গত বছরের ৭ অক্টোবর ইসরায়েলের সীমান্তে প্রবেশ করে আকস্মিক হামলা চালায় ফিলিস্তিনি স্বাধীনতাকামী সংগঠন হামাস। এরপরেই গাজায় পাল্টা আক্রমণ শুরু করে ইসরায়েল। ছয় মাস ধরে সেখানে আগ্রাসন চালাচ্ছে ইসরায়েলি বাহিনী।
ইসরায়েলে হামাসের হামলায় ১২০০ জন নিহত এবং শতাধিক মানুষকে জিম্মি করে নিয়ে যাওয়া হয়। হামাসকে চূর্ণ-বিচূর্ণ ও ধ্বংস করার প্রতিশ্রুতি দিয়ে অভিযান শুরু করেছিল ইসরায়েল। হামাস যেন আর কোনো হুমকি সৃষ্টি করতে না পারে এবং ইসরায়েল যেন তাদের সব জিম্মিকে ঘরে ফিরিয়ে আনতে পারে সে পথেই আগ্রাসন চালানো হয়েছে।
ইসরায়লি এ হামলায় গাজায় এখন পর্যন্ত ৩৩ হাজার ১৭৫ জন নিহত হয়েছে। এর মধ্যে অধিকাংশই নারী এবং শিশু। এছাড়া আহত হয়েছে আরও ৭৫ হাজার ৮৮৬ জন। গাজার বড় অংশই ধ্বংস হয়ে গেছে।
এরইমধ্যে ইসরায়েল জানিয়েছে, তারা হাজারো হামাস যোদ্ধাকে হত্যা করেছে এবং গাজার তলদেশে সুড়ঙ্গের বিশাল নেটওয়ার্ক ধ্বংস করেছে, যা হামাস হামলা চালাতে ব্যবহার করছিল।
ইসরায়েলি ডিফেন্স ফোর্সেসের (আইডিএফ) পাবলিক বিবৃতি এবং সোশ্যাল মিডিয়া পোস্টগুলো যাচাই করে দেখেছে বিবিসি ভেরিফাই এবং ইসরায়েল রাষ্ট্রীয়ভাবে যেসব দাবি করেছে সেগুলোরও তথ্য প্রমাণ যাচাই করে দেখা হয়েছে।
হামাসের কত নেতা নিহত হয়েছেন
সম্প্রতি এক বিবৃতিতে ইসরায়েলের সামরিক বাহিনী জানিয়েছে, গাজায় হামলা শুরু করার পর তারা হামাসের প্রায় ১৩ হাজার সদস্যকে হত্যা করেছে। তবে এই সংখ্যা কীভাবে নির্ধারণ করা হয়েছে, তা জানায়নি। নিহত হামাস নেতাদের নামের তালিকাও প্রকাশ করছে ইসরায়েল।
ইসরায়েলের হিসাবে গত অক্টোবর থেকে ওই তালিকায় যুক্ত হয়েছে হামাসের ১১৩ নেতার নাম। তাদের বেশির ভাগই নিহত হয়েছেন সংঘাত শুরুর প্রথম তিন মাসের মধ্যে। তবে চলতি বছরের শুরু থেকে মার্চ পর্যন্ত কোনো হামাস নেতা নিহত হওয়ার খবর প্রকাশ করেনি ইসরায়েল। সর্বশেষ গত ২৬ মার্চ তারা জানায়, হামাসের সামরিক শাখার উপপ্রধান মারওয়ান ঈসাকে হত্যা করা হয়েছে।
মারওয়ান ঈসাকে ইসরায়েলের ‘মোস্ট ওয়ান্টেড’ তালিকায় থাকা একজন বলে ধারণা করা হয়। চলমান সংঘাত শুরুর পর থেকে ইসরায়েলের হামলায় নিহত হামাস নেতাদের মধ্যে তিনিই সবচেয়ে জ্যেষ্ঠ। ঈসাকে হত্যা করা হয়েছে এমন বিশ্বাস যুক্তরাষ্ট্রেরও। তবে হামাসের পক্ষ থেকে তা এখনো নিশ্চিত করা হয়নি।
৭ অক্টোবরের আগে গাজায় হামাসের প্রায় ৩০ হাজার যোদ্ধা ছিল বলে ধারণা করা হয়েছিল বলে আইডিএফ কমান্ডারদের বরাত দিয়ে এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে।
হামাসের অনেক ঊর্ধ্বতন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব যেমন ইসমাইল হানিয়াহ যাকে ওই সশস্ত্র গোষ্ঠীর নেতা বলে ধরা হয়, তিনি বিদেশে থাকেন। তবে এর অনেক সামরিক নেতৃত্ব কাঠামো গাজার অভ্যন্তরে রয়েছে বলে মনে করা হয়।
এদিকে নিহত হামাস নেতাদের যে তালিকা ইসরায়েল প্রকাশ করে আসছে, তার সত্যতা পুরোপুরি যাচাই করা সম্ভব হয়নি বিবিসির পক্ষে। যেমন তালিকায় মুস্তফা থুরায়া নামের একজন রয়েছেন। তিনি গাজায় সাংবাদিক হিসেবে কর্মরত ছিলেন। এ ছাড়া অনেক নাম একাধিকবার তালিকায় এসেছে। তাই তালিকা থেকে বেশ কিছু নাম বাদ দিয়েছে বিবিসি।
এ ছাড়া গত জানুয়ারিতে লেবালনের রাজধানী বৈরুতের কাছে এক বিস্ফোরণে নিহত হন হামাসের রাজনৈতিক নেতা সালেহ আল–আরোউরি। ওই বিস্ফোরণের পেছনে ইসরায়েলের হাত ছিল বলে ধারণা করা হয়। বিবিসির সঙ্গে কথা হওয়া বেশ কয়েকজন বিশেষজ্ঞ বলেছেন, গাজায় ইয়াহিয়া সিনওয়ারসহ হামাসের বেশ কয়েকজন শীর্ষ নেতা এখনো জীবিত থাকতে পারেন।
হামাসের কত সুড়ঙ্গ ধ্বংস হয়েছে
৭ অক্টোবর হামলা শুরুর সময় ইসরায়েলের একটি প্রতিশ্রুতি ছিল গাজায় হামাসের ব্যবহার করা সুড়ঙ্গের যে বিস্তৃত নেটওয়ার্ক রয়েছে, তা ধ্বংস করা হবে। হামাসের তথ্য অনুযায়ী, গাজায় তাদের সুড়ঙ্গের নেটওয়ার্ক ৫০০ কিলোমিটার। তবে এ তথ্যের সত্যতা যাচাই করা সম্ভব হয়নি।
গাজায় হামাসের কয়টি সুড়ঙ্গ ধ্বংস করা হয়েছে, তা ইসরায়েলি বাহিনীর কাছে জানতে চেয়েছিল বিবিসি। জবাবে তারা বলেছে, গাজায় সন্ত্রাসীদের অবকাঠামোগুলোর বড় একটি অংশ ধ্বংস করা হয়েছে।
গাজায় সন্ধান পাওয়া সুড়ঙ্গগুলোর তথ্য মাঝেমধ্যে প্রকাশ করে ইসরায়েলি বাহিনী। যেমন গত নভেম্বরে গাজা নগরীর আল–শিফা হাসপাতালের নিচে সন্ধান পাওয়া সুড়ঙ্গের নেটওয়ার্কের ভিডিও প্রকাশ করে তারা। ইসরায়েলের দাবি, ওই সুড়ঙ্গ হামাসের একটি কার্যালয় হিসেবে ব্যবহার করা হতো।
গাজায় কতজন জিম্মি আছে?
ইসরায়েলের সরকারি পরিসংখ্যান অনুসারে, ৭ অক্টোবর ২৫৩ জনকে জিম্মি করা হয়েছিল। এদের মধ্যে ১০৯ জনকে বন্দী বিনিময়ের অংশ হিসাবে বা পৃথক চুক্তিতে মুক্তি দেওয়া হয়েছে। সামরিক অভিযানে ইসরায়েলি সেনাবাহিনী সরাসরি উদ্ধার করেছে তিনজনকে। ১২ জন জিম্মির মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়েছে, যার মধ্যে তিনজন আইডিএফ অভিযানে নিহত হয়েছে বলে স্বীকার করেছে ইসরায়েল। এখনও যেসব জিম্মি জীবিত আছেন বলে নিশ্চিত হওয়া গেছে তাদের মধ্যে কনিষ্ঠ জিম্মির বয়স ১৮ এবং সবচেয়ে বয়স্ক যিনি তার বয়স ৮৫ বছর।
বাকি ১২৯ জন জিম্মির মধ্যে অন্তত ৩৪ জন মারা গিয়েছেন বলে ইসরায়েল জানিয়েছে। হামাস জানিয়েছে, আইডিএফ এর বিমান হামলার কারণে মৃত জিম্মির সংখ্যা আরও বেশি। কিন্তু এসব অভিযোগের সত্যতা পাওয়া যাচ্ছে না।
হামাস হামলা চালিয়ে যাদের জিম্মি করেছে, তাদের মধ্যে সবচেয়ে কনিষ্ঠ দুই জিম্মি হলেন এরিয়েল এবং কেফির। অপহরণের সময় তাদের একজনের বয়স ছিল চার বছর এবং আরেকজনের মাত্র নয় মাস। তাদের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেলেও নিশ্চিত হওয়া যায়নি।