে।
জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিবিয়ানা নিয়ে এখনই ব্যবস্থা না নিলে বড় রকমের সংকটের মুখে পড়তে হবে। জ্বালানি বিশেষজ্ঞ বদরুল ইমাম বলেন, ‘বিবিয়ানা নিয়ে কালক্ষেপণের কোনো সুযোগ নেই। যত শিগগিরই সম্ভব বিবিয়ানার একটি বিকল্প খুঁজে বের করতে হবে। বিবিয়ানায় গ্যাস শেষ হয়ে যাবে, পরে বিকল্প ব্যবস্থা খোঁজা হবে- এমন চিন্তা করলে বিপদে পড়তে হবে।’
আরেক জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ম তামিম বলেন, শেভরন চেষ্টা করছে বিবিয়ানার গ্যাস উত্তোলন কার্যক্রম সম্প্রসারিত করতে। কিন্তু কোনো কারণে যদি বিবিয়ানা বন্ধ হয়ে যায়; সেটা হয়তো একসঙ্গে হবে না; তবে গ্যাস উত্তোলনের পরিমাণ যদি কমে আসে, তাহলে দেশে জ্বালানি সংকট প্রকট আকার ধারণ করবে।
তামিম বলেন, ‘দেশে প্রতিদিন ২ হাজার ৩০০ মিলিয়ন ঘনফুটের মতো গ্যাস উত্তোলন করা হয়। এই পরিমাণ গ্যাস উত্তোলনে শুধু বিবিয়ানাই ১ হাজার ২০০ মিলিয়ন ঘনফুটের যোগান দিয়ে থাকে; যা অর্ধেকেরও বেশি। যদি বিবিয়ানার গ্যাস বন্ধ হয়ে যায়, তাহলে অবস্থা কী দাঁড়াবে সেটি সহজেই অনুমেয়।’
সমাধানের কথা উল্লেখ করে তামিম বলেন, নতুন গ্যাসক্ষেত্র অনুসন্ধানের কোনো বিকল্প নেই। যদি ভূপৃষ্ঠে ব্যাপকহারে গ্যাস অনুসন্ধান করা হয় তাহলে বাড়তি আরও ৪ বা ৫ টিসিএফ গ্যাস পাওয়া যেতে পারে। এ ছাড়া অফশোর মাধ্যম থেকে কী পরিমাণ গ্যাস পাওয়া যাবে তা এখনও হলফ করে বলা যায় না।
গ্যাস সংকটের সমাধান খুঁজতে আপাতত জ্বালানি বিভাগ বঙ্গোপসাগরে গ্যাস অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নিয়েছে এবং এ সংক্রান্ত দরপত্র আহ্বান করেছে জ্বালানি বিভাগ।
তবে বঙ্গোপসাগরে কী পরিমাণ জ্বালানির খোঁজ পাওয়া যাবে তা এখনই হলফ করে বলা যাচ্ছে না। বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ জানিয়েছেন, অফশোর বিডিংয়ের মাধ্যমে বিদেশি কোম্পানিকে কাজ দেয়ার পরেও জ্বালানির খোঁজ পেতে কম করে হলেও ,এক দশকের মতো সময় লাগবে।
চলতি মাসের ১০ তারিখে পেট্রোবাংলা বঙ্গোপসাগরে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানে ২৪টি ব্লকে আন্তর্জাতিক দরপত্র উন্মুক্ত করেছে। গভীর সমুদ্রে ১৫টি ও অগভীর সমুদ্রে ১১টি ব্লকে ভাগ করা হয়েছে।
পেট্রোবাংলা জানিয়েছে, নতুন উৎপাদন বণ্টন চুক্তি অনুযায়ী আগে থেকে গ্যাসের দাম নির্ধারণ করা হয়নি। আগের বণ্টন চুক্তি অনুযায়ী, গভীর সমুদ্রের ১ হাজার ঘনফুট গ্যাসের মূল্য ৭ দশমিক ২৫ ডলার এবং অগভীর সমু্দ্রের ১ হাজার ঘনফুট গ্যাসের মূল্য সাড়ে ৫ ডলার ধরা হলেও এবার নতুন চুক্তিতে গ্যাসের দাম নির্ধারণ করা হবে ব্রেন্ট ক্রুড অর্থাৎ অপরিশোধিত জ্বালানি তেলের দামের ১০ শতাংশ হারে।
জ্বালানি বিভাগের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, মূলত গ্যাসের সংকট ঘনীভূত হতে শুরু করায় সরকার এবার বণ্টন চুক্তি ঢেলে সাজিয়েছে। এখানে বিদেশি কোম্পানিগুলোকে কর হ্রাস ও দাম নির্ধারণে আপস করার কারণে এসব কোম্পানি বাংলাদেশের জলসীমায় জ্বালানি অনুসন্ধানে আগ্রহী হচ্ছে। সমুদ্র থেকে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ জ্বালানি পেলে গ্যাসের অভাব অনেকটা মিটে যাবে বলে মনে করেন তারা।
অফশোর বিডিং ছাড়াও আগামী কয়েক বছরে দেশের ভূপৃষ্ঠেও গ্যাসক্ষেত্র অনুসন্ধান বৃদ্ধি করা হবে বলে জানিয়েছে জ্বালানি বিভাগ। এ ব্যাপারে জ্বালানি সচিব নূরুল আমিন বলেন, আগামী বছরগুলোতে দেশে ১০০টির মতো গ্যাসক্ষেত্র অনুসন্ধানে কূপ খনন করা হবে। এসব কূপ থেকে আশানুরূপ গ্যাসের সন্ধান মিললে সমস্যা অনেকটা কেটে যাবে। ঠিক কী পরিমাণ গ্যাস পাওয়া যাবে তা এখনই বলা মুশকিল বলে জানান জ্বালানি সচিব।
তবে এ ব্যাপারে জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই গ্যাস অনুসন্ধানের কাজ কম করে হলেও আরও ১০ বছর আগে থেকে শুরু করতে হতো। এখন কাজ শুরু করলে গ্যাস পাওয়া যাবে ১০ বছর পর, তাও নিশ্চিত হয়ে বলা যায় না। এক বিবিয়ানা বন্ধ হয়ে যাওয়া নিয়ে আগে থেকে ভাবলে এখন আর বিপদের সম্মুখীন হতে হতো না।
এ সমস্যার আশু কোনো সমাধান নেই জানিয়ে বদরুল ইমাম বলেন, এটি মূলত ভুল সিদ্ধান্তের কর্মফল। এতদিন ধরে কূপ খনন না করা, অনুসন্ধান না করে এখন তড়িঘড়ি করে সমাধান চাইলে সেটি সম্ভব হবে না। মূলত এখনই বাংলাদেশের বিপুল পরিমাণ গ্যাসের প্রয়োজন। দিন যত যাবে গ্যাসের চাহিদা তত বাড়বে।
বাংলাদেশে গ্যাসের চাহিদা ও যোগানের ফারাক মেটাতে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) আমদানি আদৌ বুদ্ধিদীপ্ত সিদ্ধান্ত হবে কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে বদরুল ইমাম বলেন, ‘এছাড়া কোনো উপায় নেই বাংলাদেশের হাতে। এলএনজি আমদানি করে বড় রকমের চাপের মুখে পড়তে হবে এ কথা সত্যি, কিন্তু আমদানি না করে গ্যাসশূন্য বসে থাকাও কোনো সমাধান না।’